ডি গুকেশ : ১৮ বছরের এক তারকার স্বপ্নপূরণ এবং ইতিহাস গড়ার গল্প

পিনাকী রঞ্জন পাল : একজন তরুণ যদি নিজের লক্ষ্য স্থির করেন এবং সেই লক্ষ্যপূরণে সমস্ত কিছু উজাড় করে দেন, তাহলে ইতিহাস রচিত হতে বাধ্য। ভারতীয় দাবাড়ু গুকেশ ডোম্মারাজু এমনই এক বিস্ময় প্রতিভা, যিনি ১৮ বছর বয়সে বিশ্ব দাবার ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেন। তিনি শুধুমাত্র বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ দাবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নন, বরং এমন এক কিংবদন্তি, যিনি গ্যারি কাসপারভের মতো গ্রেটেস্ট অফ অল টাইমের রেকর্ড ভেঙে দেখালেন—স্বপ্ন পূরণ করার জন্য বয়স কোনো বাধা নয়।

কনিষ্ঠতম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন : সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ২০২৪ সালের বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে গুকেশ মুখোমুখি হয়েছিলেন চীনের ডিং লিরেনের। এটি ছিল এক ইতিহাস তৈরির মুহূর্ত। ডিং লিরেন ছিলেন বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং অভিজ্ঞতার দিক থেকে গুকেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তবে ১৪তম রাউন্ডে গুকেশ তার অসাধারণ মনঃসংযোগ, কৌশল এবং ঠান্ডা মাথার খেলা দিয়ে প্রমাণ করলেন, তিনি শুধু প্রতিযোগী নন—তিনি দাবার সিংহাসনের যোগ্য অধিকারী।

মাত্র ১৮ বছর ৮ মাস ১৪ দিন বয়সে গুকেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরে এমন একটি রেকর্ড গড়লেন, যা এতদিন ধরে ছিল কিংবদন্তি গ্যারি কাসপারভের দখলে। কাসপারভ ২২ বছর বয়সে এই শিরোপা অর্জন করেছিলেন। গুকেশের জয় কেবল তার ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, এটি দাবার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন।

গুকেশের জীবনের যাত্রা : গুকেশের জন্ম ২০০৬ সালের ২৯ মে চেন্নাইয়ে, একটি তেলেগু পরিবারে। তার বাবা রাজিনীকান্ত একজন ইএনটি সার্জন এবং মা পদ্মা একজন অণুজীব বিজ্ঞানী। সাত বছর বয়সে দাবা খেলা শেখা গুকেশ শৈশব থেকেই দেখিয়েছিলেন তার মেধার ঝলক।

২০১৫ সালে, মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি এশিয়ান স্কুল দাবা প্রতিযোগিতায় সোনার পদক জিতে প্রথমবার সবার নজর কাড়েন। এর তিন বছর পর, মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি গ্র্যান্ডমাস্টারের মর্যাদা অর্জন করেন। এরপর থেকে একের পর এক সাফল্যের গল্প লিখেছেন তিনি।

২০২২ সালের দাবা অলিম্পিয়াডে তিনি ভারতকে সোনা এনে দেন এবং একই বছরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দেন। তবে তার স্বপ্ন ছিল আরও বড়—বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া।

স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার দীর্ঘ যাত্রা : একজন দাবাড়ুর জীবনে ধৈর্য, মনঃসংযোগ, এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুকেশ তার অভিজ্ঞতা, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে এই গুণগুলো অর্জন করেছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টারের মর্যাদা পাওয়া এবং ২০২২ সালের দাবা অলিম্পিয়াডে সোনা জিতে গোটা বিশ্বকে চমকে দেওয়ার পর তিনি নিজের লক্ষ্য স্থির করেছিলেন—বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া।

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিন : গুকেশের এই যাত্রার চূড়ান্ত অধ্যায় হলো ২০২৪ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। তার প্রতিপক্ষ ছিলেন বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ডিং লিরেন, যিনি দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতায় অনেক এগিয়ে। তবে ১৪তম রাউন্ডে, যেখানে গুকেশ কালো ঘুঁটি নিয়ে খেলছিলেন, তার মনঃসংযোগ এবং দৃঢ় সংকল্প তাকে জয়ের পথে নিয়ে যায়। ডিং লিরেনের একটি ভুল চালই হয়ে ওঠে গুকেশের জন্য সোনার সুযোগ।

কান্নার সঙ্গে বিজয়ের উল্লাস : জয়ের মুহূর্তে গুকেশ কেঁদে ফেলেছিলেন। এই কান্না ছিল আনন্দের, চাপ মুক্তির, এবং স্বপ্ন পূরণের। তার চোখে তখন ছিল সেই দীর্ঘ পথ চলার সমস্ত স্মৃতি—কঠোর পরিশ্রম, হাজারো অনুশীলন, এবং আত্মত্যাগ। এই জয় কেবল তার একার নয়, এটি গোটা দেশের।

গুকেশের জীবনের গল্প আমাদের একটাই শিক্ষা দেয়—স্বপ্ন দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ় সংকল্প আরো জরুরি।

১. লক্ষ্যে স্থির থাকুন: জীবনে চ্যালেঞ্জ আসবেই। কিন্তু সঠিক দিশায় এগিয়ে গেলে তা অতিক্রম করা সম্ভব।
২. পরিশ্রমই সাফল্যের মূলমন্ত্র: গুকেশ কখনো সহজ পথ বেছে নেননি। কঠোর অনুশীলনই তাকে আজ বিশ্বসেরা করেছে।
৩. নিজেকে প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যান: গুকেশ কখনো বর্তমান সাফল্যে থেমে থাকেননি। প্রতিটি জয়ে তিনি নিজেকে আরও উন্নত করেছেন।
৪. ধৈর্য এবং অধ্যবসায় বজায় রাখুন: দ্রুত সাফল্য পেতে চাওয়া মানসিকতার পরিবর্তে ধৈর্য ধরে কাজ করলে দীর্ঘমেয়াদে ফল আসে।

এক নতুন দিগন্ত : গুকেশ আজ কেবল দাবার রাজা নন; তিনি এক অনুপ্রেরণার প্রতীক। তার জীবনযাত্রা প্রমাণ করে, বয়স কোনো বাধা নয় যদি কারো মধ্যে সাহস, সংকল্প, এবং অনুশীলনের প্রতি ভালোবাসা থাকে।

বিশ্ব দাবার মঞ্চে গুকেশ আজ ভারতের পতাকা উঁচু করেছেন। তার কাহিনি কেবল দাবার নয়, এটি এক তরুণের স্বপ্ন দেখা এবং তা পূরণ করার গল্প। গুকেশ আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, যদি আপনি মাটিতে পা রেখে আকাশ স্পর্শ করতে চান, তবে সেই স্বপ্ন বাস্তব হতে বাধ্য।

“যেখানে লক্ষ্য থাকে আকাশ ছোঁয়া, সেখানেই জন্ম হয় এমন এক নক্ষত্রের, যারা দুনিয়ার সব হিসাব উলটে দিতে পারে। গুকেশ সেই তারকাদেরই একজন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *