পিনাকী রঞ্জন পাল
(এক)
প্রেমেখোঁচা নামক গ্রামটি শুনলেই মনে হয়, এখানে প্রেমিকদের জীবন বোধহয় করুণ। যেন প্রেমে খোঁচা খেতে খেতে তারা একেবারে বাঁশ হয়ে গেছে! কিন্তু আমাদের গল্প প্রেমেখোঁচার নাম নিয়ে নয়, গল্প সদাই আর তার অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে— মানে প্রেমে বিনিয়োগ সংকট।
সদাই, গ্রামের একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রেমিক, পাশের গ্রামের বুবলির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। বুবলি সুন্দরী— এমন সুন্দরী যে রোদে বেরোলে সূর্যেরও শঙ্কা হয়, আলো কমিয়ে না দেয়! চোখে মোটা করে কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, আর হাসলে মনে হয় গঙ্গার ধারে বসে এক কাপ লেবু চা খাচ্ছি— প্রাণ জুড়িয়ে যায়! সদাইয়ের প্রেমও সবে গজিয়ে উঠেছে— একেবারে ধনেপাতা সদ্য লাগানোর মতো, একটু যত্ন না নিলে শুকিয়ে যাবে!
কিন্তু সমস্যা একটাই— সদাইয়ের পকেট। সেটার অবস্থা একেবারে বাংলা সিনেমার দরিদ্র নায়ক— হাতে টাকা নেই, কপালে চিন্তার ভাঁজ! সদাই সরস্বতী পূজায় ঘুরতে গিয়ে এমন খরচ করেছে যে এখন তার পকেট গড়ের মাঠের মতোই ধু ধু – ফাঁকা! আর এখন সামনে ভ্যালেন্টাইন সপ্তাহ।
বুবলি সোজা জানিয়ে দিয়েছে— ভালোবাসার আটদিন, রোজ ডে থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে পর্যন্ত একটাও দিন মিস করা চলবে না! না এলে প্রেমে আড়ি! এদিকে কেষ্ট দা তো সুযোগের অপেক্ষায় আছে— সদাই যদি একদিনের জন্যও লাইনচ্যুত হয়, কেষ্ট দা এক লাফে বুবলির প্রেমের এক্সপ্রেসে উঠে পড়বে!
এখন, কেষ্ট’দার পরিচয়টা একটু খোলাসা করা দরকার। তিনি গ্রামের রোমান্স ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র নামকরা বিনিয়োগকারী— এক কথায়, “পকেট গরম রোমিও”।
সদাই বুঝতে পারল, এবারে কিছু একটা করতে হবেই। প্রেম মানে শুধু চোখে চোখ রাখা নয়, প্রেম মানে ব্যাঙ্ক ব্যালান্সও রাখা! নইলে প্রেম পাখি উড়ে গিয়ে অন্য কারও জানালায় বসবে। কিন্তু কী করবে সদাই?
(দুই)
সদাইয়ের সমস্যা ছিল গুরুতর। প্রেমের বাজারে টিকে থাকার জন্য চাই পুঁজি, আর তার পকেটের অবস্থা এমন যে, নামমাত্র শেয়ার মূল্যে লিস্টিংও সম্ভব নয়! হুট করেই মাথায় এল একটা অসাধারণ আইডিয়া— “ঋণ করো, প্রেম করো!”
কিন্তু তার এই অর্থনৈতিক নীতি চালু করতে গিয়ে বড় এক সমস্যা দেখা দিল— তাকে কেউ ধার দেবে না! গ্রামের মহাজন তো প্রেমের জন্য ধার দেওয়া তো দূরের কথা, বিনামূল্যে পরামর্শও দেবে না! বন্ধুরা সবাই গরিব, আর পরিবারের কাছে টাকা চাইলে তারা প্রেম ত্যাগ করে পরিশ্রমী হওয়ার উপদেশ দেবে।
এই সংকটের মাঝেই সদাইয়ের মাথায় ঝিলিক দিল সুবল খুড়োর কমলি ছাগল!
এ এমন এক ছাগল, যার স্বাস্থ্য দেখে অনেকের আত্মবিশ্বাস টলে যায়। এমনকি গ্রামের লোক বলাবলি করে, কমলিকে একবার বসিয়ে দিলে সে আর উঠতে চায় না, এমনকি তার জন্য বিশেষ ‘হ্যাঁচকা টান বাহিনী’ দরকার হয়! সদাই বুঝে গেল— এটাই তার মোক্ষ! কমলিকে বেচে দিলেই প্রেমের বাজেট ম্যানেজ হয়ে যাবে!
সিদ্ধান্ত নিয়েই সে ভোররাতে কমলির দড়ি খুলে চুপিচুপি হাঁটতে শুরু করল। উদ্দেশ্য, পাশের হাটে গিয়ে বেচে দেবে। কিন্তু সদাই একটা জিনিস হিসেবের বাইরে রেখেছিল—
সদাই ছাগলটাকে নিয়ে কিছুদূর যেতেই কমলি এমন চেঁচানো শুরু করল যে মনে হচ্ছে সদাই তাকে কোনো কসাইখানায় নিয়ে যাচ্ছে!
“ম্যা-এ-এ-এ-এ!!!”
সেই চিৎকারে গ্রামের ঘুমন্ত মানুষজনের ঘুম উড়ে গেল। সবাই ভাবল, এই তো মহাভারতের যুদ্ধ লেগে গেছে! কেউ ভাবল, ভূতপ্রেতের উৎপাত শুরু হয়েছে!
সদাই বলার চেষ্টা করল— “আরে ভাইসব, আমি তো প্রেমের জন্য অর্থনীতির নীতি প্রয়োগ করছি!”
কিন্তু গ্রামবাসীরা অর্থনীতি বোঝে না, বোঝে কেলেঙ্কারি।
“ছাগল চোর ধরা পড়েছে!”
ততক্ষণে সুবল খুড়ো জেগে গেছেন। তিনি বিছানা থেকে নেমে দেখলেন, কমলি নাই! তার হার্টবিট বেড়ে গেল। তিনি চিৎকার করে বললেন— “আমার কমলি কই? কে কমলিকে চুরি করল?”
ততক্ষণে গ্রামবাসীরা সদাইকে ধরে ফেলেছে। তার সামনে সুবল খুড়ো দাঁড়িয়ে। মুখ কেমন যেন কাঁচুমাচু করে ফেলেছে সদাই।
সুবল খুড়ো এক চোখ ছোট আরেক চোখ বড় করে বললেন— “সদাই, বল, কি করছিস?”
সদাই বলল, “খুড়ো, ছাগল তো শুধু ঘাস খায়, প্রেম তো আরো কিছু চায়!”
সুবল খুড়ো গম্ভীর হয়ে বললেন, “প্রেমের জন্য ছাগল চুরি? তোকে তো ভালো করে বাঁশ দিতে হবে দেখছি!”
সেই মুহূর্তে পুলিশ এসে হাজির! গ্রামের প্রথম ‘ছাগল অর্থনীতি কেলেঙ্কারি’ ধরা পড়েছে!
এদিকে বুবলি খবর পেয়েছে সদাই “ছাগল চুরি” মামলায় ধরা পড়েছে। সে হেসে বলল— “এতদিন ভাবছিলাম, তুমি প্রেমিক! এখন দেখছি, তুমি গো-চোরের ভাইপো, ছাগল চোর!”
সদাই বুঝতে পারল, প্রেমে বাজেট না থাকলে শুধু হৃদয়ই ভাঙে না— পুলিশের লাঠিও খেতে হয়!
(তিন)
সদাই থানায় বসে। মুখ শুকিয়ে গেছে। একদিকে প্রেমের বাজেট সংকট, অন্যদিকে পুলিশের গ্রিলড আলোচনায় নিজেকে যেন ইকোনমি ক্লাসের যাত্রী মনে হচ্ছে।
পুলিশ জিজ্ঞেস করল, — “ছাগল চুরি করলি কেন?”
সদাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, — “ভালোবাসার বাজেট ম্যানেজ করতেই বাধ্য হলাম, দাদা!”
পুলিশবাহিনী এমন জবাব শুনে প্রথমে চমকালো, তারপর নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করল — “এই প্রথম দেখলাম, প্রেমের জন্য ছাগল চুরির কেস! আগে তো মানুষ প্রেম করতে গিয়ে চিঠি লেখার জন্য কলম চুরি করত, কেউবা টাকা জোগাড়ের জন্য বাবার পকেট চেক করত, কিন্তু ছাগল! এই ছেলেটা সত্যিই ইউনিক!”
এরপর এক পুলিশবাবু গম্ভীরভাবে বলল, — “তোর প্রেম করতে ছাগল চুরি করতে হবে? মানুষ তো চাকরি করে, ব্যবসা করে, লেখাপড়া করে টাকা উপার্জন করে!”
সদাই গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, — “ওগুলো তো ধৈর্যশীল মানুষের কাজ, দাদা! প্রেমের বাজারে সময় বড় কম, প্রেমে তাড়া থাকলে ছাগলই ভরসা!”
পুলিশ শুনে থ! এমন অর্থনীতির থিওরি তো আগে কখনো শুনেনি! — “তুই তো দেখি জাত প্রেমবাজ!”
তারপর পুলিশের বড়বাবু এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত দিলেন, — “ঠিক আছে! শাস্তি হিসেবে তোকে তিনদিন থানায় প্রেম করার ছুটি দিচ্ছি!”
সদাই প্রথমে বুঝতেই পারল না। তারপর ধপ করে বসে পড়ল, — “দাদা! তিনদিন? তিনদিনে তো আমার প্রেমের স্টক এক্সচেঞ্জ পুরোপুরি ধসে পড়বে! ততদিনে বুবলি কেষ্ট’দার হয়ে যাবে!”
পুলিশের এক কনস্টেবল পাশ থেকে বলল, — “তুই যদি তিনদিন ধরে প্রেমের মাঠে না নামিস, তাহলে কেষ্ট দা’ই সত্যিকারের বিনিয়োগকারী হিসেবে লাভের মুখ দেখবে! প্রেমও তো একধরনের স্টার্টআপ, আর তোর স্টার্টআপ এখন চরম লোকসানে!”
সদাই মাথা নিচু করে গভীরভাবে ভাবল।
শেষে প্রেম বাঁচানোর একটাই উপায় দেখল— পুলিশের কাছে কাকুতি-মিনতি করা!
সদাই হাতজোড় করে বলল, — “দাদা, প্রেম করতে গেলে ভুল-ভ্রান্তি হয়, আমাকে মাফ করে দেন! ছাগল চুরি করব না!”
পুলিশবাহিনী এবার সত্যিই বিরক্ত হয়ে গেল।
— “ঠিক আছে! তোর প্রেমের জন্য তোকে ছেড়ে দিলাম! তবে ছাগল চুরি করিস না আর!”
সদাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু তার মাথার ভেতর তখনো ঘুরছে— “প্রেম চালাতে হলে টাকা লাগবেই! তবে কি এবার হাঁস মুরগী চুরি করব?”
শেষ