পিনাকী রঞ্জন পাল
রাজস্থান সীমান্তের অভিশপ্ত রাজবাড়ি, এক মৃত্যুকূপ, আর রানী অম্বিকার অমরত্বের ভয়ংকর সাধনা—রুদ্রের শেষ প্রতিরোধ কি সফল হবে? নাকি সে-ও পরিণত হবে অন্ধকারের ছায়ায়? পড়ুন এখনই!
অধ্যায় ১: আমন্ত্রণ
কলকাতার অরণ্যপথের ধারে থাকা আধুনিক ফ্ল্যাটে বসে রুদ্র সেন তখন নতুন একটি সিনেমার চিত্রনাট্য নিয়ে ভাবনায় ডুবে। বহু পুরস্কারজয়ী এই চিত্রপরিচালক বহু থ্রিলার, সাইকোলজিক্যাল ড্রামা বানিয়েছেন, কিন্তু এখন যেন কোনও বিষয়ই তাকে আকর্ষণ করছে না। তার মনে হয়, সবই একঘেয়ে—নতুন কিছু নেই।
ঠিক সেই সময়ই আসে একটি পুরনো ধাঁচের, হাতে লেখা আমন্ত্রণপত্র। কাগজটা ঘন, হলুদাভ—যেন বহুদিন ধরে রাখা। খাম খোলার পরই ভেসে আসে একটা গন্ধ—পুরনো কাগজের সঙ্গে মিশে থাকা কেমন একটা ধূপের ধোঁয়ার মত গন্ধ। সেই আমন্ত্রণপত্রে লেখা:
“শ্রী রুদ্র সেনের প্রতি,
আপনাকে আমাদের পারিবারিক রাজবাড়ির নবনির্মাণ অনুষ্ঠানে স্বাগত জানাই।
স্থান: রাজস্থান সীমান্তের মীরনগরের প্রাচীন সেন রাজবাড়ি
তারিখ: ২২শে জানুয়ারি
আমন্ত্রণকারী: নবীন সেন
(বর্তমান উত্তরাধিকারী)”
রুদ্র থমকে যায়। নবীন সেন? চেনা নাম নয়। তবে মীরনগরের সেন রাজবাড়ি নামটা যেন কানে লেগে থাকে। একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় তার মেরুদণ্ড বেয়ে।
ছোটবেলায়, তার বাবা রত্নেশ সেন, প্রায়ই তাকে গল্প শোনাতেন—এক পোড়ো রাজবাড়ি নিয়ে, যেখানে কেউ একবার ঢুকলে আর ফিরে আসত না। সেই রাজবাড়ির নাম কখনও স্পষ্ট করে বলতেন না, তবে বলতেন, “ওটা এক অভিশপ্ত জায়গা… আমাদের বংশের কারও কিছু অধিকার আছে ওখানে… কিন্তু ফিরে যাস না, রুদ্র!”
তখন সে হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু আজ, সেইসব কথাগুলো কেমন জীবন্ত হয়ে উঠছে। সে আমন্ত্রণপত্র বারবার পড়ে, যেন তার ভিতর লুকোনো কোনও রহস্যের ছায়া খুঁজে পেতে চায়।
স্ত্রী কৃতিকা, একজন শিল্পকলা গবেষক, যখন শুনল রুদ্র এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে চায়, সে প্রতিবাদ করে।
— “তুমি পাগল নাকি? কোথাকার কোন রাজবাড়ি! সেই সব কুসংস্কারপ্রবণ জায়গায় গিয়ে কী করবে? আজকাল কেউ পুরনো রাজবাড়ির পুনরুজ্জীবনের অনুষ্ঠানে যায়?”
কিন্তু রুদ্রের ভেতরে যেন এক অদ্ভুত টান তৈরি হয়। মনে হয়, এই জায়গার সঙ্গে তার কোনও গভীর সম্পর্ক আছে, যেন এই আমন্ত্রণ কেবল পত্র নয় — একটা এমন ডাক, যাকে উপেক্ষা করা যায় না।
দুদিন পর, ঠান্ডা এক সকালে, স্ত্রী ও বন্ধুদের নিষেধ সত্ত্বেও, রুদ্র একাই রওনা দেয়। গন্তব্য — রাজস্থান সীমান্তের সেই বিস্মৃত জনপদ, মীরনগর।
ট্রেন থেকে নামার পর সে জিপে চড়ে পৌঁছায় ধুলোমাখা রাস্তায় ঘেরা, প্রাচীন ইতিহাসে মোড়ানো সেই জায়গায়। মীরনগর, যেখানে কেউ আসে না, কেউ যেতে চায় না।
অধ্যায় ২: রাজবাড়ির প্রথম রাত
রুদ্র সেনের চোখের সামনে যখন মীরনগরের রাজবাড়ি প্রথম ফুটে ওঠে, তখন সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে। সোনালি আলোয় রাজবাড়ির গা-ছোঁয়া দেয়ালগুলো যেন লালচে রঙে জ্বলে উঠছিল। বিশাল লোহার গেট, দু’পাশে ধ্বংসপ্রায় পাথরের সিংহমূর্তি। প্রবেশপথের দু’পাশে শেওলা-ধরা প্রাচীন পাথরের দেয়াল যেন ইতিহাসের বোবা সাক্ষী। গেটের ঠিক ওপরে খোদাই করা: “সিংহদ্বার – ১৭৮১”।
রাজবাড়ির উঠোন পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সময় রুদ্র যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া অনুভব করে — নির্দিষ্টভাবে বুকের মাঝখানে আছড়ে পড়ল সেটা। তার চারপাশে ছায়া ঘনিয়ে আসছিল, কিন্তু রাজবাড়ির দরজা ছিল উন্মুক্ত, যেন আগেই জেনে রাখা হয়েছিল তার আগমনের সময়।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নবীন সেন, পরনে সাদা কুর্তা-পাজামা, কাঁধে একটি হালকা চাদর। বয়সে রুদ্রের চেয়ে ছোট হলেও চোখে-মুখে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস, এবং এমন এক হাসি, যেন সে কিছু জানে — আর রুদ্র জানে না।
“স্বাগতম, রুদ্রবাবু। অবশেষে আপনি এলেন,” নবীন বলল।
রুদ্র কৌতূহলীভাবে জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা তো আগে কখনও দেখা করিনি, তাই না?”
নবীনের চোখে সেই রহস্যময় ঝিলিক, “হয়তো এই জন্মে নয়। কিন্তু এই বাড়ির ইতিহাসে আপনি আছেন— আপনাকে ছাড়া একে জাগানো সম্ভব নয়।”
রুদ্র প্রশ্ন করার আগেই, নবীন তাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়।
বাইরের জরাজীর্ণতা দেখে যেমনটা ভাবা গিয়েছিল, তার বিপরীত এক দৃশ্য অপেক্ষা করছিল ভেতরে। বিশাল হলঘর, স্ফটিকের ঝাড়বাতিতে আলো ঠিকরে পড়ছে রাজকীয় আসবাবপত্রে। দেয়ালজুড়ে প্রাচীন তৈলচিত্র, কিছু রাজাদের, কিছু রমণীর— তবে বেশিরভাগের চোখে অদ্ভুত আতঙ্ক কিংবা হিংস্রতা। ঘরের মাঝখানে একটি বিশাল, কাঠের তৈরি সোফাসেট, যার পশমে হাত ছোঁয়ালে মনে হয় যেন কোনো জীবন্ত প্রাণীর গায়ে হাত দেওয়া হয়েছে।
দূর থেকে বাজনা শোনা যায় —হারমোনিয়ামের মতো শব্দ, অথচ কেউ বাজাচ্ছে না। নবীন নির্বিকার।
রাত্রিভোজের জন্য রুদ্রকে ডাইনিং হলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও এক অদ্ভুত নিঃশব্দতা— সার্ভ করার জন্য কর্মচারী রয়েছে, অথচ তারা কেউ কথা বলে না, এমনকি চোখেও কিছু নেই। যেন তারা জীবন্ত মানুষ নয়, কোনো নাটকের পুতুল।
রুদ্র খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে, “এই বাড়ি এত পুরনো, অথচ রক্ষণাবেক্ষণ এত নিখুঁত…আপনারা তো এখানে অনেক লোক রাখেন দেখছি?”
নবীন হেসে বলল, “এই বাড়ি নিজেই নিজেকে রক্ষা করে, রুদ্রবাবু। আপনি শুধু দেখুন, শুনুন, অনুভব করুন।”
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ রুদ্রকে একটি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। ঘরটি অনেক বড়, প্রাচীন রাজকীয় শয্যা, লাল পর্দা, কাঠের মেঝে— যার প্রতিটি হাঁটার শব্দে যেন দেয়ালগুলো কেঁপে ওঠে।
ঘরে ঢুকে রুদ্র প্রথম যেটা লক্ষ্য করে, তা হল পশ্চিমদিকের দেয়ালে ঝোলানো একটি বিশাল পোর্ট্রেট। একজন নারী, বয়স হয়তো চল্লিশের কোঠায়, গায়ে ভারী গয়নাগাটি, রাজকীয় পোশাক। কিন্তু তার মুখে কোনো কোমলতা নেই। ঠোঁট সামান্য বাঁকা, চোখ দু’টি অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ—হিংস্র যেন, অথচ গভীর।
পোর্ট্রেটের নিচে খোদাই করে লেখা: “রাণী অম্বিকা, ১৭৯৪”
রুদ্র চমকে ওঠে। এই নাম সে আগে শুনেছে— বাবার কাছে।
“রাণী অম্বিকা, যার অভিশাপে একবার এই বাড়ির সবাই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।”
হঠাৎ পেছনে জানালা খটাস করে বন্ধ হয়ে যায়। রুদ্র ঘুরে তাকায়, জানালায় কিছু নেই—কিন্তু ঘরের তাপমাত্রা হঠাৎ অনেকটা কমে গেছে। ঘর যেন কেঁপে উঠছে নিঃশব্দে। ঘড়ির কাঁটা তখন এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে—রাত এগিয়ে আসছে, সেই সঙ্গে… অন্য কিছু।
রুদ্র বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে, কিন্তু ঘুম আসে না। পোর্ট্রেটের দৃষ্টি যেন চোঁখে বিঁধে রয়েছে তার। বাতাসে মৃদু ফিসফিস শব্দ, যেন কেউ নিচু গলায় ডাকছে— কিন্তু কোথা থেকে?
রুদ্র উঠে বসে। বাইরে তাকিয়ে দেখে রাজবাড়ির বাগানে যেন একটা সাদা ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে। আর তখনই তার মনে পড়ে যায় নবীনের বলা কথাটি— “অনেক সময় অতিথিরা অম্বিকার ছায়া দেখতে পান…”
রুদ্র জানে না, সে এখনো স্বপ্নে আছে, না বাস্তবের দ্বার খুলে গেছে।
অধ্যায় ৩: আয়নায় নয়, ছায়ায়
রুদ্র ভোরে ঘুম থেকে উঠে বুঝতেই পারল না— সে আদৌ ঘুমিয়েছিল কি না। চোখে জ্বালা, মাথায় ভার, আর এক অজানা আতঙ্ক বুক চেপে ধরে আছে।
ঘরের ভেতর সূর্যের আলো এসে পড়লেও সেই আলো যেন কোনও উষ্ণতা দেয় না। দেয়ালের রং বিবর্ণ, কাঠের মেঝে আরও বেশি ঠান্ডা। রুদ্র জানে, কিছু একটা ছিল রাতে… সে দেখেছিল একটা সাদা ছায়া বাগানে। কিন্তু কী সেটা?
সে উঠে ঘরটা খুঁটিয়ে দেখে। দেয়ালের পুরনো ফাটলে শেওলা জমেছে, মেঝেতে কোথাও কোথাও দাগ, যা যেন কারো পায়ের ছাপ—কিন্তু উল্টো দিকে। পায়ের ছাপগুলো দরজা থেকে বিছানার দিকে এসেছে, কিন্তু গেছে কোথাও নয়।
তার চোখ আটকে গেল আয়নার দিকে। ঘরের এক কোণে একটা প্রাচীন আয়না। কাঠের ফ্রেমে খোদাই করা লতা- পাতার নকশা, আর মাঝখানে একটি নাম—”জয়রাম কাঠুয়া, ১৭৯১”।
রুদ্র আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু আয়নায় নিজেকে দেখতে পায় না। না, সম্পূর্ণ অদৃশ্য নয়— তার অবয়ব আছে, কিন্তু চোখের অংশটুকু যেন অস্পষ্ট, ঝাপসা।
সে পেছনে ঘুরে দেখে— সব কিছু ঠিকঠাক। আবার আয়নায় দেখে— তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে!
একটা আবছা সাদা ছায়া, লম্বা চুল, সাদা শাড়ি, গলায় সোনালি হার। চোখ নেই, শুধু দুটি কালো গহ্বর। সে ভয় পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়— কেউ নেই।
আবার আয়নায় তাকায়— ছায়া নেই। এইবার সে আয়নার পেছনে তাকায়, কিছু লেখা আছে সেখানে, এক ধরনের অদ্ভুত হস্তাক্ষরে: “সে ফিরে আসে, আয়নায় নয়… ছায়ায়।”
রুদ্র আয়নার নিচে কিছু খোঁজ করতে গিয়ে দেখতে পায় আয়নার কাঠের ফ্রেমে কিছু আঁচড়ের দাগ— যেন কেউ নখ দিয়ে খুঁচিয়ে দিচ্ছিল বারবার। তার মনে হয়, কেউ হয়তো আয়নার ভেতরেই বন্দি।
রুদ্র যখন স্নানঘরে যায়, আয়নাটির কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু স্নানঘরে ঢুকতেই সে টের পায়— পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছে।
সে ধীরে ধীরে ঘাড় ঘোরায়। একটা ছায়া যেন আয়নার ওপর ভেসে আছে। আয়না ঘোলা, কিন্তু তার ভেতরে একটা মুখ— অস্পষ্ট, কিন্তু ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। এইবার সে স্পষ্ট দেখতে পায় মুখটি— এটি রাণী অম্বিকার মুখ।
রুদ্র চিৎকার করে উঠে পেছনে ধাক্কা খায়, তার পায়ের নিচে সাবান পড়ে গিয়ে সে পড়ে যায়। মাথা ঠেকে দেয়ালে, কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
জ্ঞান ফিরে পেলে, সে দেখে নবীন তার পাশে বসে। নবীন যেন একটুও অবাক নয়, যেন এটা স্বাভাবিক। “আপনি আয়নাটির ভেতরে তাকে দেখেছেন, তাই না?” নবীন জিজ্ঞেস করে।
রুদ্র স্তব্ধ।
নবীন বলল, “রাণী অম্বিকা মৃত্যুর আগের রাত পর্যন্ত নিজের ঘরের এই আয়নাটির সামনে সময় কাটাতেন। ওটাই ছিল তার শেষ আত্মরক্ষার জায়গা। কেউ বলে, মৃত্যুর পরও তার আত্মা ওই আয়নার ছায়ার সঙ্গে মিশে গেছে।”
“কিন্তু ছায়া তো আয়নার বাইরে… সেটা কিভাবে সম্ভব?”—রুদ্র ফিসফিস করে।
নবীন মাথা নিচু করে বলল, “কারণ রাণীর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করা হয়েছিল, তার প্রিয় আয়নার সামনে। সে আয়নাকে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলেন, ‘আমার ছায়া থাকবে, আমি আয়নায় নয়, অন্যদের ছায়ায় ফিরে আসব।’ তাই এই আয়না শুধু প্রতিফলন নয়— এটি এক দরজা। ছায়ার দুনিয়ার দরজা।”
সন্ধের পর, রাজবাড়ির পরিবেশ আরও ভারী হয়ে ওঠে। বাতাসে ভেসে আসে এক অদ্ভুত গন্ধ— চন্দনের সঙ্গে মিশে থাকা ধূপের, যেন পূজার ঘর থেকে আসছে। অথচ রাজবাড়িতে কোনও পূজার আয়োজন হয়নি।
রুদ্র বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে, দূরে বাগানের এক কোণে একটি ছোট মন্দির আছে, যার দরজা ভাঙা, আর সামনে ছায়া নড়ছে। সে নিশ্চিত সেখানে কেউ আছে।
তার মন বলছে, এগিয়ে যাও— যদিও শরীর বলছে, পেছনে ফিরে ঘরে ফিরে যা। এই দ্বিধার মাঝেই সে দেখতে পায়… তার ছায়াটা মাটি থেকে একটু ওপরে উঠছে। সে একপা পিছিয়ে আসে—কিন্তু ছায়া স্থির থাকে।
রাত্রি গভীর। রুদ্র শুয়ে আছে, কিন্তু ঘুমাচ্ছে না। বিছানার একপাশে রাখা আয়নাটির কাপড় সরে গেছে। আয়নায় তার ছায়া নেই। সে উঠে দাঁড়ায়— দেখে, দেয়ালের কোণে দাঁড়িয়ে আছে রাণী অম্বিকার ছায়া।
এইবার সে মুখ খুলে বলে— “রুদ্র, তুমি এসেছ। এবার সত্য জানতে হবে। তুমি আমার রক্তের উত্তরাধিকার। তুমি ছাড়া কেউ পারবে না এই বাড়িকে মুক্ত করতে। কিন্তু তার আগে… আমাকে বুঝতে হবে, তুমি বিশ্বাসঘাতক নও।”
ঘরের সব আলো নিভে যায়। আলো নেই। আয়না নেই। শুধু একটাই আছে—ছায়া।
অধ্যায় ৪: মৃত্যুকূপ
সকালের রোদ মীরনগরের রাজবাড়ির সিঁড়ির ধাপে ধাপে ধীরে ধীরে নেমে আসছে। পাথরের দেয়ালে ছায়া যেন হেলে পড়ে আছে, আর প্রতিটি করিডোরের মোড় যেন কিছু একটা গোপন করছে।
রুদ্র ধীরে ধীরে রাজবাড়ির ভেতরটা ঘুরে দেখছিল। তার মন এখনও রাতে দেখা ছায়ার ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। তবুও ভেতরের কৌতূহল তাকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করছিল।
একটা দীর্ঘ বারান্দা পেরিয়ে, সে পৌঁছে গেল পেছনের দিকে। সেখানে আর কেউ নেই। হঠাৎই চোখে পড়ল এক বিশাল ইট-বাঁধানো কূপ— বাড়ির অন্য অংশগুলোর তুলনায় এই জায়গাটা যেন আলাদা। কূপের মুখ লোহার মোটা জাল দিয়ে ঢাকা, আর তার চারপাশে ঘাস জন্মেছে বুনোভাবে, কেমন যেন পরিত্যক্ত।
কূপটা দেখে অজানা এক হিমশীতল অনুভূতি বুকের মধ্যে ছড়িয়ে গেল রুদ্রর। মনে হলো যেন কেউ এই জায়গাটাকে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে রেখেছে সবকিছু থেকে। যেন এই কূপ শুধুমাত্র ‘দেখার’ জন্য নয়— এর অস্তিত্বই ভয়াবহ।
তবে কৌতূহল দমন করতে পারেনি রুদ্র। সে ধীরে ধীরে কূপের কাছে এগিয়ে গেল।
ঠিক তখনই পেছন থেকে একটি কর্কশ কন্ঠস্বর শোনা গেল, “ওটা বন্ধ রাখাই ভাল, বাবু।”
চমকে ফিরে তাকাল রুদ্র। রাজবাড়ির কেয়ারটেকার দাঁড়িয়ে, তার মুখে একটা চাপা ভীতির ছাপ। “আপনি যদি বাঁচতে চান, কূপটায় নজর না দেওয়াই ভাল।”
রুদ্র বিস্মিত হয়ে বলল, “কেন? এটা তো কেবল একটা কূপ – জল তোলার জন্য?”
কেয়ারটেকার মুখ নামিয়ে বলল, “আগে কেউ একজন সেখানে পড়ে গেছিল, প্রায় কুড়ি বছর আগে। খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু শেষে শুধু কিছু হাড় পাওয়া গেছে। কঙ্কাল। আর তার পর থেকে কূপটা তালাবন্দি।”
রুদ্র একটু নড়ে উঠল, “আপনারা পুলিশে জানিয়েছিলেন?”
“চেষ্টাও করিনি, বাবু,” কেয়ারটেকার বলল চাপা গলায়। “কারণ ওটা… রানীর কূপ।”
ঠিক সেই মুহূর্তেই নবীন এসে উপস্থিত হল। আজ তার মুখে হাসি নেই, বরং গম্ভীরতা, “আচ্ছা, আপনি এইটুকু জেনেই ফেললেন,” নবীন বলল। “ওটা রানী অম্বিকার ব্যক্তিগত কূপ ছিল। কেউ জানে না তিনি ঠিক কী করতেন এখানে। তবে প্রতিদিন তিনি একাই আসতেন, কূপে কিছু একটা ফেলতেন। কেউ তাকে জিজ্ঞেস করার সাহস করেনি। সেই সময়কার দাস-দাসীরা শুধু বলত, রানী যখন কূপ থেকে ফিরতেন, তার চোখে থাকত অদ্ভুত আলো। আর গায়ে থাকত এক ধরনের গন্ধ— ধূপ আর পচনের মিশ্র গন্ধ।”
রুদ্র প্রশ্ন করল, “আপনি জানেন না তিনি কী ফেলতেন?”
নবীন মাথা নাড়ল, “না। কেবল একটা কথা শোনা যায়—রানীর কালো সাধনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই কূপ। বলা হয়, সেখানে আত্মা বন্দি রাখা যেত…” নবীনের কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে এল।
রুদ্র বিস্ময়ে কূপের দিকে তাকাল। হঠাৎই তার মনে হলো—কূপের গা-গভীরতা থেকে যেন এক ফিসফিসানি ভেসে আসছে। একাধিক কণ্ঠস্বর— আলাদা আলাদা উচ্চারণ, কিন্তু একসঙ্গে মিশে গেছে যেন।
“এসো… এসো… আমাদের শুনছো?…”
সে শীতল ঘাম ছুটে এল। কানে হাত দিল, যেন বন্ধ করতে পারে আওয়াজটা। কিন্তু ফিসফিসানি থেমে না।
নবীন ধীরে বলল, “আপনি শুনতে পাচ্ছেন, না কি?”
রুদ্র বিস্ময়ে তাকাল তার দিকে।
নবীন যোগ করল, “সবাই শুনতে পায় না। কেবল যাদের রানী বেছে নেয়, তারাই শুনতে পায়। আপনিও কি…?”
রুদ্র কিছু না বলে পেছনে সরে আসতে লাগল।
সূর্যের আলো সরু হয়ে এসেছে, কূপের গায়ে পড়া ছায়া যেন আরও দীর্ঘ হয়েছে। কূপটা যেন নিশ্বাস নিচ্ছে—জ্যান্ত, সজাগ।
রুদ্র জানে, এই কূপ কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে। শুধু ইতিহাস নয়—অভিশাপ। এই রাজবাড়ির প্রকৃত রহস্য বোধহয় এই কূপের তলেই চাপা পড়ে আছে।
অধ্যায় ৫: অতীতের পাপ
রাত গভীর। রাজবাড়ির দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগোচ্ছে। হাওয়ার দমকে জানালার পর্দা দুলে উঠছে, যেন রাতের স্তব্ধতা ছিঁড়ে কারা ফিসফিস করছে।
রুদ্র বিছানায় শুয়ে। ঘুম আসছে না ঠিকঠাক। মাথায় ঘুরছে সকালে দেখা সেই রহস্যময় কূপ, নবীনের কথা, আর কেয়ারটেকারের সতর্কবাণী। সব যেন মিলে মিশে গেছে অদৃশ্য কোনো ছায়ার ভেতর।
শেষমেশ কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, খেয়াল নেই। কিন্তু ঘুম ছিল না শান্তির। বরং শুরু হল এক বিভীষিকাময় স্বপ্ন।
সে দেখল রাজবাড়ির সেই পুরনো অংশ—মাটির দেয়াল, মশাল জ্বলা করিডোর, আর সেই কূপ। রানী অম্বিকা দাঁড়িয়ে আছেন কূপের ধারে। তার পরনে কালো রঙের জমকালো শাড়ি, গলায় অদ্ভুত ধরনের হার— কঙ্কালের দন্ত দিয়ে তৈরি! তার চোখে এক উন্মাদ আগুন।
তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদছে এক কিশোরী দাসী—হাতে প্রার্থনার ভঙ্গি, চোখে জল। রানী উচ্চস্বরে কিছু মন্ত্র জপ করছেন, এবং আচমকাই ঠেলে দিলেন সেই দাসীকে কূপে! দাসীর আর্তনাদ কানের পর্দা ফাটিয়ে দিল, কিন্তু রানীর মুখে তখন অদ্ভুত এক তৃপ্তির হাসি।
একজন, দুইজন, তিনজন…
রুদ্র দেখল, একের পর এক মেয়েকে কূপের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন রানী। কারও গায়ে ছিল উৎসবের সাজ, কারও মুখে আস্থা, কারও চোখে ভয়। আর প্রতিবারই কূপ যেন হেসে উঠছে—তার গভীরতা যেন গিলে নিচ্ছে তাদের কান্না।
রানী তখন উচ্চস্বরে বলছেন, “আমার শক্তি চাই… চিরজীবন চাই… আত্মা চাই! আমি অমর হবো!”
রুদ্রের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সে চিৎকার করে উঠতে চায়, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না।
ঠিক সেই মুহূর্তে রানী তাকান সরাসরি রুদ্রর চোখে, “তুমিও এসো! এবার তুমিই হবে বলি!”
হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায় রুদ্রর। গলা দিয়ে এক দম বন্ধ কান্নার শব্দ বেরিয়ে আসে। বুক ধড়ফড় করছে, ঘামছে ঠান্ডায়, গা ভিজে গেছে। সে উঠে বসে পড়ে। চারদিক নিস্তব্ধ, কিন্তু একটা অদ্ভুত ঠান্ডা ভাব ছড়িয়ে আছে ঘরে।
তার চোখ যায় দরজার দিকে— দরজা হাট করে খোলা।
ঘুমাতে যাওয়ার সময় তো বন্ধই করেছিল রুদ্র! কে খুলল?
সে ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে দরজার দিকে এগোয়।
কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে… দরজার বাইরে লম্বা করিডোর, আর তারপর সেই বারান্দা। চারপাশে ঘন কুয়াশা। আর সেই কুয়াশার মধ্যে, হালকা হলুদাভ আলোয় সে দেখে একজন দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে। চুল খোলা, কালো ঢলে পড়ছে পিঠ বেয়ে। তার পোশাক ভিজে, শরীর থেকেও জল টপ টপ করে পড়ছে— কিন্তু সেখানে তো কোনও জল নেই! সে একটুও নড়ে না।
রুদ্র ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর যেন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পা এগিয়ে চলে তার দিকে। আর তখনই…
দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়ামূর্তি এক মুহূর্তে মিলিয়ে যায় কুয়াশার ভেতর। শুধু রয়ে যায় কয়েক ফোঁটা জল আর তার নিচে একটা সাদা ফুল— যা সে আগেও কোথাও দেখেছে, কিন্তু মনে পড়ছে না কোথায়।
রুদ্র ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তার মন বলছে— ঘরের ভেতরেই যেন কেউ রয়েছে। দেওয়ালের ছায়া যেন একটু বেশিই নড়ছে। সে জানে, এই রাজবাড়িতে শুধু ইতিহাস নয়—অতীতের পাপ এখন জেগে উঠেছে। রানীর বলির কাহিনি হয়তো নিছক গল্প নয়। এটা রক্তে লেখা সত্য।
অধ্যায় ৬: গোপন কামরা
সকাল থেকেই রুদ্রর মনে কেমন অস্থিরতা। রাতের বিভীষিকাময় স্বপ্ন আর কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা সেই ভিজে চুলের ছায়ামূর্তি তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, এই রাজবাড়ির সব কিছু যেন একটা পর্দা দিয়ে ঢাকা, যার আড়ালে লুকিয়ে আছে সত্যের জ্বলন্ত মুখ।
ঘুরতে ঘুরতে সে এসে পড়ে পশ্চিম পাশের একটি করিডোরে— যেখানে অন্য কেউ আসে না। দেয়ালের এক পাশে পুরনো কাঠের একটা আলমারি, ধুলোমাখা, অনেক বছর ধরে অচল।
কৌতূহলে হাত দিয়ে আলতো করে ঠেলে দেখে—আলমারির পেছনে একটা ছোট লোহার দরজা, চওড়ায় এক হাতের মতো, নিচের দিকে ছেঁকা দাগ, যেন কেউ বারবার হাত দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করেছে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই পেছন থেকে নবীনের গলা, “ওটা খোলা নিষেধ, রুদ্রদা। প্লিজ… দূরে থাকুন।”
রুদ্র ফিরে তাকায়। নবীনের চোখে ভয়, “ওটা রানীর পুরনো গোপন ঘর ছিল। কেউ কখনও ঢোকেনি। কেয়ারটেকার বলে, একবার ঢুকলে আর ফেরা যায় না।”
রুদ্র কিছু না বলে মাথা ঝাঁকায়, তবে মন থেকে উৎসাহটা যায় না।
রাতে সবাই যখন ঘুমে, তখন রুদ্র চুপচাপ উঠে পড়ে। হাতে টর্চ, আর বুকভরা কৌতূহল। রাজবাড়ির করিডোর নীরব—শুধু দূরের কোন ঘর থেকে মাঝে মাঝে দরজা চাপা আওয়াজ আসে, যেন বাতাসে কারা ফিসফিস করছে।
সে গিয়ে দাঁড়ায় সেই লোহার দরজার সামনে। একটা ধাক্কা। তারপর আরেকটা। ক্ল্যাং! দরজাটা খুলে গেল এক অদ্ভুত কাঁপুনি নিয়ে। ভেতরে সরু এক সিঁড়ি— নেমে গেছে নিচের দিকে, অন্ধকারে।
রুদ্র এক হাতে টর্চ ধরেছে, অন্য হাতে মোবাইলের ক্যামেরা অন করে ভিডিও করতে থাকে, যদিও নেট নেই। সিঁড়ি নামে—নিচে। দেয়ালে শ্যাওলা, ছত্রাক, আর মাঝে মাঝে কে যেন পাশ থেকে নিঃশ্বাস নিচ্ছে এমন একটা আওয়াজ।
নেমে এসে দাঁড়ায় এক গা-ছমছমে ঘরের সামনে। সেই ঘরের পাশ দিয়েই যায় মৃত্যুকূপ—যার ধাতব গন্ধ আর ঠান্ডা হাওয়া রুদ্রর শিরদাঁড়া সোজা করে দেয়।
ঘরের দরজাটা খোলা। ভেতরে ঢুকেই রুদ্র থমকে যায়।ঘরটা ছোট, কিন্তু তার ভেতরে যা আছে তা স্বপ্নেও ভাবেনি – দেয়ালজুড়ে শত শত পুরনো পুতুল। কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে। অনেকের মুখে গর্ত, চোখ উপড়ানো, রক্তরঙের দাগ।
মেঝেতে এক প্রাচীন হাড়গিলে প্রতিমা— চোখে পাথরের বদলে কাচের গুটি, দাঁত বের করা হাসি। দেয়ালের এক কোণায় টাঙানো মানুষের দাঁতের মালা— দাঁতের গায়ে খোদাই করা প্রতীক, অদ্ভুত ভাষায়। ঘরের ঠিক সামনে একটা আয়তাকার পাথরের ফলক। তাতে গা শিউরে ওঠা লেখা—
“আমি মরে গেছি, তবু ফিরে আসি।”
— রানী অম্বিকা
রুদ্রর পায়ের নিচে ঠান্ডা জমে ওঠে। বাতাস ভারী। হঠাৎ টর্চের আলো নড়ে যায়, এবং পিছনের দিক থেকে একটা নিঃশ্বাসের শব্দ। সে ঘুরে তাকায়। কেউ নেই। কিন্তু দেওয়ালের এক পুতুল— আগে মুখ নিচু ছিল। এখন সে সরাসরি তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে।
ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে রুদ্র অনুভব করে, যেন সময় স্থির হয়ে গেছে। দেয়ালের পুতুলেরা যেন কথা বলছে, তাদের মৃত চোখ যেন জীবন ফিরে পেয়েছে। আচমকাই আয়নার মতো চকচকে একটা ব্রোঞ্জের পাটায় রুদ্র দেখে—পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে! সে ঘুরে তাকায়—কেউ নেই।
কিন্তু তখনই, এক তীব্র কান্নার শব্দ গর্জে ওঠে ঘরের ভেতর। আর সেই কান্না ধীরে ধীরে পরিণত হয় উচ্চস্বরে হাসিতে—উন্মত্ত, অপ্রকৃতিস্থ। রুদ্র দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে।
রাতের আকাশে চাঁদের আলো মেঘে ঢাকা। রাজবাড়ির চারদিক যেন আরও নিঃস্তব্ধ। ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে রুদ্র বসে পড়ে বিছানায়। তার বুকের ভেতর ধুকধুক করছে এক অজানা ভয়। সে জানে, এখন আর শুধুই কৌতূহল নয়। এখন সে রানীর চোখে পড়েছে এবং রানী অম্বিকা এখনও ফিরে আসে… প্রত্যেক রাতে, প্রত্যেক বলির খোঁজে।
অধ্যায় ৭: আত্মার আত্মপ্রকাশ
রাত তখন তিনটে বাজে। সময়টা যেমন অদ্ভুত, তেমনি গভীর। বাইরের আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, অথচ চাঁদের আলো কেমন যেন একরকম দগদগে রুপালি হয়ে চারদিক ঢেকে আছে। হঠাৎ, কোনো কারণ ছাড়াই শুরু হয় এক আচমকা ঝড়—আকাশ ফেটে যেন নেমে আসে বিদ্যুৎ।
রুদ্র তখন ঘুমের চেষ্টায় বিছানায়। হঠাৎ… কড়া়ম! কড়া়ম!
সারা রাজবাড়ি যেন কেঁপে উঠল। সব দরজা, জানালা একে একে খুলে যেতে লাগল— একটা করে, একটার পর একটা, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তাদের ঠেলে খুলছে।
আঁধারের বুক চিরে হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে পড়ে এক অচেনা ঠান্ডা—যা হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।
তারপরই বাতাসে ভেসে আসে একটা হাসি—নারী কণ্ঠ, কিন্তু কেমন যেন বিদ্বেষে ভরা, রক্তে জবজবে। “আহাহা… আবার কেউ এসেছে আমার ঘরে…”
রুদ্রর গা শিউরে ওঠে। আলো-আঁধারির মধ্যে সে দেখতে পায়, দেয়ালের আয়নাটা হঠাৎ ঝলকে উঠেছে। ভেতরে নিজেকে দেখতে চায় রুদ্র, কিন্তু…
নিজের প্রতিবিম্ব নয়, আয়নায় সে দেখে— তার ঠিক পিছনে এক জোড়া সাদা, হাড়ের মতো হাতে ধরা মুখ! একটা হাত ধীরে ধীরে উঠে এসে রুদ্রর গলার পেছনে রাখে। চোখের সামনে চারপাশ ধোঁয়ার মতো ঘুরতে থাকে। চিৎকার করতে চায় রুদ্র, গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না। শরীর অবশ। হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার মতো। তার ঠোঁট ফাঁকা, কিন্তু আওয়াজ নেই।
ঠিক তখনই দরজা খুলে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে নবীন।
তার চোখে আতঙ্ক, কিন্তু অদ্ভুত এক জেদ, “উঠুন, রুদ্রদা! দেরি হলে আর ফেরা যাবে না!” সে দৌড়ে এসে রুদ্রকে শক্ত করে টেনে তোলে।
আয়নার প্রতিফলন তখন কাঁপছে। সেই হাতগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য রুদ্র স্পষ্ট দেখতে পায়—
এক নারী মুখ—রক্তাক্ত, চুল এলোমেলো, চোখ জ্বলজ্বলে। রানী অম্বিকা।
নবীন রুদ্রকে বাইরে নিয়ে আসে এক পুরনো বারান্দায়। ঝড়ের মাঝেও সে কাঁপছে না। রুদ্র তখনও ঠিক দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, তবু জিজ্ঞেস করে, “কে ছিল ও? কী চাইছে সে?”
নবীনের চোখ নিচু, কণ্ঠ যেন এক অদ্ভুত ভারে ভরা, “তিনশো বছর আগে, এই বাড়িতেই রানী অম্বিকা এক নিষিদ্ধ সাধনায় মেতে উঠেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের আতঙ্ক আর মৃত্যুতে পাওয়া যায় শক্তি। প্রতিদিন এক দাসীকে কূপে ফেলে তিনি সেই শক্তি আহরণ করতেন।”
রুদ্র থমকে যায়—“তবে কি ওই কূপটা—”
“হ্যাঁ, ওটাই মৃত্যুকূপ। যেখানে বলি দেওয়া হতো। রানী চাইতেন অমরত্ব। কিন্তু প্রকৃতি তাঁকে দেহে অমরতা দেয়নি। মৃত্যু এল, কিন্তু আত্মা রয়ে গেল। আটকে গেছে এই রাজবাড়িতে। তাঁর সাধনা থেমে যায়নি— তিনি ফিরে আসেন প্রতি রাতে। বিশেষ করে এই সময়— রাত্রি তিনটা। আত্মা তখন সবচেয়ে সক্রিয়।”
রুদ্র নিজের গলায় হাত দেয়— হঠাৎ একটা লাল আঙুলের ছাপ চোখে পড়ে। যেন কেউ তাকে শ্বাসরোধ করতে গিয়েছিল। সেই চাপ এখনও কাঁপাচ্ছে তার মন।
নবীন বলে, “আপনি এখন তাঁর চোখে পড়েছেন। আপনি যদি কিছু না করেন, তাহলে তিনি আপনাকে ছাড়বেন না।”
রুদ্র ফিসফিস করে, “আমি কী করব?”
নবীন শান্ত স্বরে বলে, “আমাদের সেই কূপের গভীরে নামতে হবে। যেখান থেকে তাঁর শক্তি এসেছে, সেখান থেকেই তাঁকে শেষ করতে হবে।”
বাতাসে তখনও ভেসে আসে এক হাসির ছায়া। বাড়ির ছাদ থেকে এক পলক দেখা যায়— চুল খোলা এক নারী, পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এবং ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়।
রুদ্র জানে, এই লড়াই এখন শুধুই অতীতের রহস্য উন্মোচনের নয়। এটা এখন প্রাণে বাঁচার লড়াই। রাজবাড়ির প্রতিটা ইট, প্রতিটা দেয়াল যেন কিছু না কিছু চাপা রেখে বসে আছে। আর রুদ্র… সে এখন সেই রহস্যের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে।
অধ্যায় ৮: কূপের নিচে
নবীন আর রুদ্র দাঁড়িয়ে ছিল রাজবাড়ির সেই পুরনো বারান্দায়, যেখানে একদম দূরে দেখা যায় মৃত্যুকূপের উপর লোহার জালঘেরা মুখ। বাতাস থমথম করছে। ঝড় থেমে গেছে, কিন্তু সেই অশরীরী ঠান্ডা যেন আরও জেঁকে বসেছে চারপাশে। নবীনের চোখে ভয়ের ছায়া নয়, বরং এখন সেখানে দেখা যায় এক অসহায় নিশ্চিততা।
সে বলে, “রুদ্রদা, এই কূপ প্রতি শত বছরে একবার জেগে ওঠে এবং তখন সে কাউকে বেছে নেয়— একজন ‘আত্মা-ধারী’। এবারের পছন্দ আপনি।”
রুদ্র আঁতকে ওঠে, “আমি? কেন আমি?”
নবীন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “কারণ আপনি প্রশ্ন করেছিলেন। কারণ আপনি সত্য জানার চেষ্টা করেছিলেন। এই রাজবাড়ি কাউকে ক্ষমা করে না, যারা সত্যের দরজা খোলে।”
রুদ্র পেছন ফিরতে চায়, দৌড়ে পালাতে চায়। কিন্তু… সেই মুহূর্তে, রাজবাড়ির ভেতরকার দরজা-জানালা, করিডোর, ঘর— সব যেন বিলীন হয়ে যেতে থাকে। রুদ্র যেদিকেই ছুটে যেতে চায়, সেখানে আর কিছু নেই। দরজা থাকে না, দেয়াল হঠাৎ ভেঙে অন্ধকারে পরিণত হয়। যেন বাড়িটা নিজেই তার পথ রুদ্ধ করে ফেলছে। সে এখন ফাঁদে। এ রাজবাড়ি তাকে বেরোতে দেবে না।
রুদ্র চিৎকার করে ওঠে, “নবীন! কী হচ্ছে এগুলো?”
কিন্তু নবীন তখন নিচু গলায় শুধু এতটাই বলে, “আমার কাজ ছিল আপনাকে নিয়ে আসা। আর কিছু নয়।”
রুদ্র থমকে দাঁড়ায়, “তুমি জানতো সব?”
নবীন কাঁপতে কাঁপতে মাথা নেড়ে বলে, “আমি জন্ম থেকেই এই রাজবাড়ির সঙ্গে বাঁধা। আমিও পালাতে পারি না। প্রতি শত বছরে একজনকে নিতে হয়— নাহলে রানী আমাকে নিজেই ডাকে কূপের নিচে।”
হঠাৎ করে বিকট শব্দে কূপের জাল খসে পড়ে। কূপের মুখ হাঁ করে খুলে পড়ে এক অন্ধকারের গহ্বরে। তার ভেতর থেকে ভেসে আসে একটা টেনে নেওয়ার মতো শব্দ— যেন বাতাসও সেখানে ঢুকতে ভয় পায়। রুদ্র পেছনে যেতে চায়। কিন্তু অদৃশ্য কোনো শক্তি ধীরে ধীরে তাকে কূপের দিকে টেনে নেয়। তার পা পিছলে যায় মাটিতে, শরীর জড় হয়ে পড়ে।
হাত বাড়িয়ে নবীনের দিকে চিৎকার করে, “আমাকে বাঁচাও! দয়া করে!”
নবীন তখন চোখ বন্ধ করে, কাঁপতে কাঁপতে পেছনে সরে আসে। তার মুখে শুধু একটা ফিসফাস, “ক্ষমা করবেন… আমি এবার নিজে বাঁচতে চাই।”
রুদ্রর চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে সারা বাড়ি জুড়ে, “না-আ-আ-আ-আ!!!” তার শরীর এক মুহূর্তে কূপের কিনারা থেকে পিছলে গিয়ে নিচে …নিচে… আরও নিচে পড়ে যেতে থাকে।
আর সেই সময়— কূপের গভীর থেকে ভেসে আসে এক নারীর হি হি করে পৈশাচিক হাসি। রানী অম্বিকা। চুল এলোমেলো, চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে, শরীর ভেসে আছে অন্ধকারে। তিনি বলেন, “আর এক আত্মা… আমার…”
রুদ্রর শরীর যখন অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, তখন কূপের ভেজা দেয়ালে আবার এক লাল অক্ষরে লেখা হতে থাকে—
“আর এক আত্মা যোগ হল।”
রাজবাড়ি আবার শান্ত। দরজা-জানালা একে একে বন্ধ হয়ে যায়, বাতাস থেমে যায়, যেন কিছুই হয়নি। নবীন এক কোণে বসে নিঃশব্দে কাঁদে।
রাত্রি ভোরের দিকে এগোতে থাকে। পূর্বদিকের আলো আস্তে আস্তে ছুঁয়ে যায় রাজবাড়ির ছাদ। পাখিরা ডাকছে, গাছের পাতায় শিশির। আর ভিতরে…
রাজবাড়ির অন্ধকার ঘরে রানীর সেই আয়নাটা আবার ঝলকে ওঠে। তাতে দেখা যায়— এক নতুন ছায়া, রুদ্রর মুখ। সে তাকিয়ে আছে বাইরে, নিষ্পলক। মুখে ভয়, দৃষ্টিতে শূন্যতা।
রাজবাড়ি আবার নিস্তব্ধ। আরও এক আত্মা হারিয়ে গেল তার পেটে। কিন্তু… তার ক্ষুধা ফুরায় না। দরজায় আবার ধুলো জমছে, আবার এক নতুন অতিথির জন্য অপেক্ষা করছে “মৃত্যুকূপ”।
[শেষ]

ছবি এআই
© পিনাকী রঞ্জন পাল