অলৌকিক গল্প : অন্ধকার দেশ


লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল

আকাশে ধূসর মেঘের বুক চিরে শহরের কৃত্রিম আলো গড়িয়ে পড়েছে। কলকাতা শহর তখনো পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েনি, কিন্তু তার চিরচেনা কোলাহল অনেকটাই স্তিমিত। অফিসপাড়ার উঁচু উঁচু কাঁচের দালানগুলো থেকে শেষ ল্যাপটপের আলো নিভে আসছে। আর এই আলো-আঁধারির মাঝে, সূর্য চৌধুরী প্রতিদিনের মতোই হেঁটে ফিরছে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। সে একজন পুরকৌশলবিদ, বয়স ত্রিশ ছুঁইছুঁই। তার জীবনটাও তার পেশার মতো নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত- সকালে ঘুম থেকে ওঠা, নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে যাওয়া, কাজ শেষ করে ফেরা, আর রাতে নিঃসঙ্গতায় ডুবে যাওয়া। বাইরের এই সুশৃঙ্খল ছদ্মবেশের আড়ালে তার ভেতরে এক অপ্রকাশিত শূন্যতা লুকিয়ে আছে, যা সে নিজেও পুরোপুরি বুঝতে পারে না।

আজকের রাতটা অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি ভারী মনে হলো সূর্যের। বাতাসে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যা শহরের রাতের বাতাসের সঙ্গে বেমানান। রাস্তার ধারের বাতিগুলো জোনাকির মতো জ্বলছে-নিভছে, যেন কোনো সংকেত দিচ্ছে। সূর্য তার ঘড়ি দেখল, রাত এগারোটা। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। সহকর্মীর জরুরি অনুরোধে একটা ড্রয়িং শেষ করতে গিয়ে এই দেরি। সে একমনে হেঁটে চলেছে, তার ফ্ল্যাট থেকে মাত্র দুটি গলি দূরে।

হঠাৎ করেই পরিচিত রাস্তাটা অচেনা মনে হলো। রাস্তার মোড় ঘুরতেই তার চোখে পড়ল, একটা হালকা কুয়াশার আস্তরণ পুরো এলাকাটাকে ঢেকে রেখেছে। এটা কোনো স্বাভাবিক কুয়াশা নয়। এর রঙ হালকা নীলচে, আর এর ভেতর দিয়ে ভেসে আসছে এক ধরনের মিষ্টি, ভারী গন্ধ- ঠিক যেন ভেজা মাটির আর অজানা কোনো ফুলের মিশ্রণ। এই কুয়াশার মধ্যে পা রাখতেই সূর্যের শরীর শিরশির করে উঠল। তার মনে হলো, বাতাসটা শুধু ঠান্ডা নয়, অস্বাভাবিকভাবে ভারী। যেন কুয়াশাটা শুধু বাইরের পরিবেশ নয়, তার নিজের ভেতরের বাতাসটাকেও জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছে।

অস্বস্তি সত্ত্বেও তার পা যেন নিজে থেকে সামনে এগোতে লাগল। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টানছে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সে এগোতে থাকল, আর প্রতি পদক্ষেপে তার হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগল। একটা অজানা কৌতূহল তাকে গ্রাস করল। সে সাধারণত যুক্তি আর বাস্তবের বাইরে কিছু ভাবে না, কিন্তু আজ তার সব যুক্তি যেন ভেঙে যাচ্ছে। সে অনুভব করল, এই কুয়াশা যেন তার অবদমিত ইচ্ছাগুলোকে জাগিয়ে তুলছে, তাকে প্রলোভন দেখাচ্ছে।

এভাবেই সে চলতে চলতে কুয়াশার প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছাল। তার চোখ আটকে গেল সামনের একটি ছায়ামূর্তিতে। কুয়াশার ওপারে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ অস্পষ্ট, কুয়াশায় আবৃত। অথচ তার চোখে এক ধরনের অচেনা টান, যা সূর্যকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করল। সেই চোখ যেন তাকে অনেকদিন ধরে চেনে, তার ভেতরের সব গোপন কথা জানে। সূর্যর বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠল। তার নিঃসঙ্গ জীবনে এমন আকর্ষণীয় কিছুর উপস্থিতি সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি।

সে কি এগিয়ে যাবে? তার ভেতরের যুক্তি বলছে, এটা নিছকই মনের ভুল বা চোখের ভ্রম। কিন্তু তার মনের ভেতরের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষা তাকে সেই নারীর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার পা যেন তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। অবচেতনভাবে সে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে সেই নারীর দিকে এক পা, দুই পা করে এগিয়ে গেল। প্রতি পদক্ষেপে তার উত্তেজনা বাড়ছিল, সেই সঙ্গে বাড়ছে এক ধরনের অপরাধবোধ। সে যেন এক অদৃশ্য ফাঁদে ধরা পড়ছে, যে ফাঁদ সে নিজেও চায়নি। তার নিঃসঙ্গ জীবন যেন তার সমস্ত আবেগ আর বাসনাকে একটি অন্ধকার পথের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।


সেই রাতটা সূর্যের মনে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসা আর সেই অস্পষ্ট নারীর ছায়ামূর্তি, যার চোখে ছিল এক অদ্ভুত টান- সব মিলিয়ে এক অস্থিরতা তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। সে দ্রুত পা চালিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে এলো, যেন সে কোনো গভীর রহস্য থেকে পালিয়ে এসেছে। দরজায় চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তার শরীরটা কেঁপে উঠল। এটা ঠান্ডার কাঁপুনি ছিল না, বরং মনে হলো যেন অদৃশ্য কোনো হাত তাকে ছুঁয়ে গেল। তার হাতের তালুতে সেই স্পর্শের এক অদ্ভুত অনুভূতি, যা একইসাথে ঠান্ডা ও উষ্ণ।

সূর্য অবাক হয়ে তার হাত দেখল। কোনো কিছু নেই, কিন্তু সেই স্পর্শের রেশ তার ত্বকে রয়ে গেছে। এক মুহূর্তে তার মনে হলো, সারা শরীরের প্রতিটি কোষে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে। এক তীব্র উত্তেজনা, যা তার ক্লান্ত শরীরকে এক অভাবনীয় শক্তি আর আনন্দ জোগাল। মনে হলো সে যেন এক নতুন জীবন পেয়েছে, তার নিঃসঙ্গ, একঘেয়ে অস্তিত্বে এই আনন্দ যেন এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মুহূর্তের মধ্যেই সেই তীব্র আনন্দ এক প্রবল শূন্যতায় পরিণত হলো। সে যেন এক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিল, আর সেখান থেকে হঠাৎ করেই এক গভীর খাদে পড়ে গেল। সেই শূন্যতা এতটাই তীব্র ছিল যে তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন যেন ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল।

বিছানায় শুয়েও তার অস্থিরতা কাটল না। সেই স্পর্শের স্মৃতি তাকে বার বার তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। সে চোখ বন্ধ করল, কিন্তু মনের পর্দায় সেই নারীর মুখ আর কুয়াশার দৃশ্য ভেসে উঠল। সে জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ঘুম এলো না। মাঝরাতে তার কানে এক ফিসফিসানি শব্দ ভেসে এলো। শব্দটা এত মৃদু ছিল যে প্রথমে সে মনে করল তার মনের ভুল। কিন্তু শব্দটা স্পষ্ট হলো।

“তুমি এখনো জানো না তুমি আসলে কী চাও।” কথাটা কে বলছে? ঘরের মধ্যে তো সে ছাড়া আর কেউ নেই। ভয়ে তার বুকের ভেতর ধড়ফড় করে উঠল। সে উঠে বসে চারদিকে দেখল। সব কিছু স্বাভাবিক, কিন্তু সেই ফিসফিসানি তার কানের ভেতর ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই ফিসফিসানি তার ভেতরের সব অবদমিত আকাঙ্ক্ষাগুলোকে যেন জাগিয়ে তুলছে। তার মনে হতে লাগল, তার ভেতরে এমন অনেক কিছু আছে যা সে নিজে কখনো প্রকাশ করতে বা মেনে নিতে পারেনি। তার সুশৃঙ্খল জীবনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নিষিদ্ধ জগত, যেখানে আছে অনির্দিষ্ট কামনা, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা আর গভীর অপরাধবোধ।

রাত শেষ হলো না, কিন্তু সূর্য বুঝতে পারল তার জীবনের স্বাভাবিকতা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। সে এখন এমন এক জগতের মুখোমুখি হয়েছে, যার অস্তিত্ব সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি। সেই অদৃশ্য স্পর্শ আর ফিসফিসানি তার জীবনের স্বাভাবিক গতিকে থামিয়ে দিয়েছে। এখন থেকে তার দিন আর রাতের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। দিন হলে সে বাইরের জগতের মানুষ, কিন্তু রাত হলে সে এক অন্য জগতের যাত্রী, যেখানে তার ভেতরের অন্ধকার আর সেই অদৃশ্য শক্তির ফিসফিসানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সে নিশ্চিত হতে পারছিল না, এই অনুভুতি তার মনের ভুল, নাকি তার এক নতুন সত্তার জন্ম হচ্ছে।


শহরের এক অন্য প্রান্তে মিতালী তার প্রতিদিনের জীবন কাটায়। তার জীবনটা নিখুঁত সাজানো শো-কেসের মতো। পঁচিশ বছর ধরে বিবাহিত, স্বামীর কর্মজীবনে সাফল্য থাকলেও তাদের সংসারে এক গভীর শূন্যতা। সন্তান নেই। মিতালী নিজেকে রান্নাঘরে, ঘর গোছানোয় আর স্বামীর ছোটখাটো চাহিদা মেটানোয় ব্যস্ত রাখে। কিন্তু তার ভেতরে এক দমিত নারীত্ব হাহাকার করে। তার নিজের কোনো স্বপ্ন, কোনো আকাঙ্ক্ষা যেন এই সংসারের চার দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে গেছে। প্রতিদিন একই রুটিন, একই নীরবতা তাকে ভেতরে ভেতরে কুরে খায়। তার এই একঘেয়েমি জীবনের গভীরে সে এক মুক্তির স্বাদ খোঁজে, যা সে নিজেও জানে না।

এক সন্ধ্যায় বাজার থেকে ফিরছিল মিতালী। হঠাৎ তার পরিচিত রাস্তাটি বদলে গেল। হালকা নীলচে কুয়াশার একটি সরু গলি তার সামনে এসে দাঁড়াল। এই কুয়াশা সাধারণ কুয়াশার মতো নয়, এর মধ্যে এক ধরনের মিষ্টি, মাদকতাপূর্ণ গন্ধ ছিল। সেই গন্ধ মিতালীর মনকে অস্থির করে তুলল। সে সেই কুয়াশার দিকে এক অদ্ভুত টান অনুভব করল। যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে তার দীর্ঘদিনের দমিত আকাঙ্ক্ষার কাছে নিয়ে যেতে চাইছে। সে কুয়াশার মধ্যে পা রাখল, আর তার মনে হলো তার শরীর থেকে যেন সব ক্লান্তি, সব শূন্যতা দূরে সরে যাচ্ছে। সে এক তীব্র আনন্দ অনুভব করল। কুয়াশা ভেদ করে সে হাঁটতে শুরু করল, কিন্তু তার মনে কোনো ভয় ছিল না। শুধু এক গভীর কৌতূহল।

প্রায় একই সময়ে, শহরের আরেক অন্ধকার গলিতে, শঙ্করের দিন শুরু হয়। তার জীবন সূর্যের আর মিতালীর জীবনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে শহরের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যুক্ত। তার ভেতরটা হিংস্রতা আর নিষিদ্ধ আনন্দের নেশায় চালিত। টাকা, ক্ষমতা আর অপরাধের জগত তার জীবনের মূল মন্ত্র। তার জীবনে কোনো নিয়ম নেই, কোনো নৈতিকতা নেই। কিন্তু তার ভেতরেও এক গভীর অতৃপ্তি লুকিয়ে আছে। সে সবকিছু পেলেও কোনো কিছুতেই শান্তি পায় না। তার ভেতরের হিংস্রতা তাকে আরও বেশি নিষিদ্ধ জিনিসের দিকে ঠেলে দেয়। সে আরও বড় কিছু চায়, যা তাকে তার জীবনের সব শূন্যতা থেকে মুক্তি দেবে।

এক রাতে, একটি লেনদেন শেষ করে ফেরার পথে শঙ্কর সেই কুয়াশার মুখোমুখি হলো। তার সামনে থাকা রাস্তাটি হঠাৎ করেই হালকা নীল কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল। সে প্রথমে থমকে দাঁড়াল। তার ভেতরের সতর্ক মন তাকে ফিরে যেতে বলল, কিন্তু তার ভেতরের হিংস্র সত্তা তাকে এই অজানা পথে এগোতে উৎসাহিত করল। সে কুয়াশার মধ্যে পা রাখল, আর তার মনে হলো তার জীবনের সব অন্ধকার আকাঙ্ক্ষা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই কুয়াশা তাকে এক অজানা শক্তির সন্ধান দিচ্ছে।

তাদের দুজনেরই কানে ভেসে এল এক ফিসফিসানি। “তুমি এখনো জানো না তুমি আসলে কী চাও।” এই ফিসফিসানি যেন তাদের মনের গভীরের সব গোপন কথা জানে। এটা কোনো সাধারণ শব্দ ছিল না, এটা ছিল এক ধরনের সংকেত, যা তাদের ভেতরের অন্ধকারকে ডেকে তুলছিল। তারা দুজনেই সেই কুয়াশার টানে নিজেদের জীবনের সবচেয়ে বড় গোপন রহস্যের মুখোমুখি হতে চলেছে। তাদের জীবনের স্বাভাবিকতা ভেঙে যাচ্ছে। তারা বুঝতে পারল না, তারা কোথায় যাচ্ছে, বা তাদের কী পরিণতি হতে পারে। তাদের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে, যেখানে তাদের মনের ভেতরের অন্ধকারই তাদের পথ দেখাবে।


কুয়াশার সেই অভিজ্ঞতা সূর্য, মিতালী আর শঙ্করের জীবনকে রাতারাতি বদলে দিয়েছিল। দিনের আলোয় তারা তাদের স্বাভাবিক ছদ্মবেশে ফিরে আসত বটে, কিন্তু রাতের অন্ধকার তাদের মনের গোপন ইচ্ছাগুলোকে নতুন রূপে জাগিয়ে তুলত। তাদের ঘুম এখন আর শান্তির হতো না; বরং তা হয়ে উঠেছিল এক নতুন পৃথিবীর প্রবেশদ্বার।

সূর্যর স্বপ্নগুলো ছিল অদ্ভুত। সে প্রায়ই দেখত, সে এক গভীর শূন্যতায় দাঁড়িয়ে আছে, আর তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে এক অদৃশ্য স্পর্শ। সেই স্পর্শ কখনো উষ্ণ, কখনো শীতল; কখনো আনন্দের, কখনো বেদনার। এই স্পর্শ তাকে এক নতুন জগতে নিয়ে যেত, যেখানে তার নিঃসঙ্গতা এক রহস্যময় কামনার রূপ নিত। সে দেখত, যে নারী তাকে কুয়াশার মধ্যে আকর্ষণ করেছিল, তার মুখ এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তার হাসি, তার চোখের চাহনি, তার স্পর্শ- সবই বাস্তব হয়ে উঠত। সূর্য সেই স্বপ্নে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দিত। সে উপলব্ধি করতে পারছিল, তার অবদমিত কামনাগুলোই এখন এই স্বপ্নের জন্ম দিচ্ছে। জেগে ওঠার পর তার মনে হতো, সে যে জগতে বাস করছে, তা আসলে বাস্তব নয়, তার স্বপ্নজগতটাই বাস্তব।

মিতালীর স্বপ্ন ছিল মুক্তির। সে দেখত, সে তার সংসারের সব বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে উড়ন্ত পাখির মতো দিগন্তে উড়ে যাচ্ছে। তার চারপাশে কোনো দেয়াল নেই, কোনো প্রত্যাশা নেই। সে কোনো এক অজানা জায়গায় নিজের মতো করে নাচছে, গান গাইছে, হাসছে। তার স্বপ্নে সে একজন স্বাধীন নারী, যার নিজের কোনো চাহিদা নেই, শুধু মুক্তি। সে অনুভব করত, তার ভেতরের দমিত নারীত্ব এই স্বপ্নে সম্পূর্ণভাবে জেগে উঠছে। সে যে আনন্দ পেত, তা তার বিবাহিত জীবনে পাওয়া শত ভালোবাসার থেকেও বেশি মূল্যবান ছিল। এই স্বপ্নগুলো তাকে দিনের বেলায় আরও বেশি অশান্ত করে তুলত। তার মনে হতো, তার স্বামী, তার সংসার- সবই তার জন্য এক বিশাল কারাগার।

শঙ্করের স্বপ্নগুলো ছিল আরও বেশি হিংস্র। সে দেখত, তার ভেতরের কামনা আর অপরাধবোধ মিলেমিশে এক নতুন রূপ নিচ্ছে। সে নিজেকে এমন এক শহরে দেখত, যেখানে কোনো আইন নেই, কোনো নৈতিকতা নেই। তার ভেতরের হিংস্রতা তাকে সেখানে রাজা বানিয়ে দিত। সে তার শত্রুদের ওপর প্রতিশোধ নিত, আর তার ভেতরের কামনা তাকে আরও বেশি শক্তি দিত। সে এক অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠত। তার এই স্বপ্ন তাকে এক ধরনের মাদকতা দিত। সে চাইত না এই স্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে। এই স্বপ্নগুলো তাকে আরও বেশি হিংস্র করে তুলছিল।

দিনের আলোতেও তাদের আচরণে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল। সূর্য অফিসে কাজে মন দিতে পারত না। তার মন সারাক্ষণ সেই অদৃশ্য স্পর্শ আর স্বপ্নের জগতে বিচরণ করত। তার সহকর্মীরা তার পরিবর্তন লক্ষ্য করত। সে প্রায়ই একা একা হাসত, আবার হঠাৎ করেই বিষণ্ণ হয়ে যেত। তার কাজে মনোযোগ কমে গিয়েছিল।

মিতালী তার সংসারের কাজে মন দিতে পারত না। তার স্বামী তার পরিবর্তন লক্ষ্য করত। সে প্রায়ই আনমনে বসে থাকত, আর তার চোখে এক ধরনের উদাসীনতা দেখা যেত। তার স্বামী যখন তার সঙ্গে কথা বলতে চাইত, সে উত্তর দিত না। তার ভেতরটা এক ধরনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় জ্বলছিল, যা সে কাউকে বোঝাতে পারছিল না।

শঙ্কর তার কাজে আরও বেশি হিংস্র হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গীরা তার পরিবর্তন লক্ষ্য করত। সে ছোটখাটো বিষয়েই মারামারি শুরু করত। তার চোখের নিচে কালি জমেছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল এক ধরনের উন্মাদনা। সে সবসময় আরও বেশি কিছু চাইত। এই পরিবর্তনগুলো তাদের পরিচিতরা লক্ষ্য করত, কিন্তু তারা এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারত না। তারা জানত না, এই তিনজনের জীবন এক অদৃশ্য শক্তির হাতে ধরা পড়েছে, আর তাদের ভেতরের অন্ধকার তাদের এক নতুন জগতের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।


সেই গভীর রাতটা ছিল এক অমাবস্যার, যখন শহরের শেষ আলোটুকুও যেন ম্লান হয়ে গিয়েছিল। শহরের তিনটি ভিন্ন প্রান্ত থেকে সূর্য, মিতালী আর শঙ্কর এক অদৃশ্য শক্তির টানে নিজেদের অজান্তেই বেরিয়ে পড়েছিল। তাদের মন আর শরীর সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন পথে পরিচালিত হলেও, তাদের গন্তব্য ছিল একটিই। তারা নিজেদের অবচেতনে এক অজানা গন্তব্যের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। তাদের শরীর যেন আর তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না, বরং তা এক তীব্র, অবদমিত আকাঙ্ক্ষার দিকে ধাবিত হচ্ছিল। সেই আকাঙ্ক্ষা তাদের ভেতরের অন্ধকারকে আরও গভীর করে তুলছিল।

সূর্য, তার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তার মন তাকে বারবার বলছিল, সে কোথায় যাচ্ছে? কিন্তু তার শরীর তাকে থামতে দিচ্ছিল না। সে তার সেই অদৃশ্য স্পর্শের পিছু নিচ্ছিল, যা তাকে দিন-রাত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। তার ভেতরের শূন্যতা তাকে এক উন্মাদনার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।

একই সময়ে, মিতালী তার স্বামীর পাশ থেকে উঠে পড়ল। তার স্বামী তখন গভীর ঘুমে। মিতালী নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, যেন সে এক বিশাল কারাগার থেকে মুক্তি পেতে চলেছে। তার ভেতরের দমিত নারীত্ব তাকে এক নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছিল। সে জানত না সে কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু তার মন তাকে বলছিল যে, এটাই তার মুক্তির পথ।

শঙ্করও তার গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে এলো। তার ভেতরের হিংস্রতা তাকে আরও বেশি ক্ষমতার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তার মন তাকে বলছিল, সে এক নতুন জগতে যাচ্ছে, যেখানে তার সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। তার ভেতরের উন্মাদনা তাকে থামতে দিচ্ছিল না।

অদ্ভুতভাবে, তিনজনই একই সময়ে শহরের প্রাচীন এক পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে এসে পৌঁছাল। বাড়িটা ছিল শহরের পুরোনো কলকাতার ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়ির মতো। বাড়িটা অনেকদিন ধরেই পরিত্যক্ত ছিল। চারপাশের ঝোপ-ঝাড়ে আর অন্ধকার পরিবেশে বাড়িটা এক ভৌতিক রূপ ধারণ করেছিল। কিন্তু আজকের রাতে বাড়িটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। এর বিশাল লোহার গেটটি খুলে গিয়েছিল। গেটের ভেতরে কোন মানুষ ছিল না, কিন্তু ভেতর থেকে ভেসে আসছিল এক মৃদু সুর, যা তাদের মনের ভেতরের গভীরতম আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলছিল।

সূর্য, মিতালী এবং শঙ্কর একে অপরের দিকে তাকাল। তারা প্রথমবার একে অপরের দিকে দেখল। তারা অবাক হয়ে দেখল যে, তাদের অভিজ্ঞতাগুলো একই। তারা তিনজনেই সেই কুয়াশার মুখোমুখি হয়েছে, আর সেই অদৃশ্য ফিসফিসানি তাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। তাদের চোখে মুখে এক ধরনের বিস্ময়, অবিশ্বাস আর ভয়ের মিশ্রণ ছিল। তারা বুঝল যে তারা একা নয়, তাদের মতো আরও অনেকে এই গোপন শক্তির টানে পড়েছে।

দরজাটা যেন তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন তাদের ভেতরে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছিল। দরজাটি যেন নিজের থেকে খুলে গিয়েছিল, যেন ভেতর থেকে তাদের ডাকছে। তাদের ভেতরের সব আকাঙ্ক্ষা, সব দমিত অনুভূতি যেন তাদের সেই দরজার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল, আর তাদের চোখে ছিল এক ধরনের নীরব প্রশ্ন- “আমরা কি ভিতরে যাব?” কিন্তু তাদের ভেতরের অন্ধকার তখন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, তারা সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই সেই পরিত্যক্ত বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। তারা জানত না, এই দরজা তাদের কোথায় নিয়ে যাবে, কিন্তু তারা জানত যে, তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। তারা এখন এক এমন পথে পা বাড়িয়েছে, যেখান থেকে আর কোনোদিন ফেরা যাবে না।


পরিত্যক্ত বাড়ির বিশাল কাঠের দরজা পার হয়ে সূর্য, মিতালী আর শঙ্কর ভেতরে প্রবেশ করল। দরজাটা তাদের পেছনে বন্ধ হয়ে গেল এক ভয়ঙ্কর শব্দে। সেই শব্দের প্রতিধ্বনি যেন তাদের বুকের ভেতরেও বাজতে থাকল। ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বাইরের জগতের সব পরিচিতি আর সংবেদনশীলতা লোপ পেল। তাদের ইন্দ্রিয়গুলো সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। আলো-ছায়ার এক অদ্ভুত খেলায় তাদের মনে হতে লাগল, তারা যেন অন্য কোনো পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে।

চারদিকে এক গভীর নীরবতা, কিন্তু তাদের কানে ভেসে আসছে এক চাপা গুঞ্জন। দেয়ালের কোণ থেকে আসা মৃদু আলো-ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে, আর তা তাদের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই আলো-ছায়াগুলো কোনো সাধারণ আলো নয়, বরং এক ধরনের স্পর্শে পরিণত হয়েছে। সেই স্পর্শ কখনো ঠান্ডা, কখনো উষ্ণ, কখনো কোমল, আবার কখনো তীক্ষ্ণ। সূর্যর মনে হলো, অদৃশ্য কোনো সত্তা তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে, তার ভেতরের সব অবদমিত কামনাগুলোকে জাগিয়ে তুলছে। এই স্পর্শে সে এক তীব্র উত্তেজনা অনুভব করল, যা তার নিঃসঙ্গ জীবনের সব শূন্যতাকে পূর্ণ করে দিল।

মিতালী উপলব্ধি করল, ঘরের বাতাস যেন তার ভেতরে প্রবেশ করছে, আর সেই বাতাস এক ধরনের মাদকতাপূর্ণ গন্ধে পূর্ণ। সেই গন্ধ যেন তার ভেতরের দমিত নারীত্বকে জাগিয়ে তুলছে। সে অনুভব করল, তার শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণু জেগে উঠেছে, আর সেই গন্ধ তাকে এক ধরনের কামনার জগতে নিয়ে যাচ্ছে। তার মন তাকে বলছিল, সে যা অনুভব করছে, তা কোনো স্বাভাবিক অনুভূতি নয়, কিন্তু সে সেই অনুভূতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারছিল না। তার ভেতরের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এই গন্ধের মাধ্যমে আরও তীব্র হয়ে উঠছিল।

শঙ্করের কাছে এই অভিজ্ঞতা ছিল আরও বেশি তীব্র। তার মনে হলো, ঘরের প্রতিটি ছায়া যেন তার ভেতরের হিংস্রতাকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলছে। দেয়ালের প্রতিটি দাগ, প্রতিটি কোণা যেন তাকে এক নিষিদ্ধ আনন্দের জগতে নিয়ে যাচ্ছে। তার ভেতরের অপরাধবোধ আর কামনা এক ধরনের হিংস্র রূপে পরিণত হচ্ছিল। সে অনুভব করল, সে যে পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে, সেখানে তার সব নিষিদ্ধ চিন্তাগুলো বাস্তব রূপ নিতে চলেছে।

তিনজনেরই মনে হলো, তাদের নিজেদের শরীর এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তাদের প্রতিটি নিষিদ্ধ চিন্তা, প্রতিটি গোপন আকাঙ্ক্ষা যেন তাদের চোখের সামনে বাস্তব হয়ে উঠছে। সূর্য দেখল, সেই নারী যার ছায়া সে কুয়াশার মধ্যে দেখেছিল, তার মুখ এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সে যেন তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, আর সূর্য তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মিতালী দেখল, সে তার সংসারের সব বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে উড়ন্ত পাখির মতো দিগন্তে উড়ে যাচ্ছে। তার ভেতরের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এক নতুন রূপ নিচ্ছে। শঙ্কর দেখল, তার ভেতরের হিংস্রতা তাকে এক অসীম ক্ষমতার অধিকারী করে তুলেছে। সে এক নতুন জগতে প্রবেশ করেছে, যেখানে তার সব অপরাধবোধ আর কামনা এক নতুন রূপ ধারণ করেছে।

তাদের মন আর শরীর এখন বাস্তব আর অপ্রাকৃতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। তারা বুঝতে পারছিল না, তারা যা দেখছে, তা তাদের মনের ভ্রম, নাকি বাস্তব। এখানে স্পর্শ, গন্ধ, স্মৃতি- সবকিছুই এক অদ্ভুত রূপে পরিণত হয়েছে। তারা এক এমন জগতে প্রবেশ করেছে, যেখানে তাদের নিজেদের ভেতরের অন্ধকারই তাদের পথপ্রদর্শক। তাদের জীবনের স্বাভাবিকতা এখন পুরোপুরি ভেঙে গেছে, আর তারা এক নতুন অধ্যায়ের দিকে পা বাড়িয়েছে।


বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার পর বাস্তব আর অপ্রাকৃতের সীমারেখা যখন সম্পূর্ণভাবে মুছে গেল, তখন সূর্য, মিতালী আর শঙ্কর এক গভীর রহস্যের মুখোমুখি হলো। তাদের ইন্দ্রিয়গুলো বিকৃত হওয়ার পরেও, এক চাপা অনুভূতি তাদের মনে জন্ম নিল- এই অভিজ্ঞতার পেছনে একজন আছেন। একজন অদৃশ্য শক্তি, যিনি তাদের মনের গভীরতম অন্ধকার, তাদের গোপন ইচ্ছাগুলো জানেন। এই উপলব্ধি তাদের মধ্যে এক নতুন ধরনের ভয় এবং কৌতূহল জাগিয়ে তুলল। তারা নিজেদের ভেতরের অন্ধকারকে মেনে নিতে পারলেও, একজন অদৃশ্য পরিচালকের উপস্থিতি তাদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল।

সূর্য সেই ছায়া আর আলোর খেলার মধ্যে নিজেকে হারাচ্ছিল। কিন্তু তার মনের এক কোণে এক সন্দেহ জন্ম নিল। তার মনে হলো, এই অদৃশ্য শক্তি তার জীবনের সবচেয়ে গোপন আকাঙ্ক্ষাগুলোকে কীভাবে জানে? তার নিঃসঙ্গতা, তার অপূর্ণ কামনা- এগুলো তো শুধু তার মনের ভেতরের কথা। হঠাৎ তার মনে পড়ল অফিসের এক প্রাক্তন সহকর্মীর কথা। সে ছিল সূর্যের ঠিক বিপরীত, খুব প্রাণবন্ত এবং রহস্যময়। সূর্যর মনে হলো, সেই সহকর্মীই কি এই ঘটনার পেছনে? তার হাসি, তার চোখের চাহনি, তার প্রতিটি আচরণ যেন এই নতুন জগতে সূর্যের সামনে ভেসে উঠল। সূর্য ভাবতে লাগল, সেই সহকর্মী হয়তো তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারকে কোনোভাবে আবিষ্কার করে ফেলেছিল, আর সেই অন্ধকারকেই সে কাজে লাগাচ্ছে।

মিতালীও সেই একই সন্দেহে ডুবে গেল। তার ভেতরের দমিত নারীত্ব যখন মুক্তির স্বাদ নিচ্ছিল, তখন তার মনে হলো, এই মুক্তির স্বাদ তাকে কে দিচ্ছে? তার জীবনের সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা, তার মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা এবং তার নিজস্ব নারীসত্ত্বার প্রকাশ- এগুলো তার পুরোনো এক প্রেমিক জানত। সেই প্রেমিক তার জীবনে এসেছিলেন ক্ষণিকের জন্য, কিন্তু তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। মিতালীর মনে হলো, সেই প্রেমিকই কি এই রহস্যময় খেলার পরিচালক? সে হয়তো তার মনের ভেতরের সেই চাপা যন্ত্রণাগুলোকে জাগিয়ে তুলেছে, যা সে এতদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছিল। মিতালীর মনে সেই পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠল, আর তার মনে হলো, সেই স্মৃতিগুলোই এখন এক নতুন রূপে তার সামনে আসছে।

শঙ্করের কাছে এই অনুভূতি ছিল আরও তীব্র। সে তার হিংস্রতাকে এক নতুন রূপে দেখতে পাচ্ছিল, আর তার মনে হচ্ছিল, এই নতুন শক্তি তাকে কে দিচ্ছে? তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এক অন্য গ্যাং সদস্য। তাদের মধ্যেকার লড়াই ছিল ক্ষমতা আর প্রতিশোধের। শঙ্কর ভাবল, সেই প্রতিদ্বন্দ্বীই কি তাকে এই ফাঁদে ফেলেছে? সে কি তাকে তার নিজের মনের দুর্বলতাগুলো ব্যবহার করে ধ্বংস করতে চাইছে? শঙ্কর সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর হিংস্র হাসি আর তার কুটিল চোখ দেখতে পেল। তার মনে হলো, তার সমস্ত রাগ আর ঘৃণা এখন এই নতুন শক্তির জন্ম দিচ্ছে।

তিনজনই তাদের অতীত থেকে একজন পরিচিত মুখকে এই ঘটনার পেছনে দেখতে পেল, কিন্তু তাদের কেউই নিশ্চিত ছিল না। এই ছদ্মবেশের আসল সত্য অন্ধকারেই ঢাকা ছিল। তারা বুঝতে পারছিল না, তারা কি সত্যিই একজন মানুষের হাতে পরিচালিত হচ্ছে, নাকি তাদের নিজেদের ভেতরের অন্ধকারই এই সবকিছুর জন্ম দিচ্ছে। সেই মুহূর্তে তারা কোনো উত্তর পেল না। তারা শুধু জানত, তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্যের মুখোমুখি তারা হয়েছে, আর এর থেকে পালানোর কোনো পথ নেই। তাদের জীবনের সব পরিচিতি ভেঙে গিয়েছিল, আর তারা এক নতুন অধ্যায়ের দিকে পা বাড়িয়েছে।


পরিত্যক্ত বাড়ির ভেতরে তাদের মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রাম এক নতুন মাত্রা নিল। এই জগতটি তাদের ভেতরের অন্ধকারকে এতটাই শক্তিশালী করে তুলেছিল যে তারা নিজেদের আর চিনতে পারছিল না। এই বাস্তব আর অপ্রাকৃতের মিশ্রণে তৈরি জগতে, তাদের নিজেদের ইচ্ছেগুলো আর তাদের নিজেদের ছিল না। এই অন্তহীন সংগ্রামে, তিনজন তিনটি ভিন্ন পথে চালিত হচ্ছিল, আর তাদের পরিণতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

সূর্যর কাছে এই সংগ্রাম ছিল সবচেয়ে জটিল। সে তার নিজের ইচ্ছে আর সেই অদৃশ্য শক্তির ইচ্ছেকে আলাদা করে চিনতে পারছিল না। তার মনে হতো, সে যা চাইছে, তা কি সত্যিই তার নিজের কামনা, নাকি সেই অদৃশ্য সত্তা তার মনে সেই ইচ্ছেগুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে? তার ভেতরের নিঃসঙ্গতা এখন আর শুধু শূন্যতা ছিল না, বরং তা এক গভীর কামনায় পরিণত হয়েছিল, যা তাকে গ্রাস করছিল। সে নিজেকে সেই কুয়াশার মধ্যে দেখা নারীটির ছায়ার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দিচ্ছিল। সে জানত না, সে যা করছে, তা তার নিজের স্বাধীন ইচ্ছে, নাকি সে এক অদৃশ্য পুতুলনাচের পুতুল। এই অনুভূতি তাকে এক গভীর মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল না, সে কি এই খেলায় টিকে থাকতে পারবে, নাকি পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।

মিতালীর সংগ্রাম ছিল দ্বিধার। সে তার সংসারের সব বাঁধন ছিঁড়ে মুক্তির স্বাদ পেতে চাইছিল। তার ভেতরে থাকা দমিত নারীত্ব এই জগতে পূর্ণতা পাচ্ছিল। কিন্তু তার মনে এক ধরনের অপরাধবোধও কাজ করছিল। সে জানত, এই মুক্তি মানেই হয়তো তার সমাজ থেকে, তার পরিবার থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। সে তার স্বামীকে ছেড়ে এই অজানা পথে পা বাড়াতে চাইছিল না, কিন্তু তার ভেতরের আকাঙ্ক্ষা তাকে থামতে দিচ্ছিল না। সে এক ধরনের টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছিল। সে কি তার বর্তমান জীবনকে বাঁচিয়ে রাখবে, নাকি এই নতুন জগতের দিকে এগিয়ে যাবে? তার ভেতরের আলো আর অন্ধকার তখন একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছিল। সে চাইলেও এই পথ থেকে আর ফিরতে পারছিল না, আবার সে এই পথে এগিয়ে যেতেও ভয় পাচ্ছিল।

শঙ্করের কাছে এই জগত ছিল এক ধরনের মাদকতা। সে তার ভেতরের হিংস্রতা আর কামনাকে পূর্ণতা দিতে পারছিল। এই জগত তাকে এক নতুন ক্ষমতা দিচ্ছিল, যা সে তার বাস্তব জীবনে কখনো কল্পনাও করেনি। সে তার সব নিষিদ্ধ ইচ্ছেকে পূরণ করতে পারছিল, আর সে এই নেশায় সম্পূর্ণরূপে ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু তার মনের এক কোণে এক ভয় কাজ করছিল। সে মাঝে মাঝে টের পাচ্ছিল, সে তার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। তার ভেতরের হিংস্রতা তাকে এমন সব কাজ করতে বাধ্য করছিল, যা সে নিজেও চায়নি। সে বুঝতে পারছিল, এই শক্তি তাকে এক অসীম ক্ষমতার অধিকারী করছে, কিন্তু একইসঙ্গে তাকে এক পুতুলে পরিণত করছে, যে তার নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে পারে না। সে এই নেশায় এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে সে আর বুঝতে পারছিল না, সে কি এই খেলার পরিচালক, নাকি সে নিজেই এই খেলার শিকার।

তিনজনের মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রাম তাদের ভেতরের আসল সত্তাকে প্রকাশ করে দিচ্ছিল। এই টানাপোড়েন তাদের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরেছিল- কে টিকে থাকবে, আর কে ভেঙে পড়বে? তাদের মনের ভেতরের এই লড়াইয়ের ফলাফল তাদের জীবনের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে। তারা তিনজনই এক অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি হয়েছিল, আর এই শক্তির সঙ্গে তাদের লড়াই ছিল তাদের নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই। এই সংগ্রামে যে টিকে থাকবে, সে এক নতুন জীবন পাবে, আর যে ভেঙে পড়বে, সে চিরতরে হারিয়ে যাবে।


তাদের মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রাম যখন তুঙ্গে, তখন পরিত্যক্ত বাড়ির ভেতরের বাতাস যেন ঘন হয়ে এল। সেই বিকৃত ইন্দ্রিয়ের জগতে, যেখানে আলো-ছায়া আর গন্ধের স্পর্শ একাকার হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ করেই সব শান্ত হয়ে গেল। বাতাস যেন এক গভীর নিস্তব্ধতায় ভরে গেল। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যেই, বাড়ির প্রধান হলরুমের মাঝখানে, কুয়াশার মতো অন্ধকার প্রবাহে তৈরি এক অদ্ভুত “দরজা” খুলে গেল। এই দরজাটি কোনো কাঠ বা লোহার তৈরি ছিল না, বরং তা ছিল এক চলমান, ঘোর কালো ধোঁয়ার মতো যা ক্রমাগত নিজের আকার বদলাচ্ছিল। সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে ভেসে আসছিল তাদের সবার গোপন আকাঙ্ক্ষার ফিসফিসানি।

সূর্য, মিতালী আর শঙ্কর তিনজনেই হতবাক হয়ে সেই দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের অন্তরের সবচেয়ে গভীর ইচ্ছাগুলো যেন সেই দরজার ভেতরে ফুটে উঠছিল। সূর্য দেখল, সেই নারী, যার স্পর্শে সে পাগল ছিল, সেই নারী দরজার ওপারে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তার চোখে সেই একই তীব্র টান, যা তাকে তার জীবনের সব শূন্যতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। মিতালী দেখল, সেই দরজার ওপারে এক খোলা দিগন্ত, যেখানে সে স্বাধীনভাবে উড়ছে, যেখানে কোনো সংসারের বাঁধন নেই, কোনো সমাজের নিয়ম নেই। শঙ্কর দেখল, এক অন্ধকার শহর, যেখানে সে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী, যেখানে তার হিংস্রতা আর কামনা কোনো বাধা মানে না।

তারা বুঝতে পারছিল, এই দরজার ওপারে এক নতুন জগত। এক এমন শহর, যেখানে বাস্তবের কোনো নিয়ম নেই, কোনো নৈতিকতা নেই। এই শহর তাদের গোপন ইচ্ছা আর পাপের প্রকাশ। তাদের বাস্তব জীবনের সব দমিত আকাঙ্ক্ষা এই শহরে পূর্ণতা পেতে পারে। তারা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তাদের মন তখনো দ্বিধায়, এই পথে পা বাড়াবে নাকি ফিরে যাবে?

তাদের ভেতরের টানাপোড়েন তখন এক নতুন রূপ নিল। সূর্যর মনের এক কোণে তার সুশৃঙ্খল জীবনের কথা মনে পড়ল। তার পেশা, তার ফ্ল্যাট, তার পরিচিত সব কিছু। সে কি এই সবকিছু ছেড়ে এই অজানা পথে পা বাড়াবে? তার ভেতরের শূন্যতা তাকে এই পথে ঠেলে দিলেও, তার যুক্তি তাকে থামতে বলছিল।

মিতালী তার স্বামীর কথা মনে করল। সে তার মুক্তির স্বাদ পেতে চাইলেও, সে তার স্বামীকে ভালোবাসত। সে জানত, এই পথে একবার পা বাড়ালে আর কোনোদিন ফিরে আসা যাবে না। তার ভেতরের দ্বিধা তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল।

শঙ্কর এই জগতের নেশায় আসক্ত হলেও, তার মনের এক কোণে এক ভয় কাজ করছিল। সে বুঝতে পারছিল, এই পথ তাকে এক অসীম ক্ষমতার অধিকারী করবে, কিন্তু একইসঙ্গে তাকে এক পুতুল বানাবে। সে কি তার নিজের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলবে?

তারা তিনজন সেই দরজার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের সামনে দুটি পথ। একটি হলো তাদের পরিচিত, একঘেয়ে আর শূন্যতায় ভরা জীবন। আরেকটি হলো এক অজানা, নিষিদ্ধ আর বিপদজনক জগত, যেখানে তাদের ভেতরের অন্ধকারই তাদের পথপ্রদর্শক। তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নেওয়ার সময় এসেছিল। ফিরবে, নাকি পা বাড়াবে? তাদের ভেতরের অন্ধকার তাদের সেই অজানা পথে পা বাড়াতে উৎসাহিত করছিল, কিন্তু তাদের ভেতরের আলোর শেষ ঝলক তাদের বাধা দিচ্ছিল। তারা জানত না, তারা কোন পথ বেছে নেবে, কিন্তু তাদের জীবনের পরবর্তী পদক্ষেপ তাদের জীবনের সব রহস্যের সমাধান করে দেবে।


পরিত্যক্ত বাড়ির ভেতরে খোলা সেই কুয়াশার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সূর্য, মিতালী আর শঙ্কর তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হলো। তাদের সামনে দুটি পথ- একটি তাদের পুরোনো, একঘেয়ে জীবন, আর অন্যটি তাদের ভেতরের অন্ধকারের পূর্ণ প্রকাশ। সেই মুহূর্তে, তাদের জীবনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা, ভয় আর দ্বিধা এক নতুন পরিণতিতে রূপ নিল।

সূর্য, তার জীবনের শূন্যতা আর নিঃসঙ্গতাকে এক নতুন রূপে দেখতে পেল। সে বুঝতে পারল, তার ভেতরের শূন্যতা আর কোনোদিন পূরণ হবে না, যদি না সে এই নতুন পথে পা বাড়ায়। সে সেই দরজার ওপারে থাকা নারীর হাত ধরল, আর তার মনে হলো তার সমস্ত যন্ত্রণা দূর হয়ে যাচ্ছে। তার ভেতরের কামনার যে প্রকাশ এই জগতে সম্ভব, তা তার বাস্তব জীবনে কোনোদিন সম্ভব ছিল না। সে উপলব্ধি করল, তার জীবনের একমাত্র মুক্তি সেই শূন্যতাকে মেনে নিয়ে এই নতুন জগতে পা বাড়ানো। সে সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করল, কিন্তু তার মনে কোনো আনন্দ ছিল না, ছিল শুধু এক ধরনের গভীর শান্তি। সে জানত, এই মুক্তি মানেই সমাজে আর ফিরে না আসা, তার পরিচিত জগতকে চিরতরে বিদায় জানানো।

মিতালীর সংগ্রাম ছিল ভিন্ন। সে তার দমিত নারীত্বের মুক্তির স্বাদ পেতে চাইলেও, সে তার স্বামীর কথা, তার সংসারের কথা ভুলতে পারছিল না। তার মনে হলো, এই মুক্তি মানেই তার স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক, তার সব ভালোবাসার স্মৃতি চিরতরে শেষ হয়ে যাওয়া। সে সেই দরজার সামনে থেকে ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু যখনই সে পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করল, তার ভেতরে প্রবেশ করা অন্ধকার তাকে আটকে দিল। সে টের পেল, তার ভেতরের মুক্তি আর শূন্যতা মিশে গিয়ে তাকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। তার মুখের হাসি, তার চলাফেরা, তার চোখের চাহনি- সবকিছুতেই এক ধরনের অন্ধকার আর উদাসীনতা চলে এলো। সে বাস্তবে ফিরে গেল বটে, কিন্তু তার ভেতরের মিতালী আর সেই আগের মিতালী ছিল না। সে এক জীবন্ত ছায়ার মতো তার পুরোনো জীবন যাপন করতে লাগল, যার কোনো অনুভূতি ছিল না, কোনো চাওয়া ছিল না।

শঙ্কর কোনো দ্বিধায় ছিল না। তার কাছে এই জগত ছিল তার স্বপ্নের পৃথিবী। সে এই জগতে তার সব হিংস্রতা আর কামনাকে পূর্ণতা দিতে পারছিল। সে আনন্দে আত্মসমর্পণ করল, আর সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। তার মনে কোনো ভয় বা দ্বিধা ছিল না। সে তার ভেতরের অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক নতুন সত্তায় পরিণত হলো। সে সেই অন্ধকার দেশকে নিজের বাড়ি বানিয়ে ফেলল। তার ভেতরের উন্মাদনা তাকে এক নতুন জগতে নিয়ে গেল, যেখানে সে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী।

তাদের এই তিন ভিন্ন পরিণতি শহরের অন্য মানুষের কাছে এক ধরনের নতুন রহস্য হয়ে রইল। কয়েকদিন পর শহরের অন্যরাও সেই কুয়াশার টানে সেই পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে যেতে শুরু করল। প্রথমে এক-দুজন, তারপর ধীরে ধীরে অনেকেই সেই পথে পা বাড়াল। শহরটা বাইরে থেকে আধুনিক, সুশৃঙ্খল থাকলেও, তার ভেতরের অন্ধকার আর শূন্যতা সবার ভেতরেই ছিল। সেই অদৃশ্য শক্তি সবার মনের গোপন ইচ্ছাগুলোকে জাগিয়ে তুলছিল।

গল্পের শেষে, একটি প্রশ্ন রয়ে যায়-“অন্ধকার দেশ” কি আসলে একটি বাস্তব জগত, যেখানে আমাদের গোপন পাপগুলো বাস্তবে রূপ নেয়? নাকি এটি মানুষের অবদমিত মনস্তত্ত্বের এক বিকৃত প্রকাশ, যা তাদের ভেতরের অন্ধকারকে এক নতুন রূপে প্রকাশ করে? এই প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা রয়ে গেছে।

শেষ

ছবি সৌজন্যে এআই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *