পিনাকী রঞ্জন পাল : “জীবনের লক্ষ্য যদি স্পষ্ট হয়, তাহলে যেকোনো বাধাই অতিক্রম করা সম্ভব।”—এই কথাটিই সত্যি করে দেখিয়েছেন মেজর রাধিকা সেন।
সাধারণ এক শিক্ষকের মেয়ে থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গর্বিত অফিসার, তারপর জাতিসংঘের সম্মানিত শান্তিরক্ষী—এই পথটা সহজ ছিল না। কর্পোরেট দুনিয়ার মোহময় প্রলোভন উপেক্ষা করে, আরামদায়ক জীবন ছেড়ে, দেশের সেবার স্বপ্ন নিয়েই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। আর আজ তাঁর সেই সিদ্ধান্ত কেবল তাঁকে নয়, পুরো ভারতকে গর্বিত করেছে।
স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলা
হিমাচল প্রদেশের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম রাধিকার। বাবা ওঙ্কার সেন ছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক, মা নির্মলা সেন ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আর কঠোর পরিশ্রমের অভ্যাস তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছিল। আইআইটি বোম্বে থেকে বায়োটেক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করার পর বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা মোটা বেতনের চাকরির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল ভিন্ন—দেশের জন্য কিছু করা, মানুষের জন্য কাজ করা।
আরো পড়ুন : গোয়েন্দা গল্প : রাতের আড়ালে (ভিডিও সহ)
২০১৬ সালে তিনি সেনাবাহিনীর অফিসার পদে যোগ দেন, কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করেন। সেনাবাহিনীতে কাজের অভিজ্ঞতা তাঁকে কেবল শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও শক্তিশালী করে তোলে।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত কঙ্গোতে শান্তির দূত
ভারতীয় সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য হিসেবে রাধিকা শান্তিরক্ষা মিশনের অংশ হয়ে যান আফ্রিকার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ কঙ্গোতে। সেখানকার অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, মহিলাদের নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করা, শিশুদের শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া—এগুলোই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।
একের পর এক কঠিন চ্যালেঞ্জ আসে। কঙ্গোতে গৃহযুদ্ধের ফলে মহিলারা নির্যাতিত হচ্ছিলেন, শিশুদের শিক্ষার সুযোগ কমে যাচ্ছিল। এই অবস্থায় মেজর রাধিকা শুধুমাত্র একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে নয়, একজন মানবদরদী নেতা হিসেবে এগিয়ে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে স্থানীয় নারীদের আতঙ্কমুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়, শিশুশিক্ষার নতুন পথ তৈরি হয়।
বিশ্ব দরবারে ভারতের গৌরব
রাধিকার এই অসামান্য কাজ বিশ্ববাসীর নজর এড়ায়নি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য ২০২৪ সালে তাঁকে “মিলিটারি জেন্ডার অ্যাডভোকেট” পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। স্বয়ং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তাঁর হাতে এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার তুলে দেন এবং বলেন, “তিনি সত্যিকারের নেত্রী ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব।”
আরো পড়ুন : ভয়ের গল্প : শ্মশানের পিশাচ
এটি শুধু মেজর রাধিকা সেনের নয়, গোটা ভারতের জন্য এক গৌরবময় মুহূর্ত। একজন ভারতীয় নারী সেনা কর্মকর্তা বিশ্বের দরবারে নারী ক্ষমতায়নের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
নারী শক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
রাধিকা সেনের জীবন আমাদের শেখায় যে, যদি স্বপ্ন বড় হয় এবং সংকল্প দৃঢ় হয়, তবে কোনো বাধাই আপনাকে থামাতে পারবে না। কর্পোরেট চাকরির মোহময় লোভ এড়িয়ে, কঠোর পরিশ্রম আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন—সত্যিকারের সাফল্য কেবল টাকার অঙ্কে নয়, বরং মানুষের জন্য কিছু করার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে।
তাঁর এই সাফল্য শুধু সেনাবাহিনী নয়, সমস্ত তরুণ-তরুণীদের জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা। মেজর রাধিকা সেনের মতো প্রতিটি তরুণ-তরুণী যদি নিজের স্বপ্নকে সাহসের সঙ্গে অনুসরণ করে, তবে ভবিষ্যতের ভারত আরও সমৃদ্ধ হবে।
স্বপ্ন ছোঁয়া সত্যিই সহজ নয়, কিন্তু একবার যদি ছুঁতে পারেন, তবে বিশ্ব আপনাকে কুর্নিশ করবে!