মজার গল্প : বুড়ো পঞ্চুর বিয়ে

লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল

গ্রামের নাম বামুনডাঙ্গা। এই গ্রামে এমন একজন মানুষ আছেন, যার নাম শুনলে গ্রামের মানুষ হাসতে হাসতে পেট ফেটে যায়। আর সেই ব্যক্তি হলেন—পঞ্চু ঠাকুর। বয়স প্রায় পঞ্চাশ পেরিয়েছে, কিন্তু তার মাথায় আছে একটাই চিন্তা—বিয়ে!

পঞ্চু চিরকালই একটু আলাদা ধরনের মানুষ। তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, সে সর্বদা কিছু না কিছু চমক লাগানো কাজের চিন্তায় মগ্ন। চেহারায় ভারিক্কি হলেও, তার চপল চোখে সবসময়ই যেন নতুন কোনো পরিকল্পনা খেলে বেড়ায়। তবে পঞ্চুর সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা এখন একটাই—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করা। গ্রামের সবাই জানে, পঞ্চু ঠাকুর একেবারে বিয়ে পাগল হয়ে উঠেছে।

গ্রামে পঞ্চুর বিয়ে নিয়ে কম রসিকতা হয় না। কেউ বলে, “বুড়ো বয়সে বিয়ে করলে বউ তো পালাবে, কিন্তু পঞ্চু?” আবার কেউ বলে, “পঞ্চুর তো আসলেই বৌ দরকার! এতদিনে যদি বিয়েটা করতে পারে, তো লোকে ভাববে তার গর্ভ থেকে আশীর্বাদে কেউ এসে মেয়েকে বিয়ে দিল।” তবে এসব শুনে পঞ্চু একদমই বিচলিত হয় না। সে তার একটাই কথা, “বিয়ে বয়সের জন্য নয়, মন আর ইচ্ছের জন্য। বিয়ে আমি করবই!”

পঞ্চু তার বিয়ের প্রস্তুতি নিতে নেমে পড়ল। পাত্রী খুঁজতে শুরু করল। কিন্তু মেয়েদের পছন্দ করাটা একেবারে সহজ নয়। যেখানে যাই, কোনো না কোনো সমস্যা হয়। গ্রামের মেয়ে ফুলিকে পঞ্চুর বেশ মনে ধরেছিল, কিন্তু তারও বিয়ে হয়ে গেল হুট করে। পঞ্চু ভাবল, “এ কী সর্বনাশ! এই গ্রামে মেয়ে নেই নাকি?”

কিছুদিন পর গ্রামের নতুন এক মেয়ে এসে উপস্থিত হলো। তার নাম হিরন্ময়ী। হিরন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে পঞ্চুর মনে হলো, এবার তার আশা পূরণ হবেই। প্রতিদিন সকালে সে হিরন্ময়ীর বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটে, এক হাতে লাঠি নিয়ে, অন্য হাতে মেয়েটিকে এক পলক দেখার জন্য ঝুঁকে পড়ে। পঞ্চুর চোখে তখন কী এক মায়া খেলে যায়, যেন বলতে চায়, “তোমাকে বিয়ে করব, তুমি জানো না?”

গ্রামের লোকেরা পঞ্চুর এই কাণ্ড দেখে হেসে অস্থির হয়। হাটে-বাজারে, পঞ্চুর এই প্রেম নিয়ে চর্চা শুরু হয়। একদিন সাহস করে পঞ্চু সোজা হিরন্ময়ীর বাবার সামনে গিয়ে বলল, “কাকা, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।”

হিরন্ময়ীর বাবা তো এই শুনে অবাক! প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরে বললেন, “তোর তো বয়স হয়ে গেছে। তুই বিয়ে নিয়ে এত চিন্তা করছিস কেন?”

পঞ্চু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিল, “বিয়ে বয়স দেখে হয় না। ভালোবাসার কোনো বয়স নেই! আমি হিরন্ময়ীকেই বিয়ে করব।”

এই কথা শুনে হিরন্ময়ীর বাবা একটু রেগে গিয়ে বললেন, “বুড়ো পঞ্চু, তুই এখান থেকে পালা নইলে চড় মেরে বের করে দেব।” পঞ্চু ততক্ষণে অবস্থা বুঝে গেছে। সে দ্রুত পালিয়ে গেল, কিন্তু মনে মনে ঠিক করল—বিয়ে সে করবেই!

এইসব ঘটনার পরেও পঞ্চুর বিয়ের চেষ্টা থামল না। গ্রামের লোকেরা মজা করেই বলল, “পঞ্চুর বিয়ে মানে, পুরো গ্রামের উৎসব। কে জানে, এই বিয়ে একবার হলে কেমন হাসির রোল উঠবে।”

গ্রামে নাটকের আয়োজন হলো। নাটকের নাম ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। পঞ্চু সেখানে গিয়ে নতুন চিন্তা করল—এইবার নাটকের নায়িকাকেই বিয়ে করব! মঞ্চের নায়িকা যখন নাটকে অভিনয় করছে, পঞ্চু হঠাৎ মঞ্চে উঠে সবার সামনে নায়িকার হাত ধরে বলল, “তোমায় আমি বিয়ে করব!”

এই কথা শুনে পুরো মঞ্চ থমকে গেল। নায়িকা প্রথমে কিছু বোঝার আগেই পঞ্চুর গালে একটা ঝাঁপটা দিল! দর্শকরা হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল, আর পঞ্চু বিড়বিড় করে বলে উঠল, “এইবারও হলো না!”

নাটকের সেই ঘটনায় পুরো গ্রাম হাসিতে ফেটে পড়ল, কিন্তু পঞ্চু তার সিদ্ধান্ত থেকে সরল না। এবার সে আরও বড় পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামল। সে গ্রামের প্রধান মাতব্বরের কাছে গিয়ে বলল, “কাকা, এইবার আমার বিয়েটা তুমি ঠিক করে দাও।”

মাতব্বর তাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন মেয়ে চাইছিস বলতো?”

পঞ্চু বলল, “আমি এমন মেয়ে চাই যে আমার মতো হবে। আমাকে ছেড়ে যাবে না!”

মাতব্বর মুচকি হেসে বললেন, “তুই যেমন বললি, তেমনই মেয়ে আমি খুঁজে দেব। তুই শুধু দুই দিন অপেক্ষা কর।”

দুই দিন পর পঞ্চু গ্রামের সবাইকে ডাকল। বড় ঘটা করে সবাইকে জানাল, “আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! কাকা বলেছিল যে আমার মতো মেয়ে খুঁজে দেবে, আর সে তার কথা রেখেছে। দেখো, এই যে আমার বউ!” পঞ্চু একখানা আয়না বের করে সবার সামনে ধরে দেখাল।

সবাই তো হতবাক! পঞ্চু নিজের প্রতিচ্ছবিকে বিয়ে করেছে! গ্রামের লোকেরা হেসে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। বুড়ো পঞ্চু নিজের বিয়ে নিজেই করে ফেলেছে!

পঞ্চু খুশি। বলল, “বিয়ে তো বিয়েই। এখন কেউ আর আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না!

শেষ কথা : পঞ্চুর জীবনের এই গল্পের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক বড়ো শিক্ষা। বলতে পারবেন কি সেই শিক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *