গোয়েন্দা গল্প : গয়না চুরির রহস্য উদঘাটন

লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল

জলপাইগুড়ির অষ্টম শ্রেণীর পড়ুয়া ইধিকা সেন খুবই মেধাবী এবং বুদ্ধিমান মেয়ে। ওর বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ঈপ্সিতা, যার সঙ্গে ইধিকার সম্পর্ক খুবই ভালো। তবে ইধিকা শুধু মেধাবী নয়, ওর আরও একটা পরিচয় আছে—সেটা হলো, ও একজন গোয়েন্দা। যদিও ও বয়সে ছোট, তবুও সে বেশ কয়েকটি রহস্য সমাধান করেছে। বন্ধুরা তার সাহস ও বুদ্ধিমত্তার জন্য তাকে খুবই শ্রদ্ধা করে।

একদিন ইধিকা স্কুলে যায়নি, সেদিনই ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। ঈপ্সিতা একটি ছোট্ট মূল্যবান গয়না, যা তার ঠাকুমা তাকে দিয়েছিল, স্কুলে এনেছিল। ঈপ্সিতার মা তাকে বারণ করেছিল গয়না স্কুলে নিয়ে যেতে, কারণ এটি খুব মূল্যবান এবং তার ঠাকুমার শেষ স্মৃতি। কিন্তু ঈপ্সিতা সে কথা শুনেনি। তার খুব ইচ্ছে ছিল তার বন্ধুদের কাছে গয়নাটি দেখাবে, তাই সে গোপনে গয়নাটি ব্যাগে করে স্কুলে নিয়ে আসে।

টিফিনের সময়, ঈপ্সিতা গয়নাটি ব্যাগে রেখেই মাঠে খেলতে চলে যায়। ফিরে এসে দেখে তার ব্যাগের চেন খোলা, আর গয়নাটি নেই! প্রথমে ঈপ্সিতা ভেবেছিল হয়তো অন্য কোথাও রেখেছে। কিন্তু না, সে ভালো করেই মনে করতে পারল যে গয়নাটি সে ব্যাগের ভিতরেই রেখেছিল। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এই নিয়ে স্কুলের শিক্ষিকাদের জানাল সে। শিক্ষিকা ক্লাসের সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, যদি কেউ ভুলবশত ঈপ্সিতার গয়নাটি নিয়ে থাকে, তাহলে যেন ফেরত দেয়। কিন্তু কেউই কোনো উত্তর দিল না।

ঈপ্সিতা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল, কিন্তু মনে খুব ভয়। মায়ের কাছে গয়নাটি হারানোর কথা বলতেই মা খুব রাগ করলেন। ঈপ্সিতা কেঁদে ফেলল, কারণ এই ঘটনা তার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কিছু করারও ছিল না।

পরদিন ইধিকা স্কুলে এলে, ঈপ্সিতা তার কাছে এসে সব খুলে বলল। সে চায় ইধিকা যেন এই চুরির রহস্যের সমাধান করে দেয়। ঈপ্সিতা জানে, ইধিকার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে এই রহস্য সমাধান করা কঠিন হবে না।

ইধিকা ঈপ্সিতার কথা মন দিয়ে শোনার পর প্রথমে স্কুলের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে থাকে। সে বুঝতে পারে, চুরি যে করেছে, সে হয়তো ঈপ্সিতার কাছের কেউ, কারণ সবাই জানত না যে ঈপ্সিতা ওই দিন গয়না এনেছিল। ইধিকা ঈপ্সিতাকে কিছু প্রশ্ন করল—

“তুই কাকে কাকে দেখিয়েছিলি গয়নাটা?”

“তেমন কাউকে দেখাইনি। কিন্তু টিফিনের আগেই কোয়েল আর শ্রুতি আমার কাছে এসে বলছিল, আমি নাকি ব্যাগের মধ্যে কিছু লুকিয়ে রেখেছি। ওদের খুব কৌতূহল হচ্ছিল।”

ইধিকা এবার আরও গভীর ভাবে ভাবতে লাগল। ঈপ্সিতা হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই গয়নাটি না দেখালেও, কোয়েল আর শ্রুতি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। তবে ওরা ছাড়া আর কেউ এই ব্যাপারে জানত কি না, সেটা বোঝা দরকার ছিল।

ইধিকা ক্লাসে গিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইল। সে দেখছিল কোয়েল আর শ্রুতি দুজনেই কিছুটা অস্বাভাবিকভাবে কথা বলছে, হাসাহাসি করছে। কিন্তু যেটা তাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করল, সেটা হলো কোয়েলের পকেটের ভিতরে একটা কিছু চকচক করছে। ইধিকা তা লক্ষ করল, কিন্তু কিছু বলল না। সে জানত, সরাসরি কিছু বললে চোর সাবধান হয়ে যাবে। তাই সে পরিকল্পনা করল একটা ফাঁদ পাতার।

টিফিনের সময়, ইধিকা ঈপ্সিতাকে বলল, “দেখ, আমি একটা পরিকল্পনা করেছি। তুই ঠিক করেছিস কে কে তোর ব্যাগের কাছে এসেছিল?”

“হ্যাঁ, আমি দেখেছি, কোয়েল আর শ্রুতি ওই সময় আমার ব্যাগের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল।”

“ভালো। এবার আমি একটা কাজ করব। আজ টিফিনে আমরা সবাই একসঙ্গে বসব আর একটা বিশেষ কথা বলব। তুই বলবি যে তোর মা তোকে অন্য একটা গয়না দিয়েছে, যা আরও মূল্যবান।”

ঈপ্সিতা একটু ভয় পেয়েছিল, কিন্তু ইধিকার বুদ্ধিমত্তার উপর ভরসা রেখেছিল। সে ঠিক করল ইধিকার কথামতো কাজ করবে।

টিফিনের সময় সবাই মিলে খেলতে যাওয়ার সময় ঈপ্সিতা ইচ্ছাকৃতভাবে বলল, “জানিস, মা আমাকে আরেকটা গয়না দিয়েছে। সেটাও খুব সুন্দর আর মূল্যবান। তবে আমি সেটা আজ আনিনি। কিন্তু কাল হয়তো আনব।”

ঈপ্সিতার কথা শুনে কোয়েল আর শ্রুতির চোখ চকচক করে উঠল। ইধিকা তাদের ভাবভঙ্গি খুব ভালো করে লক্ষ্য করছিল। সে জানত, চোর আবার ফাঁদে পা দেবে।

পরদিন স্কুলে ইধিকা আগেই এসে কিছু পরিকল্পনা করে রাখল। সে এবং ঈপ্সিতা একসঙ্গে গিয়ে সেই পুরোনো ব্যাগে কিছু সাধারণ খেলনা রেখে দিল। ওরা ঠিক করেছিল চোর এই ব্যাগটি আবার হাতড়াবে। এর পরে ইধিকা ক্লাসে এসে নিজের জায়গায় বসল, কিন্তু তার চোখ ছিল সবসময় ব্যাগের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কোয়েল আর শ্রুতি আবার ঈপ্সিতার ব্যাগের দিকে তাকাতে শুরু করল। টিফিনের সময় ঘর ফাঁকা হতেই, তারা আবার ব্যাগের কাছে গিয়ে হাতড়াতে লাগল, কিন্তু এইবার তারা কোনো গয়না পেল না, বরং পেল কিছু সাধারণ খেলনা। যা দেখে তাদের মুখ তখনই শুকিয়ে গেল।

ইধিকা এবার সামনে এসে তাদের হাতেনাতে ধরে ফেলল। বলল, “তোরা কী খুঁজছিলি?”

কোয়েল আর শ্রুতি কিছুতেই মানতে চাইছিল না যে তারা চুরি করেছে। কিন্তু ইধিকা তাদেরকে বলল, “যদি চুরি না করে থাকিস, তবে কেন এতবার ঈপ্সিতার ব্যাগ হাতড়াচ্ছিলি? কাল যখন ঈপ্সিতা বলেছিল, সে আজ গয়না আনবে না, তখন থেকেই আমি জানতাম তোরা সন্দেহজনক।”

শ্রুতি ভয়ে কেঁদে ফেলল। সে সব স্বীকার করল। “আমি জানি এটা অন্যায় হয়েছে। কোয়েলই প্রথম গয়নাটা দেখেছিল আর আমাকে বলেছিল ওটা নিয়ে নিতে। আমরা শুধু মজা করতে চেয়েছিলাম, ফেরত দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভয় পেয়ে গেছিলাম, তাই আর কিছু বলতে পারিনি।”

ইধিকা এবং ঈপ্সিতা এই ঘটনায় খুব অবাক হলেও তারা বুঝেছিল যে ভুলের পরিণতি তাদের বুঝিয়ে দেওয়াই ভালো। ইধিকা শ্রুতি এবং কোয়েলকে বলল, “গয়না চুরি করা কোনো মজার কাজ নয়। এটা বড় অপরাধ। এবার ক্লাসে ম্যামকে গিয়ে সব বলবি।”

পরে ম্যামের সামনে গিয়ে কোয়েল আর শ্রুতি সব কথা খুলে বলল। ম্যাম তাদের শাস্তি দিলেন এবং ঈপ্সিতার গয়না তাকে ফেরত দিলেন।

এভাবে ইধিকা তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দ্বারা আরেকটি রহস্যের সমাধান করে ফেলল, আর তার বন্ধুরা আরও একবার তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করল।

শেষ

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a reply

  • Default Comments (0)
  • Facebook Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *