পর্বতারোহণে অগ্রণী জলপাইগুড়ি 

 –ভাস্কর দাস (বিশিষ্ট পর্বতারোহী)

1988 সালের সফল মুক্তিনাথ ট্রেকিং এর পর নেচার অ্যান্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জলপাইগুড়ি শহরে সংঘবদ্ধভাবে পর্বতারোহণ বা অ্যাডভেঞ্চারের সূচনা হয়েছিল। যদিও বিক্ষিপ্তভাবে এই সংস্থারই কিছু প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অ্যাডভেঞ্চারে সামিল হয়েছিলেন তারও অনেক আগেই। ক্লাবের বর্তমান সভাপতি প্রদোষ কুসুম দাস সেই 1960 সালে এনসিসি থেকে হিমাচল প্রদেশে অনুষ্ঠিত এডভান্স লিডারশিপ কোর্সে রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। অ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর সেই কোর্স ওনাকে যে প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। দেবাশীষ লালা, সৌরেন সেন এবং গৌতম ঘোষ জয়ন্তীতে অনুষ্ঠিত অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। সাত অভিযাত্রীর সফল মুক্তিনাথ ট্রেকিং এবং নেচার অ্যান্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ির জন্ম শহরে পর্বতারোহণের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।


1988 সালের পর থেকেই শহরের অভিযাত্রীরা হিমালয়ের দুর্গম স্থানে নিয়মিত পাড়ি দেওয়া শুরু করেছিলেন। ভারত এবং নেপাল হিমালয়ের বিভিন্নস্থানে নিয়মিত সফলভাবে ট্রেনিং গুলো সম্পন্ন হতে লাগলো। শহরের যুব সম্প্রদায় এতে বেশ উদ্বুদ্ধ হল। অনেক নতুন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ এই অভিযান গুলোতে সামিল হলেন। হিমালয়ের সব জনপ্রিয় ট্রেকিং স্থানগুলোতে জলপাইগুড়ির পতাকা অভিযাত্রীরা ওড়াতে লাগলেন একে একে। দেখতে দেখতে সেই ট্রেকিং এর সংখ্যা আজ 30 ছাড়িয়েছে। অনেক প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিকূলতায় সংস্থার সদস্যরা যেভাবে এই ছোট্ট শহর থেকে হিমালয়ের বুকে নিয়মিত সফল অভিযান করে গেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। 

সফল ট্রেকিং এর সঙ্গে সঙ্গে নতুনদের অ্যাডভেঞ্চার এবং প্রকৃতিমুখী করতে এই সংস্থা 1995 সালে শুরু করল অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প। এখানে পাহাড়ে যাওয়ার পূর্বে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। প্রকৃতিকে সংরক্ষণের পাঠেরও ব্যবস্থা এখানে করা হলো। শহরের প্ৰশিক্ষিত অভিযাত্রীরা এই শিবিরে ছাত্রছাত্রী এবং যুবদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। সেই শিবির বা ক্যাম্প আজ রজতজয়ন্তী অতিক্রম করে 27শে পা দিয়েছে। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। জলপাইগুড়ি এবং উত্তরবঙ্গের কয়েক হাজার ছেলেমেয়েকে এই সংস্থা প্রকৃতি এবং পাহাড়প্রেমী করে নিঃসন্দেহে তাদের আত্মবিশ্বাস অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।


জলপাইগুড়ি শহর থেকে নিয়মিত ট্রেকিং এবং ক্যাম্পিং সম্পন্ন হলেও প্রথম পর্বতশৃঙ্গ অভিযানের উদ্যোগ কিন্তু নেওয়া হয়েছিল হাজার 1999 সালে। অভিজ্ঞতায় ভর দিয়েই জলপাইগুড়ির অভিযাত্রীরা এগোতে চেয়েছিলেন। তাই তো লেগে গিয়েছিল ঠিক 11 টা বছর। সংস্থার তরুণ প্রজন্ম সেইসময়ে এইচএমআই দার্জিলিং থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। তবে শুধু প্রশিক্ষিত সদস্য থাকলেই তো আর দুর্গম অভিযান করা যায় না। দরকার অর্থ, পর্বতারোহণ ইকুপমেন্ট ইত্যাদি। সাহস করেই সংস্থার সদস্যরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। ঠিক হয় হিমাচল প্রদেশের 20200 ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ফ্লুটেড শৃঙ্গে অভিযান চালানো হবে। এই উদ্দেশ্যে দলও নির্বাচিত হল সঠিক সময়ে। দলনেতার দায়িত্ব দেওয়া হল সদস্য ভাস্কর দাসকে। দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন –  দীপঙ্কর সেন, দীপঙ্কর বোস, বিশ্বপ্রিয় রাহুত, সৌরেন সেন, দেবাশীষ লালা, দীপঙ্কর পুরকায়স্থ এবং বাদল দেবনাথ। জলপাইগুড়ির মানুষের শুভেচ্ছা নিয়ে 12 আগস্ট 1999 জলপাইগুড়ির দলটি হিমাচলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। প্রথম অভিযানের উন্মাদনার সঙ্গে এক অজানা আতঙ্কও দলের সদস্যদের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। হিমাচলের লোমার থেকে হাঁটা শুরু করে 15200 ফুট উচ্চতাতে স্থাপন করা হয় অভিযানের মূল শিবির বা বেস ক্যাম্প। এরপর বিভিন্ন উচ্চতাতে আরো তিনটি শিবির স্থাপন করা হয়। পথের অনেক দুর্গমতা এবং প্রতিকূলতাকে সহ্য করে অবশেষে এল সেই কাঙ্খিত জয়। 26 আগস্ট সকাল 7 টা 45 মিনিটে জলপাইগুড়ির পর্বতারোহী দলের সদস্যরা ফ্লুটেড শৃঙ্গের মাথায় উড়িয়ে দিল জলপাইগুড়ি এবং দেশের জাতীয় পতাকা। দীপঙ্কর সেন, দীপঙ্কর বোস,  বিশ্বপ্রিয় রাহুত এবং ভাস্কর দাস শৃঙ্গ জয়ীরা প্রত্যেকেই তখন স্বপ্ন শিখরে। সৃষ্টি হল ইতিহাস। সাক্ষী রইল এই অভিযানের গাইড তাশি চপল পন্ডিত। জলপাইগুড়ি শহরের এবং নেচার অ্যান্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ির  প্রথম অভিযান সফল হল। মূল শিবিরে ফিরে এসে শৃঙ্গ জয়ীরা বাকি সদস্যদের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠলেন। সফল অভিযাত্রীরা জলপাইগুড়ি শহরে 3 সেপ্টেম্বর ফিরে এলে শহরবাসী তাদেরকে শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দিল। এই সফল অভিযান যুবসমাজের মধ্যে এক নতুন উন্মাদনার সৃষ্টি করলো। অনেক নতুন মানুষ এই কর্মকাণ্ডে শামিল হল।

অভিযাত্রীরা এক মিশন সফল করে অন্য মিশনের স্বপ্ন দেখে। প্রথম অভিযান সফল হওয়ায় নেচার অ্যান্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ির সদস্যদের আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই দুবছর পরেই উদ্যোগ নেওয়া হলো আরেকটি অভিযানের। এবার গাড়োয়াল হিমালয়ের রুদ্রগয়রা শৃঙ্গ, যার উচ্চতা 19024 ফুট। এবার দলে নতুন মুখ সুযোগ পেল। দলনেতার দায়িত্ব দেওয়া হলেও ব্যক্তিগত কারণে শেষ মুহূর্তে ভাস্কর দাস দলে যোগ দিতে না পারায় দলনেতার দায়িত্ব এসে পড়ল বাদল দেবনাথের ওপর। দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন – পিনাকি দাসগুপ্ত, দীপঙ্কর বসু, প্রসেনজিৎ রায়, পিন্টু রায়, জ্যোতি বিকাশ কর, দেবাঞ্জন দাস, অমলেশ মজুমদার, জয়িতা সিংহ সরকার (মহিলা সদস্যা), ষষ্ঠী কর্মকার এবং সৌরেন সেন।  2 অক্টোবর 2001 তারিখে নেচার অ্যান্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ির 2য় দলটি রওনা দিল জলপাইগুড়ি শহর থেকে। গঙ্গোত্রী থেকে প্রায় সাত ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছল মূল শিবিরে। উচ্চতা প্রায় 14500 ফুট। কয়েকদিন শৃঙ্গ পথ পর্যবেক্ষণ করে শৃঙ্গের পথে পা বাড়ালো অভিযাত্রীরা। বেসক্যাম্প থেকে একদিনেই শৃঙ্গ জয়ের চেষ্টা। 13 অক্টোবর সকাল 7 টা 30 মিনিটে এল জয়। দলের তিন সদস্য দীপঙ্কর বসু, প্রসেনজিৎ রায় এবং পিন্টু রায় পর্বত শৃঙ্গের মাথায় উড়িয়ে দিল আবার বিজয় পতাকা। 2য় অভিযানও সফল হল। এই অভিযানে নতুনরা অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ঘরে ফিরে এলো 21 অক্টোবর। শহরে অভিযাত্রীদের সম্বর্ধনা জানানো হয়। 

দু-দুটো সফল অভিযানের পর নেচার অ্যান্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ির সদস্যরা সাহস দেখিয়েছিলেন আরো বড় অভিযানে যাওয়ার। তাই ঠিক দু’বছর পরেই বেছে নেওয়া হয় দুর্গম শৃঙ্গ কেদারডোম কে। যার উচ্চতা 22410 ফুট। গাড়োয়াল হিমালয়ের এই শৃঙ্গের ভয়াবহতা হিমালয়ের অনেক শৃঙ্গ থেকেই বেশি। দল নির্বাচিত হলো অনেক আগেই। দলনেতার গুরুদায়িত্ব আবার এসে পড়ল ভাস্কর দাসের কাঁধে। দলের বাকি সদস্যরা হলেন – পিনাকি দাসগুপ্ত, দীপঙ্কর সেন, প্রসেনজিৎ রায়, বাদল দেবনাথ, প্রদোষ কুসুম দাস, দেবাশিস লালা এবং একমাত্র মহিলা অভিযাত্রী জয়িতা সিংহ সরকার। বড় অভিযান তাই তার বাজেট এবং অন্যান্য প্রস্তুতিও অনেক বড়। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সেই প্রস্তুতিপর্ব শেষ হয়। 11 আগস্ট 2003 শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা দলের সদস্যদের হাতে তুলে দিলেন দেশের এবং সংস্থার পতাকা। গঙ্গোত্রী থেকে শুরু হলো হাঁটা। গোমুখ, তপবন হয়ে মূল শিবিরে অভিযাত্রীদের পৌঁছতে সময় লাগলো তিন দিন। কির্তী হিমবাহের ঠিক পাশেই 16000 ফুট উচ্চতায় স্থাপন করা হলো মূল শিবির। এরপর বিভিন্ন উচ্চতায় আরও তিনটি শিবির স্থাপন করা হয়েছিল। সামিট ক্যাম্প বা তিন নম্বর শিবির স্থাপন করা হলো প্রায় 20000 ফুট উচ্চতায়। 26 আগস্ট প্রথম শৃঙ্গারোহনের চেষ্টা বিফল হল আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে। ফলে যাত্রা স্থগিত রাখা হলো। 27 আগস্ট আবার নতুনভাবে প্রচেষ্টা করা হল। রাত 12টায় চার অভিযাত্রী পিনাকি দাসগুপ্ত, দীপঙ্কর সেন, প্রসেনজিৎ রায় এবং ভাস্কর দাস রওনা দিলেন শৃঙ্গের পথে, সঙ্গে অভিজ্ঞ গাইড গোবিন্দ। অজস্র হিমবাহের ফাটল এবং নরম বরফ অতিক্রম করে সকাল 8টা 20 মিনিটে অবশেষে জলপাইগুড়ির অভিযাত্রী দলটি পৌছে গেল শৃঙ্গের মাথায়। উচ্চতা 22410 ফুট। আনন্দে সব ক্লান্তি ভুলে শৃঙ্গের মাথায় তাঁরা তুলে ধরলেন অসংখ্য মানুষের শুভেচ্ছা ভরা দেশের এবং সংস্থার পতাকা। শৃঙ্গ জয় শেষে তিন নম্বর ক্যাম্পে যখন অভিযাত্রীদলের সদস্যরা  ফিরে এলো তখন তারা পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। মূল শিবিরে দলের বাকি সদস্যদের সঙ্গে শৃঙজয়ীদের দেখা হলে সেখানে সাফল্যের আনন্দ মেতে উঠলেন সবাই। 9 সেপ্টেম্বর অভিযাত্রী দলটি ফিরে এল জলপাইগুড়ি শহরে এবং শহরবাসী অভিযাত্রী দলটিকে বিপুলভাবে স্বাগত জানাল। অভিযাত্রী দলটি জলপাইগুড়িবাসীর ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছায় ভেসে গেল।

2005 সালে নেচার এন্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ির চতুর্থ অভিযানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এবার আরেকটি দুর্গম শৃঙ্গ যার নাম গ্যাংস্ট্যাং। উচ্চতা 20212 ফুট। হিমাচলের এই শৃঙ্গটির জন্য একটি ছোট দল নির্বাচন করা হলো। ভাস্কর দাসকে দলনেতা করে আরও তিনজনকে সেই দলে রাখা হল। তারা হলেন -বাদল দেবনাথ, পিনাকি দাসগুপ্ত এবং নবাগত সুজয় ভৌমিক। 15 জুলাই জলপাইগুড়ি শহর থেকে অভিযাত্রীদলটি রওনা দেয়। কেলং থেকে শুরু হলো হাঁটার পর্ব। দুইদিন লাগলো 14500 ফুট উচ্চতায় মূল শিবির স্থাপন করতে। এই ক্যাম্পের উপরে আরো দুটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল পরে। দুই নম্বর শিবিরের পর দড়ির সাহায্যে দলের সদস্যরা এগিয়ে চলল শৃঙ্গের লক্ষ্যে। দুর্গম এবং প্রতিকূল পথ ভেঙে অবশেষে 29 জুলাই সকাল ন’টায় এল সেই জয়। সুজয়, ভাস্কর এবং সঙ্গে গাইড হর্ষ। সঙ্গে আনা জাতীয় পতাকা এবং ক্লাবের পতাকা শৃঙ্গের মাথায় তুলে ধরলেন বিজয়ী সদস্যরা। তোলা হল ছবি। করা হল শৃঙ্গ পূজা। এরপর খুব সাবধানে শৃঙ্গজয়ীরা নেমে এলো বেস ক্যাম্পে এবং সকল মিলে 6 আগস্ট ফিরে এলো জলপাইগুড়ি শহরে।

 দু’বছর পর অর্থাৎ 2007 সালে আবার অভিযান। এবার হিমাচলের ইউনাম শৃঙ্গ, যার উচ্চতা 20050 ফুট। দলনেতার দায়িত্ব আবার ভাস্কর দাসের কাঁধে। দলের বাকি সদস্যরা হলেন – পিনাকী দাশগুপ্ত, প্রসেনজিৎ রায়, মিথুন বিশ্বাস এবং সুদর্শন রায়। জুলাই আমরা 20 জুলাই অভিযাত্রী দলটি জলপাইগুড়ি শহর থেকে রওনা দিল। হিমাচলের বরলাচা পাস অতিক্রম করে ভরতপুরের ঠিক পাশেই 15500 ফুট উচ্চতাতে স্থাপন করা হলো মূল শিবির। এই অঞ্চলে অক্সিজেনের বড্ড অভাব। এক নম্বর শিবির স্থাপন করা হলো প্রায় 17500 ফুট উচ্চতায়। 28 জুলাই পিনাকী এবং ভাস্কর সকাল 11টায় পৌঁছলেন শৃঙ্গে, সঙ্গে গাইড হর্ষ।  নেচার এন্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ির পঞ্চম অভিযানও সফল হল। অভিযাত্রীদল শহরে ফিরে এলো 6 আগস্ট। 

ইতিমধ্যে নতুন অনেক সদস্য পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। অনেক নতুন যুবক-যুবতি এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এবার ঠিক করা হলো পরের অভিযানে এই সমস্ত নতুন সদস্যদের সুযোগ দেওয়া হবে। তাই পরবর্তী অভিযানের জন্য বেছে নেওয়া হল অপেক্ষাকৃত সহজ শৃঙ্গ স্টক কাংড়ি’কে। উচ্চতা 20200 ফুট। দলনেতা নির্বাচিত হলেন ভাস্কর দাস, দলের বাকি সদস্যরা হলেন- পিনাকি দাসগুপ্ত, জ্যোতি বিকাশ কর,  সুজয় ভৌমিক মিথুন বিশ্বাস, সৌরেন সেন,  দীপঙ্কর পুরকায়স্থ, রঞ্জন কর, বাপি বর্মন, জয়ন্ত সরকার এবং সুতপা চৌধুরী। 2009 সালের 26 জুন সকলের শুভেচ্ছাকে সঙ্গী করে লাদাখ হিমালয়ের পথে রওনা দিল জলপাইগুড়ির পর্বতারোহী দলটি। লে পৌঁছে দু’তিনদিন অভিযাত্রী দলটিকে অপেক্ষা করতে হলো, কারণ লাদাখে অক্সিজেনের বড়ই অভাব তাই শরীরকে ওই পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। স্টক ভিলেজ থেকে শুরু হলো হাঁটা। অভিযাত্রী দলের তিন দিন লাগলো বেস ক্যাম্প থেকে বা মূল শিবিরে পৌঁছাতে। 16500 ফুট উচ্চতায় স্থাপন করা হলো মূল শিবির। বেস ক্যাম্প এবং শৃঙ্গের মাঝে কোন ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড না থাকাতে মূল শিবির থেকে সরাসরি প্রচেষ্টা চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হল। 5 জুলাই রাত সাড়ে 11টায় শৃঙ্গের উদ্দেশ্যে 9 সদস্যের অভিযাত্রী দলটি রওনা দেয়।  টর্চের আলোয় পাহাড়ের ঢাল ভেঙে উপরে উঠতে থাকে দলটি। পথে তিনজনের কিছু শারীরিক অসুবিধা হওয়াতে আরো দুজনের সঙ্গে তাদেরকে মূল শিবিরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হল। অবশেষে 6 জুলাই জয়ন্ত সরকার, সুজয় ভৌমিক, মিথুন বিশ্বাস এবং ভাস্কর দাস পৌঁছলেন কাঙ্খিত লক্ষ্যে। শৃঙ্গের মাথায় তারা উড়িয়ে দিলেন বিজয় পতাকা। তখন ঘড়িতে সময় সকাল নটা বেজে পনের মিনিট। অভিযাত্রীদল বেস ক্যাম্পে ফিরে এলো বেলা তিনটায়। দীর্ঘ 15 ঘণ্টায় লড়াই শেষ হলো এক অনাবিল আনন্দে। 14 জুলাই অভিযাত্রীদল ফিরে এলো জলপাইগুড়ি শহরে। ক্লাবের সদস্যরা এবং জলপাইগুড়িবাসী অভিযাত্রী দলের এই সাফল্যের আনন্দে মেতে উঠলেন। 

আবার ঠিক দু বছর পর অর্থাৎ 2011 সালে উদ্যোগ নেওয়া হলো পরবর্তী অভিযানের। লাদাখ হিমালয়ের মেন্টক কাংরি শৃঙ্গকে বাছা হল অভিযানের জন্য। উচ্চতা  20600 ফুট। ভাস্কর দাসকে দলনেতা রেখে দলের বাকি সদস্যরা হলেন বাদল দেবনাথ, দীপঙ্কর সেন, সুজয় ভৌমিক, মিথুন বিশ্বাস এবং নবাগত সমীরণ মণ্ডল। 21 জুলাই দল জলপাইগুড়ি শহর থেকে রওনা দিল। লে পৌঁছে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করে দলটি পৌঁছে গেল কার্জক-এ। ঘুমররী লেককে সাক্ষী রেখে মূল শিবির স্থাপিত হলো 17500 ফুট উচ্চতায়। এক অসাধারণ সুন্দর জায়গা এটি। নিচে ঘুমররী লেক দৃশ্যমান। বেস ক্যাম্পের উপর কোন ভাল সাইট না থাকাতে মূল শিবির থেকেই পরিকল্পনা নেওয়া হয় শৃঙ্গারোহনের। 31জুলাই রাত 11টায় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হল। দীপঙ্কর সেন, সুজয় ভৌমিক, মিথুন বিশ্বাস, সমীরণ মণ্ডল এবং ভাস্কর দাস রাত সাড়ে 12 টায় রওনা দিলেন শৃঙ্গের পথে। টর্চের আলোতে পাথর এবং বরফের ঢাল ভেঙে এগিয়ে চলল অভিযাত্রী দলটি। পথে সুজয় এবং মিথুনের কিছু শারীরিক  সমস্যা হওয়াতে তারা নিচে নেমে যাওয়া স্থির করল। দলের বাকি তিনজন সদস্য এবং গাইড তাশী এগিয়ে চলল শৃঙ্গের দিকে। অবশেষে সকাল 11টা বেজে 50 মিনিটে অভিযাত্রী দলের সদস্যরা একে একে পৌঁছলেন শৃঙ্গের মাথায়। চারিদিকে অজস্র নাম না জানা  শৃঙ্গরাশি। জলপাইগুড়ি থেকে শুভেচ্ছা ভরা পতাকা তুলে ধরা হলো শৃঙ্গ শীর্ষে। তোলা হল ছবি। আবহাওয়া চমৎকার থাকায় অভিযাত্রী দল মূল শিবিরে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এলো।  পরদিন সকলে মেতে উঠেছিল শৃঙ্গ জয়ের আনন্দে। 8 আগস্ট দলের সদস্যরা ফিরে এসেছিল তাদের প্রাণের প্রিয় শহর জলপাইগুড়িতে।

 2011 পর দীর্ঘ পাঁচ বছর নেচার এন্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ির তরফে কোন পর্বত শৃঙ্গাভিযান করা হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক নতুন ছেলেমেয়ে ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পর্বতারোহনের শিক্ষা নিয়ে এলেও মূলত অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতাই ক্লাবের শৃঙ্গ জয়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 2017 সালে অবশেষে ক্লাবের তরফে আবার পর্বতাভিযানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এবারকার শৃঙ্গ অপেক্ষাকৃত কঠিন। হিমাচল প্রদেশের দেওটিব্বা শৃঙ্গকে বেছে নেওয়া হলো। যার উচ্চতা 19700 ফুট। দুর্গম এই শৃঙ্গ অভিযানের জন্য আট জনের দল বাছা হল। দলনেতার দায়িত্ব ভাস্কর দাসের কাঁধেই। বাকিরা হলেন- দীপঙ্কর সেন, জয়ন্ত সরকার, অমিত দাস, মুজিবর শেখ, সুজয় বনিক এবং দুই মহিলা সদস্যা বিশাখা শর্মা এবং সোহিনী রায়।  7 জুন শহরবাসীর শুভেচ্ছা নিয়ে দলটি রওনা দিল। দিল্লি হয়ে মানালী এবং জগৎমুখ। এখান থেকেই শুরু হলো হাঁটা।  তিনদিন লাগলো মূল শিবির বা বেস ক্যাম্পে পৌঁছাতে। উচ্চতা প্রায় 15100 ফুট। পাশেই দুহাঙ্গন হিমবাহ এবং ঠিক ওপরেই দুহাঙ্গন পাস। ক্যাম্প ওয়ানে পৌঁছাতে ঐ পাসই অতিক্রম করতে হলো অভিযাত্রী দল কে। দড়ির সাহায্য ছাড়া বরফের ঢাল দিয়ে ওঠাই অসম্ভব। দীপঙ্কর, সুজয়, বিশাখা এবং ভাস্কর সঙ্গে গাইড হর্ষ ও তার দুই সহযোগী। 17000 ফুট উচ্চতায় স্থাপন করা হলো দলের এক নম্বর শিবির। পরদিন রুট সার্ভে এবং পথে দড়ি লাগানো হল। 18 তারিখ রাত 1 টায় অভিযাত্রী দল রওনা দিল শৃঙ্গের উদ্দেশ্যে। টর্চের আলোয় দড়ি ধরে উঠতে থাকে অভিযাত্রীদলের সদস্যরা। শৃঙ্গের কাছে পৌছাতে সকাল হয়ে যায়। ঠিক 8 টা 30 মিনিটে একে একে অভিযাত্রী দলের সদস্যরা এসে পৌঁছলেন শৃঙ্গের মাথায়। আবহাওয়া একদম পরিষ্কার। অভিযাত্রী দলের সদস্যরা তখন আনন্দে আত্মহারা। পতাকা নিয়ে অনেক ছবি তোলা হল। করা হল শৃঙ্গ পূজা। এবার নিচে নেমে আসাটা খুব একটা সহজ ছিল না। ক্যাম্প ওয়ানে একদিন থেকে পরদিন অভিযাত্রীদল নেমে এল বেস ক্যাম্পে, যেখানে সহ অভিযাত্রীরা উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন গুনছিল। পরদিন আবহাওয়া খারাপ হওয়া শুরু করল। তার মধ্যেই অভিযাত্রীদল নেমে এলো জগৎমুখে। বরফ এবং বৃষ্টিতে প্রায় 9 ঘণ্টা হেঁটে অভিযাত্রী দলের সদস্যরা তখন সকলেই বিধ্বস্ত। 27 জুন সফল অভিযান শেষ করে অভিযাত্রীদল ফিরে এলো জলপাইগুড়ি শহরে। 

অষ্টম অভিযানের সফলতার পর 2019 সালে নেচার এন্ড ট্রেকার্স ক্লাব অফ জলপাইগুড়ির নবম অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। হিমাচল প্রদেশের চন্দ্রভাগা 14 শৃঙ্গকে বেছে নেওয়া হয় এই অভিযানের জন্য। যার উচ্চতা প্রায় 20000 ফুট। এবার একটু বড় আকারের দল নির্বাচন করা হল। নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে 10 জন। দলনেতার দায়িত্ব ভাস্কর দাসের কাঁধেই। বাকি সদস্যরা হলেন – দীপঙ্কর সেন, মুজিবর শেখ, সুজয় বণিক, বাপি বর্মন, রাজা শীল, অমিত দাস, সৌরেন সেন, দীপঙ্কর পুরকায়স্থ এবং আশীষ দত্ত।  7 জুলাই শহর থেকে রওনা দিয়ে 12 জুলাই বাতালে পৌঁছলো জলপাইগুড়ির অভিযাত্রীদলটি। এখান থেকেই শুরু হলো হাঁটা। দুদিন হেঁটে 14 তারিখ 14500 ফুট উচ্চতায় স্থাপন করা হলো অভিযানের মূল শিবির। পাশেই ঢাক্কা হিমবাহ। এরমধ্যে এই অঞ্চলের প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য দলের কিছু সদস্য অসুস্থ বোধ করাতে তাদেরকে মূল শিবিরে থেকে যেতে হল। সুজয় আর ভাস্কর গাইড হর্ষ এবং তার দুই সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলো ক্যাম্প ওয়ানের দিকে। মোরেন এবং হিমবাহ অতিক্রম করে 17 হাজার ফুট উচ্চতায় অভিযাত্রীদল স্থাপন করল তাদের এক নম্বর শিবির। পরদিন আবহাওয়া খারাপ থাকায় কোনরকম মুভমেন্ট করা গেল না। 18 তারিখ দুই নম্বর শিবির স্থাপন করল অভিযাত্রী দলটি শৃঙ্গের রিজে। জল নেই এই স্থানে তাই নিচে থেকে রান্না করা খাবার সঙ্গে নিয়ে আসা হয়েছে। 19 জুলাই ভোর 5 টা 45 মিনিটে অভিযাত্রী দলটি শৃঙ্গের উদ্যেশে রওনা দিলেন। আবহাওয়া খুব একটা ভালো তা নয়, আকাশে প্রচুর মেঘের আনাগোনা। পাথর আর বরফের পথ দুর্গম এবং কঠিন। এর মধ্যে বরফ পড়াও শুরু হয়ে গেল। থেমে না থেকে অভিযাত্রী দল এগিয়ে চললো। ঠিক নটা বেজে 30 মিনিটে অভিযাত্রীদলটি শৃঙ্গে পৌঁছে গেল। আবহাওয়া একদম ভালো নয়, তাই তাড়াতাড়ি ছবি তুলে নিচে নামা শুরু করল অভিযাত্রী দলের সদস্যরা। ক্যাম্প 2 হয়ে ক্যাম্প  ওয়ানে পৌছে গেল বিকেল চারটায়। পরদিন সকলে নেমে এলো মূল শিবিরে। জলপাইগুড়িতে অভিযাত্রীদলটি ফিরে এল 27  জুলাই। ফিরে এসে পরপর নয়টা শৃঙ্গ জয়ের আনন্দে মেতে উঠলো সকলে।

 1999 থেকে 2019 এই 20 বছরে নয়টি পর্বত শৃঙ্গ অভিযান এবং সবকটি সফল। এটা যে কোন অ্যাডভেঞ্চার সংস্থার কাছেই এক গর্বের বিষয়। প্রত্যেকটি অভিযান ছিল একে অন্যের থেকে আলাদা। দুর্গমতার দিক থেকেও ভিন্ন। এই স্বল্প পরিসরে এতগুলো অভিযানের বিস্তারিত বর্ণনা সম্ভব নয়। অনেক মানুষের সহযোগিতাতেই সম্ভব হয়েছিল এই অভিযানগুলি।  আগামীতেও এই ধারা জলপাইগুড়িতে বজায় থাকবে বলে জলপাইগুড়িবাসীর আশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *