শিলিগুড়ি : চাঞ্চল্যকর মানব পাচারচক্র ভেসে উঠল নিউ জলপাইগুড়ি (এনজেপি) স্টেশনে। কাজের টোপে পাচারের আগে শেষ মুহূর্তে রক্ষা পেল উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকার ৫৬ জন তরুণী। সোমবার রাতে এনজেপি স্টেশনে জিআরপি (জিআরপি) ও আরপিএফ (RPF)-এর যৌথ অভিযানে উদ্ধার হয় তরুণীরা। গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুই পাচারকারীকে— দক্ষিণবঙ্গের ভাটপাড়ার জিতেন্দ্র কুমার পাশওয়ান এবং শিলিগুড়ির পোড়াঝাড় এলাকার চন্দ্রিমা কর।

কীভাবে সামনে এল চক্রটি?
আরপিএফ ও জিআরপি সূত্রে জানা গেছে, তামিলনাড়ুর হসুর জেলায় পাচার করা হচ্ছিল ওই তরুণীদের। তাদের পরিবারের কাছে বলা হয়েছিল, “বেঙ্গালুরুতে কোম্পানিতে চাকরি দেবে”। কিন্তু বাস্তবে, ওই তরুণীদের ‘ডাউন ক্যাপিটাল এক্সপ্রেস’-এ তোলা হয়, যা এনজেপি থেকে যাচ্ছিল বিহারের পাটনা অভিমুখে। বিষয়টি প্রথমে সন্দেহজনক মনে হয় রেল পুলিশের।

ভয়াবহ তথ্য মিলল জেরা থেকে
এনজেপি স্টেশনে জিআরপি ও আরপিএফের ২৭ সদস্যের দল গঠন করে তল্লাশি চালান সাব-ইনস্পেকটর আত্রেয়ী গঙ্গোপাধ্যায় ও বর্ষা প্রধানের নেতৃত্বে। ডাউন ক্যাপিটাল এক্সপ্রেস ট্রেনের সংরক্ষিত কামরায় প্রবেশ করে পুলিশ দেখতে পায় একসঙ্গে বসে রয়েছেন ৫৬ জন তরুণী। কারও কাছেই টিকিট নেই, বরং হাতেই কালি দিয়ে লেখা ছিল কোচ ও বার্থ নম্বর!

তরুণীদের সঙ্গে থাকা জিতেন্দ্র ও চন্দ্রিমা পুলিশের জেরা সামলাতে পারেননি। জানা যায়, বেঙ্গালুরুর নাম করে তাদের তামিলনাড়ুর হসুরে ফ্যাক্টরিতে কাজ দেওয়ার নামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। জেরা করে আরও জানা গিয়েছে, আসলে যৌন ব্যবসার জন্যই তাদের পাচার করার পরিকল্পনা ছিল।
প্রশিক্ষণের আড়ালে ফাঁদ
অভিযুক্তদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, তরুণীদের মধ্যে কয়েকজনকে আগেই “পশ্চিমবঙ্গ সোসাইটি ফর স্কিল ডেভেলপমেন্ট”-এর নাম করে দার্জিলিং জেলায় এক মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল হোটেল রিসেপশন, স্পা পরিষেবা ইত্যাদি।
পরিবারকে ফোন, ফিরিয়ে দেওয়া হয় বাড়িতে
উদ্ধার হওয়া তরুণীদের প্রত্যেকের পরিবারকে খবর পাঠিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি জিআরপি থানায় ডাকা হয়। পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় মেয়েদের।
কী বলছে পুলিশ?
জিআরপি সুপার কুঁয়রভূষণ সিং জানান, “মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে। পাচারচক্রে আর কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
আরপিএফ মহিলা সাব-ইনস্পেকটর সারিকা কুমারীর লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ধৃতদের বিরুদ্ধে IPC-এর ১৪৩(৩)/৩(৫) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মঙ্গলবার ধৃতদের জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে পেশ করে হেফাজতে নেওয়া হবে।
আগেও ঘটেছে এমন
তদন্তে উঠে এসেছে, এর আগেও একাধিক তরুণীকে একইভাবে হসুরে পাচার করা হয়েছে। তাদের অনেকেই আর বাড়ি ফেরেননি। সেই কারণেই পুলিশের সন্দেহ আরও ঘনীভূত। চক্রে আরও কারা জড়িত রয়েছে, তা জানার চেষ্টা চলছে।
পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় বড়সড় মানব পাচার চক্রের হাত থেকে বাঁচানো গেল উত্তরবঙ্গের অসংখ্য তরুণীকে। এই ঘটনায় নতুন করে প্রশ্ন উঠছে — কাজের টোপে, প্রশিক্ষণের নামে কিভাবে তরুণীদের নিশানা বানানো হচ্ছে।
মানব পাচার রুখতে এই অভিযান নিঃসন্দেহে বড়সড় উদাহরণ হয়ে থাকবে।