Success Story : দীপ্তি জীবনজির সাফল্যের গল্প

পিনাকী রঞ্জন পাল : মানব জীবনে প্রতিকূলতা যেন এক চিরন্তন সত্য। কিন্তু এই প্রতিকূলতাকে জয় করে যারা নিজেদের জীবনে আলোর দিশা দেখায়, তারা সমাজের জন্য হয়ে ওঠে এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তেলেঙ্গানার এক ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে আসা দীপ্তি জীবনজি সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের একজন। জীবনের শুরু থেকে যে মেয়েটিকে ‘পাগলি,’ ‘বাঁদরি,’ আর ‘অমঙ্গল’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, তারাই আজ তার সাফল্যের গানে প্রশংসার সুর তোলে। দীপ্তি শুধু নিজের প্রতিভা দিয়ে নয়, নিজের কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে জীবনের প্রতিকূলতাকে জয় করেছেন।

কঠিন শৈশবের অন্ধকার
দীপ্তির জন্ম হয় এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। মস্তিষ্কের গঠনগত ত্রুটির কারণে জন্ম থেকেই দীপ্তি অন্যদের থেকে আলাদা ছিলেন। কথা বলার ধরন, চিন্তাভাবনার পদ্ধতি, সবকিছুই ছিল আলাদা। গ্রামের বাচ্চারা তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করত, তার মা-বাবাকে নানা কটু কথা বলত। কিন্তু দীপ্তির মা ধনলক্ষ্মী ছিলেন তার একমাত্র আশ্রয়। শৈশবে মায়ের স্নেহ আর ভালোবাসাই ছিল তার একমাত্র সান্ত্বনা।

প্রতিভার খোঁজ
২০১০ সালে প্রথমবার দীপ্তির প্রতিভা নজরে আসে রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পিটি কোচ বিয়ানি ভেঙ্কটেশ্বরালুর। দৌড়ে সুস্থ-সবল বাচ্চাদের অনায়াসে হারানোর ক্ষমতা দেখে কোচ তার মধ্যে সম্ভাবনার আলো দেখতে পান। কিন্তু দীপ্তির মধ্যে তখনও ছিল আত্মবিশ্বাসের অভাব। বিয়ানি তাকে কঠোর প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। শুরুতে ভুল করলেও দীপ্তি থেমে থাকেননি। তার কোচের অক্লান্ত পরিশ্রম আর দীপ্তির অদম্য ইচ্ছাশক্তি ধীরে ধীরে তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।

হায়দ্রাবাদে নতুন অধ্যায়
২০১৯ সালে খাম্মামের স্টেট মিটে দীপ্তি নজরে আসেন স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার কোচ এন. রমেশের। তিনি দীপ্তির মা-বাবাকে রাজি করান মেয়েকে হায়দ্রাবাদের সাই সেন্টারে পাঠাতে। তবে, দরিদ্র পরিবারটি মেয়েকে হায়দ্রাবাদে পাঠানোর বাসভাড়াও বহন করতে পারছিল না। তবুও অনেক সংগ্রামের পর দীপ্তি পৌঁছান হায়দ্রাবাদ। সেখানে তিনি শুরু করেন পেশাদার প্রশিক্ষণ।

প্রথম দিকে দীপ্তির শেখার ক্ষমতা নিয়ে সবাই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সবাইকে ভুল প্রমাণ করেন। তার নিষ্ঠা, পরিশ্রম, আর কোচদের নির্দেশ পালন করার ক্ষমতা তাকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

সাফল্যের উড়ান
দীপ্তির জীবনের অন্যতম বাঁক বদল আসে যখন পুলেল্লা গোপিচাঁদের মুগ্ধ নজরে তিনি পড়ে যান। গোপিচাঁদ বুঝতে পারেন, মেয়েটির মধ্যে আছে অসাধারণ ক্ষমতা। তার ফাউন্ডেশন দীপ্তিকে স্পনসর করা শুরু করে। এরপর দীপ্তি যা করেন, তা আর ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়।

২০২২ সালের এশিয়ান প্যারা গেমস: দীপ্তি সোনা জিতে গেমস রেকর্ড গড়েন।

২০২৪ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ: এখানে তিনি সোনা জিতে বিশ্বরেকর্ড করেন।

শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা
দীপ্তির জীবন আমাদের শেখায় যে, প্রতিকূলতা যতই কঠিন হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা থাকলে সাফল্য আসবেই। জীবনের পথে বিদ্রুপ, অবহেলা, আর প্রতিকূলতা তাকে থামাতে পারেনি। তার কোচ, পরিবারের সহায়তা আর নিজের ইচ্ছাশক্তি তাকে জীবনের প্রতিটি বাঁধা পেরোতে সাহায্য করেছে।

শেষ কথা
‘পাগলি,’ ‘বাঁদরি,’ ‘অমঙ্গল’—এই শব্দগুলোকে দীপ্তি তার সাফল্যের মাটির নিচে পুঁতে দিয়েছেন। তার সাফল্যের গল্প শুধু এক খেলোয়াড়ের নয়, এক যোদ্ধার। দীপ্তি আজ সেই আলো, যিনি কোটি মানুষের জন্য প্রেরণা। তার জিদ আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি আমাদের শেখায় যে, মানুষের সীমাবদ্ধতা যতই থাকুক না কেন, স্বপ্ন আর পরিশ্রমের ডানায় ভর করে যে কেউ আকাশ ছুঁতে পারে। দীপ্তি উড়েছেন, এখনো উড়ছেন, এবং ভবিষ্যতে আরো উড়বেন। কারণ, দীপ্তির মতো মানুষ থেমে থাকেন না। তারা আলো ছড়ান, ইতিহাস তৈরি করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *