IPL 2025 : ভিগ্নেশ পুথুর – অভিষেকেই তোলপাড় ফেলে দিল অটো চালকের ছেলে

পিনাকী রঞ্জন পাল : স্বপ্ন দেখতে জানলেই একদিন বাস্তবেও তা ধরা দেয়— কথাটা হয়তো শুনতে সহজ লাগে, কিন্তু বাস্তব জীবনে তা সত্যি করতে লাগে কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা আর অসীম ধৈর্য। কেরালার মালাপ্পুরমের ছোট্ট শহর পেরিনথালমান্নার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া ভিগ্নেশ পুথুরের গল্প সেই বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। বাবা পেশায় অটোচালক, মা গৃহবধূ। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা ছিল অটুট। সেই ভালোবাসাই একদিন তাকে পৌঁছে দিল ভারতের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট লিগ আইপিএলে— যেখানে হাজারো তারকার মাঝে নিজের আলাদা জায়গা করে নিলেন এই তরুণ স্পিনার।

ছোটবেলায় যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করেন, তখন ভিগ্নেশ ছিলেন একজন মিডিয়াম পেসার। তবে তার বোলিংয়ে বিশেষ গতি ছিল না। স্থানীয় কোচ মহম্মদ শেরিফ একদিন বললেন, “তুই স্পিন করতে পারবি, চেষ্টা করে দেখ।” সে সময় ‘চায়নাম্যান’ বোলিং কী, তা জানতেনই না ভিগ্নেশ। কিন্তু শেখার আগ্রহ ছিল প্রবল। শুরু হলো নতুন অধ্যায়— বাঁহাতি চায়নাম্যান স্পিনার হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম।

কেরালার অনূর্ধ্ব-১৪ ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা পেলেও, বড় মঞ্চে খেলার সুযোগ এল না। অথচ তিনি জানতেন, নিজের মধ্যে প্রতিভা আছে, যা হয়তো একদিন বড় মঞ্চে ঝলসে উঠবে। ত্রিশূরে চলে যান ক্রিকেট শেখার জন্য, যোগ দেন সেন্ট থমাস কলেজের দলে। সেখান থেকে সুযোগ আসে কেরালা কলেজ প্রিমিয়ার লিগে। ধাপে ধাপে এগোলেন তিনি— জলি রোভার্স ক্রিকেট ক্লাব, তারপর কেরালা প্রিমিয়ার লিগের দল আলেপ্পি রিপলস। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি। পরিশ্রম চালিয়ে গেছেন, কারণ জানতেন, “সুযোগ আসবেই, শুধু লেগে থাকতে হবে!”

কেরালা প্রিমিয়ার লিগে যখন খেলছিলেন, তখনই নজরে পড়েন মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের স্কাউটদের। ম্যাচে তিনটি উইকেট নিয়েছিলেন, তবু তা যথেষ্ট ছিল না। এরপর ট্রায়ালের ডাক এলো, যেখানে মুম্বইয়ের তারকা ক্রিকেটারদের বল করার সুযোগ পেলেন। স্কাউটরা বুঝে গেল, এই তরুণের মধ্যে কিছু একটা আছে— মেগা নিলামে ৩০ লাখ টাকায় দলে নিয়ে নেয় মুম্বই ইন্ডিয়ান্স।

নিলামে বিক্রি হওয়া আর মাঠে সুযোগ পাওয়া এক জিনিস নয়। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স তাকে সঙ্গে রাখলেও, হুট করে একাদশে সুযোগ দিতে চাইছিল না। তাই তাকে দক্ষিণ আফ্রিকায় MI কেপ টাউনের নেট বোলার হিসেবে পাঠানো হয়, সেখানে সিনিয়রদের সঙ্গে অনুশীলনের সুযোগ পান। কিন্তু মাঠে নামার দিন কবে আসবে, সে ছিল অনিশ্চিত।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে ম্যাচে ভিগ্নেশকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে নামায় মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। প্রথম বলেই নেমে আইপিএলের অন্যতম সেরা ব্যাটার ঋতুরাজ গায়কোয়াড়ের উইকেট তুলে নেন। তারপর শিবম দুবে, দীপক হুডাকেও ফিরিয়ে দেন। প্রথম ম্যাচেই ৪ ওভারে ৩২ রান দিয়ে তুলে নেন ৩টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট!

একটি ভালো ম্যাচ বা আইপিএলে একবার আলোচনায় আসা হয়তো সহজ, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে নিজেকে প্রমাণ করা কঠিন। ভিগ্নেশ জানেন, এই একটা ম্যাচ তাকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দিতে পারে, আবার এক ভুলেই সব কিছু শেষ হয়ে যেতে পারে।

তবু তিনি হার মানতে রাজি নন। কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে যে জায়গায় এসেছেন, সেটা ধরে রাখার জন্য আরও দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হবে। “এখনও অনেক কিছু প্রমাণ করার বাকি,” বলেন ভিগ্নেশ।

ভিগ্নেশের জীবনের গল্প আমাদের শেখায়, জীবনে সুযোগ কম পেলেও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। দারিদ্র্য, সুযোগের অভাব, প্রতিকূল পরিস্থিতি— সবকিছুই ছিল তার বিরুদ্ধে, কিন্তু হাল ছাড়েননি। তিনি বিশ্বাস রেখেছেন নিজের দক্ষতায়, নিজেকে বদলেছেন, নতুন নতুন শিখেছেন এবং প্রতিদিন নিজের উন্নতি করার চেষ্টা করেছেন।

আজকের ভিগ্নেশ শুধু একজন তরুণ ক্রিকেটার নন, তিনি পরিশ্রম, ধৈর্য আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। তাঁর গল্প বলে— তুমি যদি স্বপ্ন দেখার সাহস করো, তাহলে একদিন সেই স্বপ্নই তোমাকে তোমার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে!


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *