লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল
অরিত্র রায়ের জীবনটা যেন এক অদ্ভুত যাত্রা। জলপাইগুড়ির মতো ছোট্ট শহরে তার লেখালেখি নিয়ে পেশা গড়ে তোলা সহজ ছিল না। সে ছোটবেলা থেকেই লেখার প্রতি অনুরক্ত ছিল। সাংবাদিকতার পেশা বেছে নেওয়ার পেছনেও লেখালেখির প্রতি তার এই ভালোবাসার একটা বড় ভূমিকা ছিল। কলেজের শেষ বর্ষে সাংবাদিকতা শুরু করেছিল, তবে সেই সময়ে এই পেশায় আজকের মতো এত অর্থ, সুনাম বা স্বীকৃতি ছিল না।
স্মৃতির আঙিনায় ফিরে যাওয়া
দুর্গাপূজা সদ্য শেষ হয়েছে, কালীপূজার প্রস্তুতি চলছে। এমন এক সকালে, অরিত্র ছাদে বসে দূরের পাহাড়চূড়া দেখছিল। বাতাসে একটা হালকা শীতের আমেজ, প্রকৃতি যেন তার দুঃখ বুঝতে পারছিল। মিঠু, তার একমাত্র মেয়ে, বিয়ের পর প্রথম পূজাতে বাপেরবাড়ি থেকে এসেছিল। একদিন থেকে ফিরে গেছে। অরিত্র এখন একেবারে একা।
অতীতের সেই দিনগুলো যেন হঠাৎ করেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে তার মনে। মিঠুর জন্মের আগের সেই সময়। মীরার সাথে তার সম্পর্ক, তাদের সেই দূরত্ব। প্রথম দিকে অরিত্র ভেবেছিল, মীরা শুধু একটু অভিমানী, সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মীরার সাথে তার সেই সম্পর্কটা এমন ছিল না।
মীরার জীবন সম্পর্কে স্বপ্ন ছিল বড়, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে ছিল সে। অরিত্রের মধ্যে মীরা তার ভবিষ্যতের সেই স্বপ্নগুলো খুঁজে পায়নি। অরিত্রের পেশা, তার জীবনধারা—সবকিছুই মীরার জন্য তুচ্ছ মনে হয়েছিল। তবে অরিত্র ভালোবাসতে জানত, নিজের জায়গা থেকে সবটুকু দিয়ে সে মীরাকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু ভালোবাসা একতরফা হলে সম্পর্কটা দাঁড়িয়ে থাকে না।
সম্পর্কের পরিণতি
মীরার সঙ্গে অরিত্রর বিবাহিত জীবনের প্রথম কয়েকটি বছর কাটল এক দমবন্ধ অবস্থায়। মীরার একান্ত বিশ্বাস ছিল, অরিত্র তাকে সুখ দিতে পারছে না। অরিত্রর জীবননে তখন শুধু কাজ আর কাজ, মীরার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি সে।
অরিত্র অনেকবার চেষ্টা করেছিল মীরার সঙ্গে কথা বলতে, তাদের সম্পর্কের দূরত্ব ঘোচাতে। কিন্তু মীরা তখন রুদ্র নামে এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। রুদ্রর স্ত্রী আগেই ক্যান্সারে মারা গেছে, আর মীরার সঙ্গে তার নতুন সম্পর্কটা নিয়ে কোনও লুকোচুরি ছিল না। অরিত্র জানত, কিন্তু কিছু বলতে পারেনি।
যখন মীরার গর্ভে তাদের মেয়ে এল, তখনও অরিত্র ভেবেছিল মীরার মন বদলাবে। কিন্তু মেয়ের জন্মের পর মীরা যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। সংসারের দিকে তার কোনও আকর্ষণ ছিল না। অরিত্রের কষ্টটা তখন যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল—একদিকে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়, অন্যদিকে মীরা তাকে বারবার দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
নতুন শুরু
শেষ পর্যন্ত মীরার ইচ্ছাতেই সম্পর্কের ইতি ঘটে। অরিত্র মীরাকে তার ভালোবাসা থেকে মুক্তি দেয়, মেয়েকে কোলে নিয়ে রুদ্রর সাথে মীরার বিয়েতে উপস্থিত থাকে। কিন্তু সেই মুহূর্তটা তার জন্য মৃত্যুর মতো ছিল।
এরপর অরিত্র সিদ্ধান্ত নেয়, শহরের কোলাহল ছেড়ে একটু শান্তির খোঁজে গ্রামীণ এলাকায় জমি কিনবে। সেই জমিতেই নতুন বাড়ি তৈরি করে, মেয়েকে নিয়ে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করে। বছর পাঁচ আগে সেই জমিতেই ফ্ল্যাট তৈরি করে প্রমোটরের সাহায্যে একটা স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তোলে।
একাকী জীবনের বেদনাগুলো
আজকের এই সকালে অরিত্রর মনে সেই সব দিনগুলোর কথা আবার ভেসে উঠছে। মীরার কথা, রুদ্রর কথা, এমনকি মেয়েকে নিয়ে প্রথমবার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করার সময়ের কথা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে মিঠুর কথা। মিঠু তার জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা, কিন্তু বিয়ের পর মিঠুও তার নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
অরিত্র জানে মীরাও এখন ভালো আছে, সুখে আছে। আর সে নিজে? সে কি আসলেই সুখে আছে? এই প্রশ্নের উত্তর অরিত্র খুঁজে পায় না।
তার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা, মীরা, তাকে ছেড়ে গেছে, কিন্তু তার জীবনে নতুন কোনও ভালোবাসা আসেনি। আজ সে একা, ফ্ল্যাটের ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু অতীতের স্মৃতিতে ডুবে থাকে।
অবিচ্ছিন্ন স্মৃতির বাঁধন
অরিত্রের জীবনের এক অধ্যায় শেষ, কিন্তু তার প্রভাব যেন আজও মুছে যায়নি। আজ, অরিত্র বসে আছে ছাদের এক কোণে, মিঠুর হাসিখুশি ছোটবেলার স্মৃতিতে ডুবে। মেয়ের প্রথম স্কুলে যাওয়া, তার ছোট ছোট প্রশ্ন, আর বাবার সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা যেন এক মধুর স্মৃতির মতো বুকে জড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই মধুরতা মাঝে মাঝেই তিক্ততার ছায়ায় ঢেকে যায়।
মিঠুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর অরিত্র ভেবেছিল, তার জীবন থেকে যে বেদনা চলে গেছে, তা ধীরে ধীরে মুছে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম ছিল। মিঠুর জীবনে নতুন সম্পর্ক তৈরি হলেও, অরিত্রের জীবনে এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।
মিঠুর প্রতি ভালোবাসা
অরিত্র মিঠুর প্রতি এক অন্যরকম ভালোবাসা অনুভব করত। মা-মীরার প্রভাব থেকে দূরে রেখে মেয়েকে বড় করার জন্য অরিত্র সবসময় চেষ্টা করেছিল। মিঠু ছিল অরিত্রের জীবনের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। মিঠুর জন্য অরিত্র নিজের সৃষ্টিশীলতা এবং কাজের দিকেও আরও মনোযোগী হয়েছিল।
মিঠুর ছোটবেলার নানা ঘটনা অরিত্রের মনে এখনও তাজা। স্কুলের প্রথম দিন মিঠুর কান্না, পরীক্ষার আগে তার উদ্বেগ, এমনকি বাবার কাছে ছোট ছোট কথা বলে শান্তি পাওয়ার মুহূর্তগুলো—এইসব স্মৃতি অরিত্রর মনকে মাঝে মাঝে ভেঙে দেয়। আজ মিঠু সুখে আছে, সেটা জেনে সে শান্তি পায়, কিন্তু মিঠুর সেই শৈশবের মিষ্টি মুহূর্তগুলো যেন আর কখনও ফিরবে না।
মীরার অনুপস্থিতি
অরিত্র অনেকবার ভেবেছিল, মীরার জীবন থেকে বেরিয়ে আসার পর তার জীবন হয়তো সহজ হবে। কিন্তু আজ মীরার স্মৃতিগুলোও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। রুদ্রর সাথে মীরার বিয়ের পর মীরার কোন খোঁজ সে আর নেয়নি। মীরা সুখে আছে, এটা জানলেও, একসময় যার প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল, তার সুখের জন্যও মাঝে মাঝে অরিত্র নিজেকে অপরাধী ভাবত।
মীরা হয়তো রুদ্রর সাথে সুখে আছে, কিন্তু তার মনকে একান্তভাবে বোঝাতে পারে না অরিত্র। মীরা আর মিঠুর শৈশব, তার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো অরিত্রর স্মৃতির গভীরে গেঁথে আছে। এই সম্পর্কের তিক্ততা থাকা সত্ত্বেও, মীরার উপস্থিতি যেন জীবনের এক অধ্যায়, যা অরিত্রর ভেতরকার একা থাকার কারণ হয়ে উঠেছে।
নীরবতায় জমে থাকা প্রশ্ন
অরিত্র যখন ছাদে বসে মিঠুর শৈশবের স্মৃতিতে ডুবে ছিল, তখন তার মনে হঠাৎ করে একটি অদ্ভুত প্রশ্ন উঠে এল। এত বছর ধরে তার জীবনে অনেক কিছু ঘটেছে, অনেক সম্পর্ক এসেছে, আবার চলে গেছে, কিন্তু তার নিজের জীবনের প্রতি কি সে একবারও সত্যি মনোযোগ দিয়েছে? মিঠুর প্রতি ভালবাসা, মীরার প্রতি অগাধ অনুভূতি, এইসবের মধ্যে কি সে কখনও নিজেকে জানতে চেয়েছে?
স্মৃতির এক পরতের নিচে জমে থাকা প্রশ্নগুলো যেন হঠাৎ করে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইল। মিঠুকে বড় করার দায়িত্ব, মীরাকে ভালবেসে ধরে রাখার চেষ্টা—সবকিছুতেই সে নিজেকে ভুলে থেকেছে। কিন্তু আজকের এই একাকী সময়ে, এই নীরবতা যেন তার ভেতরে জমে থাকা প্রশ্নগুলোকে স্পষ্ট করে তুলছে।
অরিত্রর নিজের পরিচয়
নিজের জীবনের নানা অধ্যায় ফিরে ফিরে আসছে তার সামনে। কলেজের দিনগুলো, যখন সে লেখক হতে চেয়েছিল, তার সেই স্বপ্নগুলো এখন কোথায়? সাংবাদিকতা তো একসময় পেশা হয়েছিল, কিন্তু লেখালেখির প্রতি তার আসল টানটা কি হারিয়ে গেছে? মিঠু আর মীরাকে ঘিরে জীবন কেটে যেতে যেতে কি সে নিজেই নিজের থেকে দূরে সরে গেছে?
অরিত্র ভাবতে থাকে, আজ এতকিছুর পর, এত বেদনা আর ত্যাগের পরও, কি সে নিজের জন্য কিছু করেছে? লেখালেখির প্রতি সেই পুরনো ভালোবাসা কি সে কখনও ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল? আজ এই শূন্য সময়ে, যখন মিঠু সুখে আছে, মীরা নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত, অরিত্র কি সত্যিই জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে?
অপ্রাপ্তি আর কষ্টের মিশ্রণ
মনের এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অরিত্রের ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভূত হয়। তার জীবনের সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি মীরার ভালোবাসা, যেটা সে চেয়েও পায়নি। মীরাকে সে সবসময় নিজের পাশে চেয়েছিল, কিন্তু মীরা তাকে ছেড়ে অন্য জীবনে চলে গেছে। আজ মীরা সুখে আছে, তবুও অরিত্র নিজেকে ব্যর্থ ভাবতে শুরু করে।
এই ব্যর্থতার অনুভূতি তাকে ক্ষতবিক্ষত করে, কিন্তু একইসাথে তাকে সামনে এগোনোর পথে ধাবিত করে। মিঠুর জীবনে সে একটা জায়গা ধরে রাখতে চেয়েছে, কিন্তু আজ মিঠুরও নিজস্ব জীবন আছে। এই উপলব্ধি তাকে আরও একাকী করে তোলে।
অরিত্রর মনে হয়, এই জীবনটা শুধু দায়িত্ব পালন করে কাটিয়ে দিয়েছে। মীরার সাথে তার সম্পর্ক, মিঠুকে মানুষ করা—সবকিছুই জীবনের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু নিজের জন্য সে কি কখনও কিছু করেছে?
নতুন আলোর খোঁজে
অরিত্রের জীবনের সমস্ত স্মৃতির ভার, বেদনা এবং প্রশ্নের ভার নিয়ে ছাদে বসে থাকা অবস্থায় সে আচমকাই উপলব্ধি করে, তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল নিজের প্রতি উদাসীনতা। মিঠু এবং মীরার জন্য সে এত কিছু করেছে, কিন্তু তার নিজের জীবনের স্বপ্নগুলো কখনও গুরুত্ব পায়নি। লেখক হওয়ার স্বপ্নটা সে জীবনের চাপে হারিয়ে ফেলেছে।
তবে এখন, যখন তার জীবন ফাঁকা, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, মীরার সাথে সম্পর্কের অধ্যায়ও বহু আগেই বন্ধ হয়েছে—এখন সময় এসেছে নিজের জন্য কিছু করার। জীবনের এই শূন্যতাকে সে আর দুর্বলতার জায়গা থেকে দেখতে চায় না। অরিত্র ঠিক করে, এখন থেকে সে তার পুরনো স্বপ্নের দিকে ফিরে যাবে। লেখালেখির প্রতি তার ভালোবাসা আবার নতুন করে খুঁজে পাবে।
নতুন যাত্রা
অরিত্র ঠিক করে, এই একাকীত্ব আর শূন্যতাকে সে আর কষ্ট হিসেবে দেখবে না। জীবনের এই নীরব সময়টাকেই সে তার নতুন সৃষ্টির ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করবে। ছোটবেলার সেই লেখার প্রতি ভালোবাসা, যেটা এতদিন চাপা পড়ে ছিল, তা নিয়ে আবার সে কাজ শুরু করবে। নিজের জীবনের গল্পগুলো, মীরার সাথে তার ব্যর্থ সম্পর্ক, মিঠুর প্রতি ভালবাসা—সবকিছু নিয়ে নতুনভাবে লেখার সিদ্ধান্ত নেয়।
অরিত্র ভাবতে থাকে, হয়তো তার জীবনের শেষ অধ্যায় এখনও লেখা হয়নি। এখনও অনেক কিছু করার বাকি আছে। লেখার মাধ্যমে সে তার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে নতুনভাবে প্রকাশ করবে, এবং এই নতুন যাত্রা তাকে আরও শান্তি দেবে।
অরিত্রর নিজের জন্য বাঁচা
অবশেষে অরিত্র তার জীবনের শূন্যতা মেনে নেয়, কিন্তু সেই শূন্যতার মধ্যে থেকেও সে নতুন করে নিজেকে খুঁজে পায়। মিঠু তার নিজের জীবনে সুখী, মীরা তার জীবন নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু অরিত্র এখন আর কেবল তাদের ছায়ায় বাঁচতে চায় না। সে তার নিজের ছায়া তৈরি করতে চায়—তার লেখার মাধ্যমে, তার নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।
নতুন দিনের আলো
অরিত্র ছাদের এক কোণে বসে ছিল, মনে মনে নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল। চারপাশে প্রকৃতির নীরবতা, হালকা শীতের বাতাস, আর দূরের পাহাড়গুলো যেন তার চিন্তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছিল। জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়ে, আজ তার মনে প্রশ্ন জেগেছে—এই সময়গুলোতে সে আসলে কী পেয়েছে? কতটুকু নিজের জন্য বাঁচতে পেরেছে?
মিঠু সুখে আছে, এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। মীরাও আজ সুখে আছে। কিন্তু তার জীবনের সেই অধ্যায়গুলোর বেদনা যেন সবসময়ই তাকে তাড়া করে ফিরেছে। আজ এতদিন পর, যখন তার সামনে নতুন কিছু নেই, তখন সেই পুরনো স্মৃতিগুলো আরও বেশি করে তাকে গ্রাস করতে চেয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ করেই, অরিত্রর মনে এক অন্যরকম অনুভূতি হল। কেন সে আজও সেই পুরনো বেদনার ভার বইতে থাকবে? মীরার চলে যাওয়ার পর তার জীবনে যে একাকীত্ব এসেছে, সেটা তো সে নিজেই তৈরি করেছে। মিঠুকে বড় করার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সে হয়তো নিজের জন্য কিছুই করেনি। কিন্তু এখন? এখন তো মিঠুর নিজের জীবন আছে, আর অরিত্রর সামনে নতুন কিছু করার সুযোগ।
সেই পুরনো স্বপ্নগুলো কি এখনও সম্ভব নয়?
লেখালেখির প্রতি তার ভালোবাসা একসময় তাকে সাংবাদিকতা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্নটা ধীরে ধীরে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। জীবনের জটিলতা আর দায়িত্বের বোঝায় চাপা পড়ে গিয়েছে সেই সৃষ্টিশীলতা। কিন্তু এখন তো সময় আছে! অরিত্র জানে, বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। মনের শক্তি থাকলে এখনও সে তার সেই পুরনো স্বপ্নের পথে ফিরে যেতে পারে।
কেন সে আর একটু লিখবে না? কেন সে নিজের সৃষ্টিশীলতাকে নতুন করে ফিরিয়ে আনবে না?
এইসব ভাবতে ভাবতেই অরিত্রর ভেতরে একটা অদ্ভুত শক্তি অনুভূত হল। মিঠুর বিয়ে হয়ে গেছে, মীরাও সুখে আছে—এখন তার আর কোনও দায়িত্ব নেই, কোনও বাঁধা নেই। এই মুহূর্ত থেকে সে নিজেকে নতুন করে গড়তে পারবে। জীবনের এই শেষ অধ্যায়টা তার জন্য এক নতুন যাত্রার সূচনা হতে পারে।
অরিত্র উঠে দাঁড়াল। ছাদের এক কোণে বসে থাকার আর কোনও মানে নেই। চারপাশে সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন দিনের আলোয় ভরে উঠছে প্রকৃতি। সেই আলো যেন তাকে নতুনভাবে বাঁচার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।
অরিত্র ঠিক করল, আজ থেকে সে আবার লেখার জগতে ফিরবে। তার পুরনো খাতা আর কলম খুঁজে বের করবে। হয়তো পুরনো স্মৃতিগুলোকে গল্পের রূপ দেবে, হয়তো নতুন কিছু লিখবে। কিন্তু সে এবার জীবনের নতুন পথ বেছে নেবে, যেখানে কোনও আফসোস থাকবে না।
সে ধীরে ধীরে ছাদ থেকে নামতে শুরু করল। নতুন দিনের আলোতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। অতীতের ছায়া তাকে আর বেঁধে রাখতে পারবে না—সে এখন নিজের জীবনের নতুন আলো খুঁজতে চলেছে।
© পিনাকী রঞ্জন পাল