এলন মাস্কের মন্তব্য : ‘কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের কেউ কাজ পাব না’ – সত্যিই কি AI সব মানব কাজ দখল করবে?

পিনাকী রঞ্জন পাল : কিছুদিন আগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত Vivatech 2024 সম্মেলনে এলন মাস্ক (Elon Musk) একটি বিস্ময়কর বক্তব্য দেন। তিনি সোজাসুজি বলেন, ‘সম্ভবত, হ্যাঁ। আমাদের কেউ কাজ পাব না।’ এই এক কথায় উত্তর দিয়ে তিনি ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরেন যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI মানুষের সমস্ত কাজ দখল করে নেবে। মাস্কের মতে, ভবিষ্যতে যে কোনো পণ্য ও সেবার জরুরি প্রয়োজনে প্রশিক্ষিত রোবটরাই সব কাজ করতে সক্ষম হবে।

প্রথমত, এলন মাস্কের এই বক্তব্যের পেছনে কি কারণ রয়েছে তা বোঝা জরুরি। বর্তমানে AI এবং রোবটিক্সের অভূতপূর্ব উন্নতি আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। স্বয়ংক্রিয় যানবাহন, রোবট সহকারী, এবং ডেটা বিশ্লেষণে AI-এর ভূমিকা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।

তবে, প্রশ্ন হল, সত্যিই কি AI সমস্ত মানব কাজ দখল করে নেবে? আর যদি নেয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনা করতে হবে।

প্রথমত, প্রযুক্তির অগ্রগতি সবসময় মানব সমাজে কর্মসংস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। শিল্প বিপ্লবের সময়েও অনেক মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছিল। তবে, একই সাথে নতুন নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। AI-এর ক্ষেত্রেও এমন কিছু হতে পারে। কিছু কাজ হয়তো রোবট করে ফেলবে, কিন্তু নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হবে।

দ্বিতীয়ত, AI এবং রোবটিক্স মানুষের কাজ সহজ করে দিতে পারে। তারা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করতে পারে, ভুল কম হয়, এবং সময়ও কম লাগে। এটি আমাদের জীবনে সময় ও পরিশ্রম বাঁচাতে সাহায্য করবে। তবে, এর ফলে কিছু পেশার লোকজন তাদের চাকরি হারাতে পারে। যেমন, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চালানোর ফলে ড্রাইভারদের প্রয়োজন কমে যাবে।

তৃতীয়ত, AI-এর দ্বারা সৃষ্ট নতুন চাকরির ক্ষেত্র আমাদের দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজন হতে পারে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন কাজের জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। এই প্রশিক্ষণগুলি কিভাবে দেওয়া হবে এবং কে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করবে, তা আমাদের সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

চতুর্থত, মানবিক স্পর্শ এবং আবেগ যা AI দিয়ে সম্ভব নয়, তা মানব সমাজে চিরকাল থাকবে। চিকিৎসা, শিক্ষা, এবং সেবা ক্ষেত্রে মানুষের প্রয়োজন সবসময় থাকবে। একজন ডাক্তার বা শিক্ষকের সাথে রোগী বা শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মধ্যে যে মানবিক যোগাযোগ রয়েছে, তা কোন রোবট দিতে পারবে না।

তাছাড়া, AI-এর বিকাশের ফলে সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রেও নতুন সুযোগের সৃষ্টি হবে। লেখালেখি, শিল্প, সংগীত ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষের সৃজনশীলতা AI দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে না বরং তা আরও উন্নত হবে। AI আমাদের সৃজনশীল চিন্তা এবং কাজকে সহায়তা করতে পারবে।

এছাড়া, এলন মাস্কের বক্তব্যে একটি বড় প্রশ্ন উঠে আসে যে, যদি সকল কাজ AI দ্বারা করা হয়, তবে মানুষ কি করবে? এলন মাস্কের মতে, মানুষ তখন নিজেদেরকে আরও সৃজনশীল কাজে যুক্ত করতে পারবে এবং নিজের পছন্দের কাজে আরও বেশি সময় ব্যয় করতে পারবে।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সমাজের সব স্তরের মানুষ কি এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে? উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এই পরিবর্তন কতটা সমানভাবে ছড়িয়ে পড়বে, তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে, যেখানে শিক্ষার সুযোগ এবং প্রযুক্তির অ্যাক্সেস সীমিত, সেখানে এই পরিবর্তন কি ভাবে প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

আরেকটি বিষয় হলো, AI এবং রোবটিক্সের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কি আমাদের জন্য নিরাপদ? যদি কোন প্রযুক্তিগত সমস্যা বা হ্যাকিং হয়, তাহলে আমাদের সিস্টেমে বিরাট সমস্যা হতে পারে। এই কারণে, আমাদের AI ব্যবহারে নিরাপত্তা ও নৈতিক দিকগুলি নিশ্চিত করতে হবে।

সবশেষে, এলন মাস্কের বক্তব্য যে সব মানুষের কাজ AI দখল করে নেবে, তা পুরোপুরি সত্য নাও হতে পারে। তবে, এটা নিশ্চিত যে AI এবং রোবটিক্সের বিকাশ আমাদের জীবনে এবং কাজের ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন আনবে। আমাদের এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

মানব সমাজ সবসময় পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, আর এবারও আমরা তা করতে সক্ষম হব। AI আমাদের জীবনে উন্নতি ও সুযোগ এনে দিতে পারে, তবে আমাদের এটিকে সঠিকভাবে এবং দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করতে হবে। এই পরিবর্তন আসন্ন, এবং এর জন্য আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *