👉 ভারতে ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্ক আসতে চলেছে – কিন্তু এতে কি সত্যিই ইন্টারনেট পরিষেবায় বিপ্লব আসবে?
👉 স্টারলিঙ্ক কি জিও, এয়ারটেল এবং ভিআই-এর ব্যবসায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে?
👉 স্টারলিঙ্কের ইন্টারনেট কি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে, নাকি এটি কেবল শহুরে এবং উচ্চবিত্ত গ্রাহকদের জন্য সীমাবদ্ধ থাকবে?
👉 স্টারলিঙ্ক ব্যবহারের খরচ কত হতে পারে? সাধারণ ব্রডব্যান্ড বা মোবাইল ইন্টারনেটের তুলনায় স্টারলিঙ্ক কি সত্যিই সাশ্রয়ী হবে?
👉 স্টারলিঙ্ক গ্রাম ও দুর্গম অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবায় কি সত্যিই কোনো পরিবর্তন আনবে?
ডিজিটাল ডেস্ক : বর্তমানে ভারতে ইন্টারনেট পরিষেবার মূল ভরসা অপটিক্যাল ফাইবার, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ব্রডব্যান্ড সংযোগ। শহর ও শহরতলিতে এই পরিষেবাগুলি সহজলভ্য হলেও গ্রাম ও দুর্গম অঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট এখনো এক বড় চ্যালেঞ্জ। এর কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে-
1️⃣ পরিকাঠামোর অভাব – প্রত্যন্ত গ্রাম বা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ফাইবার অপটিক কেবল পৌঁছানো ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। অনেক জায়গায় এখনো মোবাইল টাওয়ারের অভাব রয়েছে, ফলে ইন্টারনেটের গতি খুব কম বা একেবারে অনুপস্থিত।
2️⃣ জনসংখ্যার ঘনত্ব কম – টেলিকম সংস্থাগুলো সাধারণত বেশি মানুষের বসবাস যেখানে, সেখানে ফাইবার ও ব্রডব্যান্ড পরিষেবা দেয়। দুর্গম অঞ্চলে কম গ্রাহকের জন্য সংস্থাগুলোর ব্যবসায়িক লাভ কমে যায়, ফলে তারা তেমন বিনিয়োগ করতে চায় না।
3️⃣ পরিবেশগত বাধা – ঘন জঙ্গল, পাহাড় বা দ্বীপ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ব্রডব্যান্ড সংযোগ সহজে কাজ করে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বৃষ্টি বা ঝড়ের সময় অনেক এলাকায় ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
4️⃣ উচ্চমূল্য ও সীমিত পরিষেবা – যেখানে ব্রডব্যান্ড বা অপটিক্যাল ফাইবার নেই, সেখানে মানুষকে মোবাইল ইন্টারনেটের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে এই পরিষেবার গতি কম এবং খরচ তুলনামূলক বেশি হয়। এছাড়া কিছু এলাকায় নির্দিষ্ট সময়ের পর ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল হয়ে যায়।
এবার জেনে নিন স্টারলিঙ্ক কী?
স্টারলিঙ্ক হল এক ধরনের উপগ্রহ (স্যাটেলাইট) ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা, যা টাওয়ার বা ফাইবার অপটিক কেবলের ওপর নির্ভরশীল নয়। এটি ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্স (SpaceX) দ্বারা পরিচালিত একটি প্রকল্প। স্টারলিঙ্কের প্রধান লক্ষ্য হল বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, দ্বীপাঞ্চল এবং এমনকি সমুদ্রের মাঝখানে বসবাসকারী মানুষদের কাছে দ্রুত ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে দেওয়া।
স্টারলিঙ্কের পরিষেবাটি কাজ করে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে (Low Earth Orbit বা LEO) স্থাপিত অসংখ্য ক্ষুদ্র উপগ্রহের (স্যাটেলাইট) মাধ্যমে। এই উপগ্রহগুলির মাধ্যমে সরাসরি গ্রাহকের বাড়িতে বিশেষ ধরনের রিসিভার বা অ্যান্টেনার মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ সরবরাহ করা হয়। যেহেতু এটি ফাইবার অপটিক কেবলের মতো স্থলভিত্তিক অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল নয়, তাই শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম, দুর্গম পাহাড়, জঙ্গল বা দ্বীপ—যে কোনো স্থানে সহজেই ইন্টারনেট পরিষেবা পাওয়া সম্ভব।
স্টারলিঙ্কের উপগ্রহগুলি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার উপরে অবস্থান করে এবং অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। এর ফলে গ্রাহকরা কম ল্যাটেন্সি (অর্থাৎ, তথ্য আদান-প্রদান করতে কম সময়) এবং উচ্চ গতির ইন্টারনেট সংযোগ উপভোগ করতে পারেন।
স্টারলিঙ্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ পেতে গ্রাহককে একটি স্টারলিঙ্ক কিট (যার মধ্যে অ্যান্টেনা, রাউটার এবং পাওয়ার কেবল থাকে) কিনতে হয়। এটি সংযোগ করার পর অ্যান্টেনাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিকটবর্তী স্টারলিঙ্ক উপগ্রহের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এবং গ্রাহকের জন্য ইন্টারনেট সংযোগ সক্রিয় করে।
এ কথাটা সকলেই ইতিমধ্যে জেনে গেছেন যে স্টার লিংকের সাথে রিলায়েন্স জিও এবং ভারতী এয়ারটেলের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বর্তমানে সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে স্টারলিঙ্ক। টেলিকম মন্ত্রকের ছাড়পত্র পেলেই ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিষেবা শুরু করবে তারা। যদিও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব একবার স্টারলিঙ্ককে স্বাগত জানিয়ে পোস্ট করেছিলেন, পরে তা মুছে দেওয়া হয়। তাই এখনও পরিষেবার সঠিক তারিখ নিশ্চিত নয়।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল – স্টারলিংকের খরচ কত পড়বে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্টারলিঙ্কের মূল্য ভিন্ন ভিন্ন। যেমন – ভুটানে মাসিক রেসিডেন্সিয়াল লাইট প্ল্যান: ₹৩,০০০ (২৩-১০০ Mbps গতি), আর মাসিক স্ট্যান্ডার্ড প্ল্যান: ₹৪,২০০ (২৫-১১০ Mbps গতি), জাম্বিয়ায় খরচ: ₹২,০০০, মালয়েশিয়ায় খরচ: ₹৩,৮০০, অস্ট্রেলিয়ায় খরচ: ₹৭,৮০০, আমেরিকায় খরচ: ₹৭,০০০
বর্তমানে, ভারতে রিলায়েন্স জিয়ো এয়ারফাইবারের মাধ্যমে ৫জি (5G) ব্রডব্যান্ড পরিষেবা প্রদান করে। জিয়ো এয়ারফাইবার (Jio AirFiber)-র প্ল্যান শুরু ৫৯৯ টাকা থেকে। সেখানে এয়ারটেলের ৫জি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের স্টার্টিং প্ল্যান ৬৯৯ টাকা থেকে। এতে প্রতি মাসে ৪০ এমবিপিএস গতিতে ইন্টারনেট পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, স্টার লিংক আসার ফলে দেশে ইন্টারনেট খরচ ১০ থেকে ১৪ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে স্টারলিঙ্কের মাসিক খরচ হতে পারে ₹৩,৫০০ থেকে ₹৪,৫০০। তার ওপর ডিশ ও রাউটারের জন্য এককালীন ₹২৫,০০০ – ₹৩৫,০০০ খরচ লাগতে পারে। যা তুলনামূলকভাবে, Jio AirFiber বা Airtel 5G ব্রডব্যান্ডের মাসিক খরচ ₹৫৯৯ – ₹৬৯৯।
তাই স্টারলিঙ্কের দাম সাধারণ গ্রাহকদের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। যদিও ভারতে এখনও স্টারলিঙ্কের প্ল্যানের দাম জানানো হয়নি।
তাই মনে করা হচ্ছে স্টার লিংক ভারতে এলেও ইন্টারনেট পরিষেবা সাশ্রয়ী হবে না বা জিও, এয়ারটেল বা ভিআই এর ব্যবসায় তেমন প্রভাব পড়বে না, যদিনা স্টার লিংক এদের মতো প্ল্যান না নিয়ে আসে, যদিও সেই সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থাৎ ভারতে সফল হতে গেলে স্টারলিঙ্ক কে প্রতিযোগিতামূলক দামে পরিষেবা দিতে হবে, তবেই এটি গ্রামীণ ডিজিটাল সংযোগে বিপ্লব আনতে পারে। নয়তো, উচ্চমূল্যের কারণে এটি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলে, কেবল কর্পোরেট ও সরকারি সংস্থাগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। বা দেখনদারির জন্য কিছু মানুষ এর পরিষেবা নিতে পারেন।
বস্তুত স্টারলিংক কে নিয়ে যতটা মাতামাতি করা হচ্ছে তেমন খুব একটা উপকৃত হবেন না ভারতের সাধারণ মানুষ। কারন মাসিক 500 টাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা দিতে পারবে না স্টারলিংক। আর এদেশের গ্রামীন বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের কতজন মানুষের পক্ষে মাসে 4/5 হাজার টাকা করে খরচ করার সামর্থ্য রয়েছে ইন্টারনেটের জন্য খরচ করার। তাই স্টারলিংক ভারতে এলেও এটি কেবল ধনী বা শহুরে গ্রাহকদের পরিষেবা হয়ে থাকে, নাকি সবার জন্য অ্যাক্সেসযোগ্য হবে— সেটিই এখন দেখার বিষয়।