পিনাকী রঞ্জন পাল
এক ভাঙা প্রাসাদ, এক বন্দি আত্মা, আর এক প্রাচীন অভিশাপ। সৌমিত্র ও তার দল যা ভেবেছিল শুধুই রেনোভেশন, তা হয়ে দাঁড়ায় ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ। মৃত্যু মঞ্জিল— ভয় এখানেই শুরু, শেষ নয়। এখনই পড়ুন।

তিস্তার তীরে যখন সন্ধ্যার কুয়াশা নামতে শুরু করে, তখন পাহাড় আর নদীর মধ্যবর্তী নির্জনতা যেন আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। সেই নির্জনতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল একটি পুরোনো, শতাব্দীপ্রাচীন প্রাসাদ—“মৃত্যু মঞ্জিল”। স্থানীয় মানুষ এই নামেই চেনে জমিদার সুধাংশু নারায়ণের সেই রহস্যঘেরা বাড়িটিকে। তবে এখন কেউই সেদিকে ফিরেও তাকায় না।
সৌমিত্র চক্রবর্তী, শহরের একজন প্রতিভাবান স্থপতি, কিছুটা বাধ্য হয়েই এই প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। একটি বিদেশি হেরিটেজ সংস্থা “মৃত্যু মঞ্জিল” পুনর্গঠনের দায়িত্ব দিয়েছে তাকে। প্রথমে তিনি অনাগ্রহী ছিলেন, কিন্তু প্রকল্পের মোটা অঙ্কের বাজেট ও মিডিয়ার প্রচারের লোভে রাজি হয়ে যান। তার সঙ্গী তিনজন—সহকারী দয়াল বিশ্বাস, ইতিহাস-অনুরাগী বন্ধু অর্ক সেন ও স্থাপত্য বিষয়ের ছাত্রী, ইন্ট্রান অস্মিতা রায়। তারা সবাই একটাই কথা ভাবছিল—পুরোনো জমিদারবাড়ি, রহস্যময় ইতিহাস, আর কয়েকটা স্কেচ আর পরিমাপ—ব্যস! কয়েকদিনের কাজ।
জিপে করে যখন তারা প্রথম “মৃত্যু মঞ্জিল”-এর সামনে পৌঁছায়, তখন সূর্য ডুবে গেছে। পুরো বাড়িটি যেন কুয়াশায় মোড়া এক মৃত স্তব্ধ আত্মা। লোহার তৈরি বিরাট গেটটি আধখোলা, যেন কেউ বা কিছু তাদের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। গেটের উপরে ক্ষয়ে যাওয়া একটি ফলকে লেখা—
“শ্রী শ্রী সুধাংশু নারায়ণ জমিদার ভবন – ১৮৯৪”
দয়াল একটু হেসে বলে, “এই বাড়ির নাম হওয়া উচিত ছিল ভূতের বাড়ি, হেরিটেজ নয়!”
অস্মিতা কাঁপা গলায় বলল, “এই জায়গায় কিছু অস্বাভাবিক অনুভব হচ্ছে। আপনারা বুঝতে পারছেন না?”
সৌমিত্র শান্তভাবে জানাল, “ভাবনাকে মাথায় চড়তে দিও না। ভূত নয়, মানুষই ভয়ংকর।”
তারা বড় ব্যাগগুলো নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। পুরোনো চুন-সুরকি দেওয়া দেয়ালগুলো ছোপ ছোপ হয়ে গিয়েছে। জানালার কাচ অনেকটাই ভাঙা, ফ্রেমে জং ধরেছে। সিঁড়ির ধাপে ধাপে জমেছে ময়লা আর মাকড়সার জাল। তবু একসময় এই বাড়িটি কী রাজকীয় ছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
তারা বাড়ির একটি অপেক্ষাকৃত ভালো ঘর বেছে নিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলে। ঘরটির মাঝখানে বিশাল এক আয়না, যার উপর ধুলো জমে থাকলেও তার গা থেকে এক অদ্ভুত ঠান্ডা ছড়াচ্ছিল। দেয়ালের কোণে একটি পুরোনো পিয়ানো, আর ঠিক তার পাশে একটি রক্তচাপ-রঙের পর্দা। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল জীর্ণ কাঠ আর ছাঁচধরা চুনের গন্ধ।
ঠিক সেই মুহূর্তে… একটা চাপা শব্দ ভেসে এল। যেন ওপরে কেউ ধীরে ধীরে হাঁটছে। সবাই চুপ। শুধু কাঁচের জানালায় কুয়াশা জমে গিয়ে এক অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি তৈরি করছিল।
অর্ক ধীরে ধীরে বলল, “এই বাড়িটা মানুষ খেয়ে ফেলেছে… শুনেছি জমিদার পরিবার একরাতে উধাও হয়ে গিয়েছিল, কোনো চিহ্ন রেখে যায়নি।”
সৌমিত্র কড়া গলায় বলল, “গল্পগাছা বাদ দাও। কাল থেকে কাজ শুরু করতে হবে। রাতে বিশ্রাম নাও।”
কিন্তু ঘরের বাতাস ভারি হয়ে উঠছিল। যেন প্রতিটি দেয়াল কানে কানে কিছু ফিসফিস করছে। পিয়ানোর দিকে তাকিয়ে অস্মিতার হঠাৎ মনে হল, তার একেকটি কি নড়ছে—নিজে নিজে। সে চোখ সরিয়ে নিল।
ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশটা। একটা হালকা হাওয়া এসে জানালার কাচে আঘাত করল। আয়নার দিক থেকে একটা ঠান্ডা নিঃশ্বাস যেন ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। আর সেই মুহূর্তে আয়নায় প্রতিফলিত হল এক ছায়ামূর্তি—যা কারও ছিল না!
রাতটা যেন অনন্তকাল। ঘড়ির কাঁটা এগোয়, কিন্তু ঘরের ভিতরে সময় জমে থাকে এক অদৃশ্য ছায়ার মতো। সেই রাতে, চারজনেই একসাথে থেকে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ঘরের চারদিকে টর্চ আর ব্যাটারিচালিত লন্ঠন রাখা হয়েছিল। বাইরে ঝিঁঝিঁর শব্দ, মাঝে মাঝে ঝোড়ো হাওয়ার শোঁ শোঁ আওয়াজ আর কাঠের দরজার হালকা কড় কড়ানো—সব মিলিয়ে যেন কেউ আড়াল থেকে দেখছে ওদের।
রাত ১টা ৪৭ মিনিট। দয়াল ঘুম ভেঙে দেখে, ঘরের এক কোণে রাখা আয়নাটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি। মুখ দেখা যায় না, কিন্তু চোখ দুটি লালচে আগুনের মতো জ্বলছিল। দয়াল চিৎকার করতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই চোখের পলকে ছায়াটি মিলিয়ে গেল।
সে ঘেমে উঠল। শরীর ঠান্ডায় জমে গিয়েছে। হুডি চাপিয়ে সে চারদিকে তাকাল। সৌমিত্র, অর্ক, আর অস্মিতা তখনও ঘুমিয়ে। তার বুকের মধ্যে ধুকপুকানি বাড়তে লাগল। সে পিয়ানোর পাশে রাখা চেয়ারটা দেখে মনে মনে ভাবল—“কি দেখলাম আমি? স্বপ্ন? না বাস্তব?”
সকাল ৮টা। রোদ উঠেছে, কিন্তু “মৃত্যু মঞ্জিল”-এর দেয়ালে যেন কোনো আলোর প্রভাব পড়ে না। ঘরের জানালা দিয়ে আলো ঢুকলেও ধুলোর আস্তরণে সেটা নিস্তেজ হয়ে যায়।
সৌমিত্র সকালে কাজ শুরু করার আগে বলল, “আজ আমরা বাড়ির ভেতরের মাপজোক, নকশা আর কাঠামো বিশ্লেষণ করব। দয়াল, তুই নিচতলার স্টোররুমগুলো দেখ। অর্ক, তুই লাইব্রেরি রুমের নথি খুঁজে দেখ। অস্মিতা, তুমি পেছনের কেয়ারটেকার কোয়ার্টার ঘুরে দেখো। আমি ওপরে যাচ্ছি—ছাদ ও দোতলার অবস্থা খতিয়ে দেখতে হবে।”
চারজন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে কেউ জানে না, আজ এই বাড়ির গোপন ইতিহাস নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেবে। পেছনের কোয়ার্টার ঘরে ঢুকে অস্মিতা ভয়ানক এক গন্ধে থমকে যায়— মাংসের পচা গন্ধ, অথচ এই বাড়িতে তো কেউ থাকে না! দেয়ালের পাশে এক পুরোনো ট্রাঙ্ক পড়ে আছে। সে ধীরে ধীরে ট্রাঙ্ক খুলতে গেল… হঠাৎ জানালার বাইরে একটা মুখ দেখা গেল—চুলে জট, চোখ অদ্ভুত ফাঁকা। মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। সে আঁতকে উঠে চিৎকার করে বলল, “কে? কে ওখানে?”
কোনো সাড়া নেই। শুধু একটা বাতাস এসে কানে ফিসফিস করে বলে গেল— “তুই কেন এসেছিস এখানে?… এখান থেকে চলে যা…”
অস্মিতা পিছিয়ে এসে ট্রাঙ্ক বন্ধ করল। সে বুঝল, এখানে কিছু আছে… কিছু অশুভ।
এদিকে অর্ক লাইব্রেরি রুমে ঢুকে ধুলো জমা বইয়ের স্তূপ দেখতে পায়। তার চোখে পড়ে এক বই—“সুধাংশু নারায়ণের ডায়েরি”। বইটা খুলতেই খসে পড়ে একটা পুরোনো ছবি—সুদর্শন জমিদার, পাশে স্ত্রী, আর সামনে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী। ছবির নিচে লেখা— “আমার কন্যা চন্দ্রমল্লিকা—আমার জীবনের অভিশাপ।”
অর্ক ডায়েরিটি নিয়ে পড়তে শুরু করে। প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা জমিদার জীবনের কথা, কিন্তু তারপর ভাষা বদলে যায়—
“চন্দ্রমল্লিকার জন্মের পর থেকেই অশুভ কিছু ঘটতে থাকে। পুরোহিত বলেছিলেন, ওর জন্মে অশুভ নক্ষত্র জেগেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি… এখন দেখি ওর ছায়া আয়নায় পড়ে না… ও আমাদের দিকে তাকালে মনে হয় সময় থেমে গেছে… ও হাসলে রাতের পাখি চুপ করে যায়…”
অর্ক পেছনে তাকায়… আয়নার দিকে। আয়নায় তার প্রতিবিম্ব নেই!
সে পেছন ফিরে দেখে—আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক বালিকা, সাদা ফ্রকে, মাথায় লাল ফিতে বাঁধা। সে তাকিয়ে আছে সরাসরি তার চোখে।
“তুমি… কে?”
মেয়েটি কণ্ঠহীনভাবে ঠোঁট নাড়ল—“চলো আমার সঙ্গে।”
অন্যদিকে দয়াল নিচতলার একটি বন্ধ ঘরের দরজা ঠেলে খোলে। ভেতরে পুরোনো কাঠের বাক্স, আর দেয়ালে আঁকা অদ্ভুত প্রতীক—তিনটি চোখ, আর তার নিচে অক্ষরে লেখা— “সে এখন আয়নায় বাস করে।”
বাক্স খুলতেই সে দেখে একটি ফাটা পুতুল—চোখ উপড়ে ফেলা, মুখে রক্তরঙা দাগ, আর তার গলায় লাল ফিতে বাঁধা!
হঠাৎ ঘরের আলো নিভে যায়। অন্ধকারে সে শুধু শুনতে পায় ছোট ছোট পায়ে কেউ দৌড়াচ্ছে… এবং পিয়ানোর সেই করুণ সুর… যেটা কেউ বাজায়নি।
বিকেলে চারজন আবার একসাথে হয়। সবাই চুপ। কেউই তাদের দেখা-শোনা করা ঘটনাগুলো প্রথমে বলতে চায় না। শেষে অর্ক বলে, “এই বাড়িতে আয়নাগুলো স্বাভাবিক নয়। এরা কিছু লুকিয়ে রাখছে।”
সৌমিত্র মুচকি হেসে বলে, “তবে আয়নার রহস্য জানতে হলে আমাদের দোতলার আয়নাঘরে যেতে হবে। যেখানে জমিদার স্ত্রী শেষবার আয়নায় তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব হারিয়ে ফেলেছিলেন।”
অস্মিতা নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফিসফিস করে বলে, “আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি… আমরা একা নই এই বাড়িতে।”
হঠাৎ, সেই আয়নাটা, যেটা ঘরের এক কোণে রাখা ছিল, তার ভেতর দিয়ে অর্ক নিজের প্রতিবিম্বকে দেখল—কিন্তু সে যেখানে দাঁড়িয়ে, তার চেহারা সেখানে নেই!
আর ঠিক তখনই আয়নার কাঁচে ভেসে উঠল একটি বাক্য— “চন্দ্রমল্লিকা ফিরে এসেছে।”
বিকেল নামার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের আলো নিভে গেল যেন কেউ রোদ কেটে নিয়ে গেল। বৃষ্টির আভাস নেই, তবু আকাশে কালো মেঘের ছায়া। “মৃত্যু মঞ্জিল”-এর পরিবেশ আগের থেকে আরও গম্ভীর হয়ে উঠল।
সৌমিত্র সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,“আজ রাতে আমরা দোতলার আয়নাঘরে যাব। এই বাড়ির যত রহস্য, সম্ভবত তার কেন্দ্র ওটাই।”
অস্মিতা বলল, “আজ সকাল থেকে আমার শরীরটা অদ্ভুত লাগছে। বুক ধড়ফড় করছে… জানি না কেন যেন মনে হচ্ছে, আমরা যাকে খুঁজছি, সে আমাদের অনেক আগেই খুঁজে পেয়েছে।”
দয়াল ধীর কণ্ঠে বলে উঠল, “গতকাল রাতে আমি আয়নায় একজন মেয়েকে দেখেছিলাম… ওর চোখ ছিল লাল। আমার মনে হয় ও-ই চন্দ্রমল্লিকা।”
সবার মুখ থমথমে হয়ে গেল।
রাত ১০টা – দোতলার আয়নাঘর।চারজন মোমবাতি হাতে উঠে গেল দোতলায়। করিডোরটা লম্বা আর সরু, দেয়ালের দু’পাশে সাদা চাদরে ঢাকা আসবাবপত্র। প্রতি পদক্ষেপে কঁকিয়ে উঠছে কাঠের মেঝে। সবশেষে তারা এসে দাঁড়াল সেই ঘরের সামনে—দরজার গায়ে লাল রঙে আঁকা: “প্রবেশ নিষেধ – আয়নার পেছনে মৃত্যুর মুখ।”
সৌমিত্র দরজা খুলল। ধীরে ধীরে শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে গাঢ় ধূসর রঙের ঘর, দেওয়ালজুড়ে বিশাল বিশাল আয়না। কেউ দাঁড়ালে নিজের প্রতিবিম্ব যেন অসংখ্যবার দেখা যায়।
তারা ঘরে ঢুকল। বাতাস ঠান্ডা, কিন্তু থমথমে। হঠাৎ অস্মিতা আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই আয়নাটা… আমি এর ভেতরে একটা মুখ দেখছি।”
অর্ক বলে উঠল, “আয়নাগুলো স্বাভাবিক না। এরা শুধু প্রতিবিম্ব দেখায় না… ওরা মনে হয় ভিতরের কিছু ফিরিয়ে দেয়।”
ঠিক তখনই একটা আয়নার কাচে ফাটল দেখা দিল—টুকরো হয়ে গেল, কিন্তু কোন শব্দ নেই! আয়নার ফাটলে একটা হাত দেখা গেল—সাদা, রক্তমাখা এক নারীর হাত, যেন কাউকে টেনে নিতে চাইছে ভেতরে!
সৌমিত্র দ্রুত বলল, “পিছিয়ে যাও! কেউ আয়নার সামনে দাঁড়াবে না!”
কিন্তু ততক্ষণে দয়াল যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির টানে একটা আয়নার সামনে চলে গেছে। সে কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলল, “ও বলছে—আমাকে ছাড়া তার মুক্তি নেই… আমি ওর প্রতিশোধ!”
হঠাৎ মোমবাতিগুলো নিভে গেল। ঘর ভরে গেল অন্ধকারে।অন্ধকারে গলগল করে রক্তের শব্দ! চারদিক থেকে ভেসে এলো একসঙ্গে হাজারো ফিসফিসানি— “আমার নাম চন্দ্রমল্লিকা… আমি এখানেই থাকি… আয়নার ভিতর… খুঁজছি আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ…”
মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল কিছু—কে যেন কিছু টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অর্ক টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে পেল—একটা লাল রঙের রক্তমাখা ফ্রকের ছায়া হেঁটে যাচ্ছে ঘরের ভেতর দিয়ে!
দয়াল হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “আমার পায়ে কে টান দিচ্ছে! কেউ আমাকে নিচে টানছে!”
সবাই মিলে টেনে তাকে বাইরে নিয়ে এলো। দরজা বন্ধ হতেই ঘরের ভেতর পিয়ানোর সুর বাজতে লাগল—কিন্তু সেই ঘরে তো কোনও পিয়ানো নেই! ঘটনার পর চারজনই নীচে ফিরে আসে। দয়ালের কাঁধে আঁচড়ের দাগ—যেন নখে কেটে দেওয়া হয়েছে।
অর্ক তখন ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠাগুলো পড়তে শুরু করল—যেখানে জমিদার সুধাংশু লিখেছে, “আমার মেয়ে চন্দ্রমল্লিকা অদ্ভুত সব কথা বলত—সে নাকি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। একদিন বলল, ‘বাবা, তোমরা সবাই মারা যাবে আয়নার ভেতর’। আমি ওকে গলা টিপে হত্যা করি, আর দেহ লুকিয়ে রাখি আয়নাঘরের পেছনে। আয়নাটি অভিশপ্ত হয়ে গেল সেই দিন থেকে…”
তারা বুঝে যায়, চন্দ্রমল্লিকার আত্মা এখনও সেই আয়নার ঘরে বন্দি… কিন্তু তার অভিশাপ ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে…
রাত বাড়ে। চারজন যখন নিচতলার ঘরে বিশ্রামে যাচ্ছে, তখন অস্মিতা চুপিচুপি আয়নার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে—দরজার ফাঁক দিয়ে একজন তাকিয়ে আছে।
এক জোড়া চোখ, রক্তরঙা, জ্বলজ্বল করছে। সে ফিসফিস করে বলে উঠল, “আমার খেলা এখনও শুরু হয়নি…”
সকালের আলো বাড়ির ভেতর পড়লেও তার উজ্জ্বলতা যেন এখানে পৌঁছায় না। “মৃত্যু মঞ্জিল”-এর প্রত্যেকটা কোণ আজ আরও বেশি রহস্যময়, আরও বেশি বোবা।
দয়াল সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। সে ঘুমের মধ্যে বারবার একই স্বপ্ন দেখেছে—একটা মেয়ের লাশ আয়নার মধ্যে আটকে আছে, সে বারবার বলছে, “আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করো… আমার মৃত্যুদিনে এসো… নয়তো তোমরাও আমার ভাগ্য বরণ করবে।”
সকাল ৯টা। অস্মিতা আর অর্ক ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা পুরনো ড্রয়ার খুলল। ভেতরে একটা মোটা খামের মধ্যে কিছু আছে। খামটি খুলতেই চারটি নিমন্ত্রণপত্র বের হল।
সবগুলোতেই লেখা— “আপনাকে আন্তরিক আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে—চন্দ্রমল্লিকা দেবীর ষোড়শী মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১৩ই অশ্বিন, রাত ১২টা, আয়নাঘর।”
“স্থান: মৃত্যুমঞ্জিল”
চিঠির নিচে স্বাক্ষর: “সুধাংশু রায়চৌধুরী”—চন্দ্রমল্লিকার পিতা, এই বাড়ির প্রাক্তন জমিদার!
অর্ক হতভম্ব হয়ে বলল, “এই চিঠি কীভাবে সম্ভব? জমিদার তো অনেক আগেই মারা গেছেন! তাহলে এই আমন্ত্রণপত্র… কে পাঠালো?”
সৌমিত্র টেবিলে রাখল চিঠিগুলো। ঠিক তখনই এক ঠান্ডা হাওয়া ঘরের জানলা খুলে দিল হঠাৎ করে। টেবিলের ওপর রাখা চিঠিগুলো উড়ে গিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে পড়ে গেল। আর সেখানে দেখা গেল—মাটিতে পড়ে থাকা চিঠিগুলোর কালি রক্তে ভিজে যাচ্ছে…!
দয়াল আজ সারাদিন একা একা বসে থাকে। সে কারও সঙ্গে কথা বলছে না, শুধু ফিসফিস করে নিজের মনে বলছে, “ও বলেছে আমাকে আসতে হবে… ও আমায় ডাকছে… আয়নার পেছনে আমার জন্য অপেক্ষা করছে…”
রাতে হঠাৎ সে চুপিচুপি উঠে যায়, কারও চোখে না পড়ে। তার পায়ে বাঁধা আছে আয়নার ঘরের দড়ি। সে যেন টানা টানা হেঁটে যাচ্ছে—মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
অস্মিতা সেই শব্দ শুনে উঠে পড়ে। দয়ালকে দেখতে না পেয়ে সবাই মিলে খুঁজতে শুরু করে। তখনই অর্ক বলে উঠে,
“আমরা আয়নাঘরের দরজাটা বন্ধ করে রেখেছিলাম… সেটা খোলা কেন?”
চারজনে দ্রুত ছুটে যায়। দরজা ঠেলে তারা দেখে—দয়াল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, আয়নার কাচে হাত রেখেছে।।হঠাৎ আয়না যেন জল হয়ে যায়, আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে সেই পরিচিত ভয়াল কণ্ঠস্বর— “তোমরা নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছো… এবার উৎসব শুরু হবে…” দয়ালকে আয়নার ভেতর টেনে নেওয়া শুরু হয়।
অস্মিতা ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে। সবাই মিলে টেনে টেনে কোনওরকমে তাকে বের করে আনে। আয়নার কাচ আবার শক্ত হয়ে যায়।
দয়াল চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, “আমায় যেতে দাও! ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে… ও বলেছে আমি ছাড়া ওর মুক্তি নেই!”
তারা নিচে ফিরে এসে আবার সেই পুরনো ডায়েরি ঘাঁটতে থাকে। সেখানে জমিদার সুধাংশুর হাতে আঁকা একটি ছবি দেখতে পায়—একটি ষোড়শী কন্যা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, পরনে লাল রক্তরঙা শাড়ি, মুখে এক গভীর বিষাদের ছায়া।
সেই ছবির নিচে লেখা— “আমার মেয়ের মৃত্যু হয়নি… সে অপেক্ষা করছে… ১৩ই অশ্বিন, বারবার ফিরে আসে, কারণ তার আত্মা কখনও প্রস্থান করতে পারেনি…”
অর্ক ফিসফিস করে বলে, “আজ ১৩ই অশ্বিন… আর রাত ১২টায় আয়নাঘরে নিমন্ত্রণ রক্ষার সময়!”
রাত বাড়ে। চারজন বসে থাকে নীচে। কিন্তু ঠিক রাত ১২টার সময়, দোতলা থেকে একসঙ্গে মিউজিক বাজতে থাকে—পুরনো হারমোনিয়ামের সুর। সেই সুরে যেন এক মৃত্যু-উৎসব শুরু হয়।
একটি মেয়ে কণ্ঠে গান ভেসে আসে—“জল পড়ে পাতা নড়ে, চন্দ্রমল্লিকার প্রাণ যায় ঘরে…”
তারা তাকিয়ে দেখে, আয়নার ঘরের দরজা আপনাতেই খুলে গেছে। মাঝরাতের শীতল বাতাসে ভেসে আসে এক অচেনা গন্ধ—রক্ত আর রজনীগন্ধার মিশেল।
সৌমিত্র ফিসফিস করে বলল, “আমরা এখন শুধুই অতিথি নই… আমরা ওর খেলার অংশ হয়ে গেছি…”
রাত ১২টা ৫ মিনিট। আয়নাঘরের দরজা হঠাৎ খুলে গেল। ঘরের ভেতর থেকে হিমশীতল বাতাস ছড়িয়ে পড়ল পুরো বাড়িতে। গায়ে কাঁটা দেওয়া সুর বাজছে—হারমোনিয়ামে এক অজানা সুরেলা গলা গাইছে: “রক্তে লেখা নিমন্ত্রণ, আত্মায় লেখা নাম—স্বাগত তোমাদের, উৎসবে তোমার দাম…”
চতুষ্কোণ আয়নাঘর, চারটে দেয়ালের চারদিকজুড়ে আয়না। ঠিক মাঝখানে পড়ে আছে রক্তরাঙা ফুলের মালা আর ধূপকাঠির ধোঁয়া। মনে হচ্ছে, এখানে কেউ সত্যিই পুজো করছে, কারও আত্মাকে জাগিয়ে তোলার পুজো।
অস্মিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। ঘরের মাঝে রাখা আয়নার সামনে তখন স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে একটি মেয়ের অবয়ব—চন্দ্রমল্লিকা! পরনে লাল শাড়ি, সিঁথিতে সিঁদুর, চোখে জ্বলে উঠছে চাপা প্রতিশোধের আগুন।
চন্দ্রমল্লিকার আত্মা কথা বলে উঠে, তার ঠোঁট নাড়ছে না, কিন্তু তাদের মস্তিষ্কে সেই কণ্ঠ বাজছে— “আমার মৃত্যু হয়নি… আমার আত্মা বন্দি এই আয়নার মধ্যে… আমি মুক্তি চাই… আর তা সম্ভব একমাত্র যদি… সত্যি প্রকাশ পায়…”
সৌমিত্র ভয়ে ফিসফিস করে, “তুমি কী বলতে চাইছো? কে দায়ী তোমার এই অবস্থার জন্য?”
চন্দ্রমল্লিকা তাকায়… তার হাত উঠে যায় অর্কের দিকে।
অর্ক হতবাক, “আমি? আমি তো… আমি জানিই না তোমার কিছু!”
চন্দ্রমল্লিকা বলল— “তুমি নয়, তোমার পূর্বপুরুষ… যার রক্ত তোমার শরীরে… তারই কারণে আমার জীবন শেষ হয়েছিল এক নির্মম বিশ্বাসঘাতে…”
প্রাচীন সত্যের উন্মোচন! ঘরের এক কোণায় থাকা পুরনো দেওয়ালে তখন এক অদ্ভুত জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সেই দেয়ালে গোপন খোপে ছিল আরেকটি ডায়েরি—চন্দ্রমল্লিকার ডায়েরি।
অস্মিতা পড়ে শোনায়— “আমার প্রেম ছিল একজন বাউলের সঙ্গে। কিন্তু বাবা সুধাংশু রায়চৌধুরী এই প্রেম মেনে নেয়নি। একদিন সেই বাউল যুবককে কৌশলে ডেকে এনে খুন করে… আর আমাকে বন্দি করে এই ঘরে, যেখানে আমি আত্মহত্যা করি না, বরং মরে যেতে বাধ্য হই…”
এই ডায়েরির নিচে লেখা— “আমার আত্মা থাকবে বন্দি আয়নায়, যতক্ষণ না কেউ স্বীকার করে নেয় এই পাপ, যতক্ষণ না কারও রক্ত দিয়ে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়…”
ঠিক তখনই আয়নার সব কাচের মাঝে দয়ালের প্রতিবিম্ব দেখা যায় না… অন্য এক ছায়া সেখানে দাঁড়িয়ে।চন্দ্রমল্লিকার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। সে গর্জে ওঠে— “ও নয় দয়াল… ও হল আমার পিতার ছায়া… পুনর্জন্ম নিয়ে এসেছে এই মৃত্যু মঞ্জিলে…”
দয়ালের চোখ তখন ফাঁকা, ঠোঁটে হালকা হাসি। সে বলতে থাকে— “আমি এসেছি… আমার কাজ শেষ করতে… কেউ আমার মেয়ের অপমান সহ্য করলে আমি আবার তাকে মেরে ফেলব…”
তখনই ঘর ঝাঁকুনি খেতে থাকে। মাটিতে ফাটল ধরছে। ধোঁয়ার মধ্যে চন্দ্রমল্লিকার আত্মা চিৎকার করে বলে ওঠে— “এই উৎসবে এবার আমি নিজেই বলি চাই… সত্য প্রকাশ না হলে, কেউ বাঁচবে না…”
চন্দ্রমল্লিকার আত্মা বলে, “তোমাদের সামনে এখন তিনটি পথ— এক, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ নিজের রক্ত দিয়ে আমার মুক্তি দেবে। দুই, কেউ স্বীকার করবে—সে এই বংশের উত্তরাধিকার এবং তার পূর্বপুরুষের পাপের দায় তারই। অথবা… আমি তোমাদের সবাইকে নিয়ে যাব আমার আয়নাজগতে—চিরকাল বন্দি রাখব…”
অর্ক কিছু না বলেই এগিয়ে আসে। সে নিজের আঙুল কেটে আয়নার ওপর রক্ত ছিটিয়ে দিয়ে বলে, “আমি এই পাপের উত্তরাধিকার… আমি দায় নিচ্ছি, কিন্তু তোমার আত্মা যেন এবার শান্তি পায়…”
চন্দ্রমল্লিকার মুখে একটু প্রশান্তির ছায়া। তার কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়— “তুমি স্বীকার করলে… আমি এবার মুক্ত…”
তার শরীর কুয়াশার মতো ভেঙে যায়, আর আয়নার কাচে দেখা যায় না আর কোনও ছায়া।
সবাই হাঁপিয়ে পড়ে। বাড়িতে আবার আলো ফিরে আসে, আয়নাঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তারা চারজন নীচে নেমে এসে বসে পড়ে। কিন্তু তখনই দয়াল, যার শরীরে ‘সুধাংশুর ছায়া’ ভর করেছিল, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।
সে ফিসফিস করে বলে, “একটা উৎসব শেষ… এবার আমার পালা… আবার কেউ আসবে, আবার শুরু হবে নতুন খেলা… মৃত্যু মঞ্জিল কি কখনও ঘুমায়?”
সবাই স্তব্ধ।
ভোর ৪টা। বাইরে গা-ছমছমে ঠান্ডা, ঘন কুয়াশা, যেন রাতের আঁধার এখনও পুরোপুরি কাটেনি। পাখিরা ডাকছে না, অথচ ঘরের ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে কোনো এক প্রাণীর হালকা হাঁসফাঁস।
অস্মিতা ঘুম ভেঙেই শুনতে পায় কারা যেন নীচের ঘরের মেঝেতে হাঁটছে—চাপা পায়ের শব্দ, যেন কেউ মাটির তলায় হাঁটছে।
সে ধীরে ধীরে ডেকে তোলে সৌমিত্র, অর্ক আর দয়ালকে। চারজনে টর্চ নিয়ে নেমে আসে নিচতলার পুরনো গুদাম ঘরের দিকে, যেটা আগে খোলেনি কখনো।
দরজার গায়ে লাল রঙে লেখা: “এখানে প্রবেশ মানেই মৃত্যু।”
গুদামঘরের দরজা খুলতেই তীব্র পচা গন্ধে ঢোকা মুশকিল হয়ে পড়ে। ভেতরে মেঝের এক অংশে অদ্ভুত লাল দাগ—ঠিক যেন রক্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। পাশে লোহার একটা মোটা দরজা, যেটা বাইরের চোখে গুদামের অংশই নয়।
সেই লোহার দরজা খুলতেই তাদের চোখে পড়ে এক গোপন কুঠুরি। তার দেয়ালের গায়ে নানা ছাপ—নখের আঁচড়, রক্তের দাগ, আর অনেক পুরোনো পোড়া মোমবাতির কালো চিহ্ন।
হঠাৎই অর্ক চিৎকার করে ওঠে, “দ্যাখো! এই দেয়ালের গায়ে আঁকা ছবিটা…!”
এক অদ্ভুত চিত্র: চারজন মানুষের ছবি—অদ্ভুতভাবে তাদের চেহারা মিলে যায় অর্ক, অস্মিতা, সৌমিত্র আর দয়ালের সঙ্গে। নিচে লেখা: “তোমরা চারজনই ফিরে এসেছ… সময় হয়েছে নতুন বলির…”
ঘর হঠাৎ কেঁপে ওঠে। দরজা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যায়। চারিদিকে অন্ধকার। একমাত্র মাটির নিচ থেকে আলো ছড়াতে থাকে—সেই রক্তে ভেজা মেঝে যেন ধীরে ধীরে লাল হয়ে জ্বলতে শুরু করে।
শব্দ ভেসে আসে কুঠুরির ভেতর থেকে, “আগে এখানে অনেককে বলি দেওয়া হয়েছিল… এবার তোমাদের পালা…”
দেয়ালের ছায়াগুলি নড়ে ওঠে। তাদের চেহারা নেই, কেবল চোখ। ছায়ারা যেন ঘিরে ধরছে চারজনকে।
অস্মিতা বলে ওঠে, “এটা একটা ফাঁদ—এই ঘর রক্তের খিদে মেটায়… কিন্তু যদি আমরা ভয় না পাই, কিছু করতে পারবে না।”
অর্ক চিৎকার করে, “ভয় তো পেতেই হচ্ছে…! ছায়াগুলো এগিয়ে আসছে!”
তখনই দয়ালের মাথা ঘুরে ওঠে। সে কেঁদে ওঠে,
“আমার মনে পড়ছে… আমিই সুধাংশু রায়চৌধুরীর পূর্ণ অবতার… আমারই হাতে চন্দ্রমল্লিকার প্রেমিককে বলি দেওয়া হয়েছিল এই ঘরে… আমি পাপ করেছিলাম, আমি… আমি-ই এই ঘরকে তৈরি করেছিলাম…!”
তার চোখ তখন অস্বাভাবিক লাল। সৌমিত্র বলে, “তা হলে এই ঘর তোমার কথা শোনে! তুমি যদি কিছু বলো…”
দয়াল হঠাৎ নিজের হাতে থাকা টর্চটা দেয়ালের ওপর ছুঁড়ে মারে, আর বলে,”আমি আমার পাপ স্বীকার করি! এই ফাঁদ বন্ধ হওয়া উচিত… এই শিকল আমি ভাঙছি… আজকের পর থেকে আর কোনো আত্মা বলি হবে না!”
তখনই এক গর্জনের শব্দে ঘর কেঁপে ওঠে, ছায়ারা ছিটকে পড়তে থাকে। মেঝের রক্ত শুকিয়ে যেতে থাকে। সেই অদ্ভুত আলো নিভে যায়। দরজা খুলে যায় আপনাতেই। চারজন কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে কুঠুরি থেকে। তারা বুঝতে পারে—এটা কোনো সাধারণ বাড়ি নয়, এখানে পাপ, প্রতিশোধ, আত্মা আর ইতিহাস একসঙ্গে মিশে গেছে।
এই বাড়ির প্রতিটা দেয়াল রক্ত চায়, প্রতিটা কুঠুরি অতীত চায় ফিরে পেতে।
দয়াল তখন শান্তভাবে বলে, “আমার ভেতরে এখনও সুধাংশু আছে… আমি জানি, এ কেবল শুরু… মৃত্যু মঞ্জিল এখনও জাগছে…”
রাত ১২টা। চাঁদ অদৃশ্য। বাতাস নিস্তব্ধ। পাতা নড়ে না। কুকুর ডাকে না। যেন সমস্ত প্রকৃতি থেমে গেছে।
অস্মিতা, অর্ক, সৌমিত্র আর দয়াল — চারজনে ভেবেছিল তারা মুক্ত হয়েছে অভিশাপ থেকে। কিন্তু গভীর রাতে আবার জেগে ওঠে মৃত্যু মঞ্জিল।
ঘড়ির কাঁটা ১২টা বাজতেই, বাড়ির ঠিক মাঝখানের ঘরের ভেতর থেকে শোনা যায় নারীকণ্ঠের ভয়াল হাহাকার, “আমায় বলি দেওয়া হয়েছিল… কিন্তু আমি এখনও মুক্তি পাইনি…”
চন্দ্রমল্লিকা নয়, অন্য কেউ… চারজনে ছুটে আসে সেই মাঝখানের ঘরের দিকে, যেটা সুধাংশু রায়চৌধুরীর শয়নকক্ষ ছিল একসময়। ঘরটি বাইরে থেকে বহু বছর ধরে বন্ধ। কেউ খোলেনি।
কিন্তু আজ দরজাটা খুলে গেছে আপনাতেই। ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, এক বিশাল আয়না—পুরনো, ধুলোমাখা, আর তার সামনে বসে আছে এক নারী… তার পিঠ দেখা যাচ্ছে। চুল লম্বা, সাদা কাপড়, একহাতে মোমবাতি।
অস্মিতা বলে ওঠে, “চন্দ্রমল্লিকা?”
নারীটি ঘুরে তাকায়। না! এই মুখ চন্দ্রমল্লিকার নয়। তার চেহারায় কোনও দুঃখ নেই—আছে হিংসা, খিদে আর পিশাচি উন্মাদনা।
সে বলল, “আমি চন্দ্রমল্লিকা নই। আমি তার আগে ছিলাম। এই জমিদারবাড়ির প্রথম বলি। আমার মৃত্যুর পরই জন্ম নিয়েছিল এই অভিশাপের। আমি একবার মরেছি, কিন্তু এখন আমি পিশাচ হয়ে বেঁচে আছি… আর এখন চাই আরও রক্ত… নতুন প্রাণ… নতুন বলি!”
হঠাৎ ঘরের আয়না জ্বলতে শুরু করে। দেখা যায়, আয়নার ভেতর চারজনের প্রতিচ্ছবি নেই। তার বদলে চারটে ঝুলন্ত মৃতদেহ।
অর্ক চিৎকার করে ওঠে, “এটা ভবিষ্যৎ…? আমাদের এভাবেই মরতে হবে?”
পিশাচী হাসে, “না… যদি কেউ একজন নিজের ইচ্ছায় বলি দেয়… তাহলে বাকিরা বাঁচতে পারে…”
তখনই দয়াল সামনে এগিয়ে আসে। তার চোখে আবার সেই সুধাংশুর ছায়া। সে বলে,“আমি-ই তো পাপ করেছি, আমি-ই বলি দেব। আমার মৃত্যুতে যদি অভিশাপ শেষ হয়, আমি রাজি…”
সে যখনই সামনে এগিয়ে যায়, আয়নার ভেতর থেকে একটি কালো হাত বেরিয়ে আসে, তাকে টেনে নিতে চায়। কিন্তু ঠিক সেই সময় অস্মিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “না! তুমি মরলে অভিশাপ শেষ হবে না। ও পিশাচী শুধু রক্ত চায়… আত্মত্যাগ নয়। আমাদের এক হতে হবে। একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে।”
চারজনে হাতে হাত রাখে। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পবিত্র কিছু মন্ত্র জপতে থাকে, যা তারা আগের রাতে গ্রন্থ থেকে জেনেছিল।
পিশাচী তখন আছড়ে পড়ে দেয়ালে, চিৎকার করে বলে, “তোমরা সবাই মরবে! কেউ ছাড়া পাবে না! এ ঘর আমার! এখানে আমারই রাজত্ব!”
হঠাৎ আয়নাটা ফেটে যায়। আলোয় ভরে ওঠে ঘর। পিশাচীর শরীর গলে যেতে থাকে। মোমবাতির আলো নিভে যায়। এক বিকট শব্দে ভেঙে পড়ে ঘরের ছাদ। মেঝে চিরে যায়। আর মাঝখান থেকে উঠে আসে সেই রক্তজল ছড়ানো অন্ধকার, যা গিলে ফেলতে চায় পুরো “মৃত্যু মঞ্জিল”কে।
রাত শেষ, সকাল হয়ে গেছে। চারজনের জ্ঞান ফেরে দোতলার ঘরে। বাইরে সূর্য উঠেছে। পাখিরা ডাকছে।
পাড়ার মানুষ বলছে,“কাল রাতে নাকি বাড়িটা যেন কেঁপে উঠেছিল…”
অস্মিতা, অর্ক, সৌমিত্র আর দয়াল—বুঝতে পারে, তারা ফিরে এসেছে মৃত্যুর মুখ থেকে।
কিন্তু সেই আয়নার একটা ভাঙা টুকরো, যা তারা সাথে নিয়ে এসেছিল, হঠাৎ অন্ধকার হয়ে ওঠে। তাতে আবার দেখা যায় সেই নারীর ছায়া…
সে বলছে: “আমি এখনও আছি। আবার দেখা হবে…”
ঘটনার পরদিন সকালবেলা, অস্মিতা, অর্ক, সৌমিত্র আর দয়াল বসে ছিল বাড়ির পেছনের বাগানে। পাখির ডাক, বাতাসের স্পর্শ—সব কিছু স্বাভাবিক, কিন্তু তাদের চোখে ঘুম নেই। মন ঘোরলাগা।
দয়াল ধীরে বলে, “তোমরা কি দেখেছিলে সেই আয়নায়, শেষ মুহূর্তে?”
অস্মিতা বলে, “হ্যাঁ। একটা পুরুষের ছায়া দাঁড়িয়ে ছিল তার পাশে। সেই পিশাচীর পাশে। তার চোখ ছিল রক্তবর্ণ, আর কপালে ত্রিকোণ আঁকা। খুবই অদ্ভুত লাগছিল তাকে। যেন সে অনেক পুরনো…”
অর্ক বলে ওঠে,“আমি ভেবেছিলাম অভিশাপ চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে শেষ… কিন্তু না, কেউ আছে, যার ক্ষমতা তার থেকেও ভয়ংকর।”
বাড়ি ত্যাগ করার আগে, অস্মিতা গিয়ে পড়ে সুধাংশু রায়চৌধুরীর পুরনো ঘরে, যেখানে তারা প্রথম খুঁজে পেয়েছিল সেই দৈব খাতা।
অবিশ্বাস্যভাবে, খাতাটা আবার সেই পুরনো টেবিলে পড়ে আছে। আবার নতুন এক পৃষ্ঠা খুলে গেছে, যেখানে লেখা,
“তোমরা শুধু দরজা খুলেছ। ভিতরে প্রবেশ করনি এখনও। মৃত্যু মঞ্জিল শুধু একটি প্রবেশদ্বার… শেষ অভিশাপ এখনও মুক্ত নয়। সে ঘুমিয়ে আছে, অন্ধকারের গর্ভে। যেদিন চাঁদ আর রক্ত এক হবে, সে জেগে উঠবে…”
অস্মিতার হাত কেঁপে ওঠে। এই লেখা কার? সুধাংশুর তো নয়…
খাতার নিচে লেখা— “লেখক: অগ্নিবীর রায়চৌধুরী
(১৭১০ – ???)”
অস্মিতা সেই নাম প্রথম শুনেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আসে— এই বাড়ির প্রাচীনতম ছবি যেখানে একজন বৃদ্ধ মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন, তার নামের নিচে লেখা ছিল — ‘অগ্নিবীর রায়চৌধুরী, প্রতিষ্ঠাতা’।
তাহলে সে এখনও বেঁচে আছে? তাহলে সে-ই কি সেই ছায়ামূর্তি? তারা ঠিক করে, এখনই ছেড়ে যাবে বাড়ি। কিন্তু যাওয়ার ঠিক আগে পুরনো মালিদের একজন এসে বলে, “বাবু, পেছনের পুরনো কূপটা কখনও খুলবেন না। ওটাই বাড়ির শয়তানের আসল ঘর…”
চারজনে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় সেই কূপের দিকে। ঝোপঝাড় সরিয়ে দেখে, কূপে ধাতব ঢাকনা। আর তাতে খোদাই করা এক পিশাচরূপী মুখ।
সৌমিত্র গুটিয়ে নেয় পা, “এই কূপে কিছু আছে… আমি নিশ্চিত, এইটাই সেই ‘চিরন্তন অভিশাপ’ যেটা এখনও ঘুমিয়ে আছে।”
চারজন সিদ্ধান্ত নেয়, তারা এই রহস্যকে নিয়ে কিছু বলবে না বাইরের কাউকে।
দয়াল বলে, “যদি কেউ একদিন কৌতূহলবশত আসে এই বাড়িতে, আমরা চাই না সে জানুক অভিশাপ এখনও ঘুমিয়ে আছে। ভয়ই একমাত্র প্রতিরোধ— তাই আমরা ‘মৃত্যু মঞ্জিল’কে আগের মতোই ভয়ঙ্কর করে রেখে যাব।”
তারা চারপাশে ছড়িয়ে দেয় গুজব—ভূত, অদৃশ্য কান্না, চন্দ্রমল্লিকার প্রেতাত্মা—যাতে কেউ আর সাহস না করে ঢুকতে।
বছর দশেক পর… একটা কালো গাড়ি এসে থামে ‘মৃত্যু মঞ্জিল’-এর সামনে। এক যুবক নেমে আসে, হাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি। তার নাম—অর্নব চক্রবর্তী, একজন প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর।
সে হাসে আর বলে, “তৈরি হও, মৃত্যু মঞ্জিল… তোমার অভিশাপকে জাগাতে এসেছি আমি…”
পেছনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আর পেছনের সেই কূপের ধাতব ঢাকনায় ধীরে ধীরে ফাটল ধরছে… ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে গর্জন… অগ্নিবীর জেগে উঠছে…
শেষ

ছবি এআই
© পিনাকী রঞ্জন পাল