উপকারের প্রতিশোধ

গ্রিক লোককথা, পিনাকী রঞ্জন পাল : প্রাচীন রোমে ইউরোকাস নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন। রাজা ভীষণ বাহাদুর আর প্রজাপ্রেমী ছিলেন। তাঁর শাসনে রাজ্যের প্রজারা সুখেই ছিলেন।

একবার ইউরোকাসের চর্মরোগ হয়। রোগ এমনভাবে রাজার শরীরে ছড়িয়েছিল যে কেউই তাঁকে সুস্থ করে তুলতে পারছিলেন না। রোমের আশপাশের নগর থেকেও অনেক চিকিৎসককে ডাকা হয়েছিল, কিন্তু কেউই সফল হতে পারেননি। শেষে সেই রাজ্যেরই এক যোগ্য, সৎ তথা ওষুধের বিভিন্ন প্রভাব সম্পর্কে জ্ঞাত বিশিষ্ট চিকিৎসক ফেরোমান রাজার কাছে এসে বলেন, ‘মহারাজ, যদি আপনি আমাকে আজ্ঞা করেন। তবে আপনার চর্মরোগের চিকিৎসা শুরু করতে পারি।”

অন্ধের আর কি চাই, দু’টি চোখ। রাজা তো নিজের রোগ সারাতেই চান। তিনি বলেন, ‘যদি তুমি আমার চর্মরোগ সারিয়ে তুলতে পার, তবে তোমাকে প্রচুর উপহার দেব, তোমাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করব।’

এরপর রাজপ্রাসাদের অতিথিশালায় ফেরোমানের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি দু’দিন ধরে বিভিন্ন জড়িবুটি বেটে চিকিৎসার জন্য এক ওষুধ প্রস্তুত করেন। সেই ওষুধ তিনি ঘোড়ায় চড়ে যে পোলো খেলা হয় তার ছড়ির সেই স্থানে ফুটো করে ঢুকিয়ে দেন যেখানে ধরে খেলতে হয়।

তৃতীয় দিন ফেরোমান রাজার কাছে এসে বলেন, ‘মহারাজ, এখন আপনি এই ছড়ি দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে সঙ্গীদের সঙ্গে পোলো খেলুন। আর ততক্ষণ ধরে খেলবেন যতক্ষণে আপনার হাত ঘেমে না ওঠে।”

রাজা এমনটাই করেন। ঘোড়ায় চড়ে তিনি ততক্ষণ পোলো খেললেন যতক্ষণে তাঁর হাত ঘামে ভিজে না গেল।

এরপর ফেরোমান রাজাকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে খুব করে স্নান করান একটি ওষুধ মেশানো জলভর্তি চৌবাচ্চায়। স্নানের পরে রাজাকে ভোজন করে ঘুমোতে বলেন। রাজ্য প্রায় দশ ঘন্টা ধরে ঘুমেবার পরে উঠলে নিজেকে অনেক সুস্থ অনুভব করেন। এরপর শরীরের প্রতি লক্ষ্য করে তিনি বুঝলেন যে এখন তিনি রোগমুক্ত। ফেরোমানের ওষুধের প্রভাবে রাজা দারুন আশ্চর্য হন। রোগমুক্ত হয়ে রাজার খুশির সীমা ছিল না। যে রোগের চিকিৎসা বড় বড় চিকিৎসক করতে পারেননি, ফেরোমান যেন তা ফুঁ মেরে তাড়িয়ে দিলেন। তিনি চিকিৎসক ফেরোমনকে রাজদরবারে ডেকে তাকে যথাযথ সম্মান করেন এবং তাঁকে প্রচুর পরিমাণে ধন-দৌলত উপহার দেন। ফেরোমানের পরিবারের থাকার জন্য রাজপ্রাসাদের পাশেই এক বাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। রাজ চিকিৎসক হিসাবে উচ্চ বেতনে ফেরোমানকে নিযুক্ত করা হয়।

এখন থেকে রাজা বা রাজ পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে ফেরোমান চিকিৎসা করতেন। নিজের বুদ্ধিমত্তা, যোগ্যতা আর কাজের দৌলতে ফেরোমান শীঘ্রই রাজার বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। রাজা তখন থেকে শাসনকার্যেও ফেরোমানের পরামর্শ চাইতেন। ধীরে ধীরে রাজ্যের শাসনকার্যে চিকিৎসক ফেরোমানের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। সামন্তরা তাকে রাজার বাম হাত বলে মনে করতেন।

রাজ্যের মন্ত্রী তথা উচ্চ পদস্থ কর্মচারীরা শাসনকার্যে ফেরোমানের এই প্রভাব বৃদ্ধিতে ভীত হয়ে পড়েন। তাদের মনে হল, এই ব্যক্তি একদিন রাজ্যের শাসনে তাঁদের পেছনে ফেলে দেবেন। তাই একদিন তাঁরা এক গুপ্ত বৈঠকে স্থির করেন যেভাবেই হোক ফেরোমানের প্রতি রাজার আস্থা নষ্ট করে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করাতে হবে।

একদিন সুযোগ বুঝে প্রধানমন্ত্রী রাজা ইউরোকাসকে বলেন, মহারাজ, আপনি হয়ত আমার কথা বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু রাজ চিকিৎসক ফেরোমান একদিন আমাদের ভীষণ সঙ্কটে ফেলবেন। আমাদের শেষ করে দেবেন। তাঁর অভিপ্রায় অতি মারাত্মক। তাঁকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়াটাই ঠিক হবে।

ইউরোকাস বলেন, এ আপনি কি বলছেন প্রধানমন্ত্রী? ফেরোমান তো আমাদের বিশ্বাসের পাত্র, রাজ্যের হিতাকাঙ্ক্ষী আর বুদ্ধিমান পথপ্রদর্শক। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি তাঁর সঙ্গে এরকম ব্যবহার কেমন করে করতে পারি?

কিন্তু, মহারাজ রাজনীতি তো এটাই বলে। তা ছাড়া আমাদের মন্ত্রীমণ্ডলের এটাই বক্তব্য যে ফেরোমানের মত অতিকুশল, ধূর্ত আর শক্তি বৃদ্ধিকারী ব্যক্তিকে এখনই শেষ করে দেওয়া উচিত। যদি তাঁর শক্তি বৃদ্ধির ক্ষিধে আরও বাড়ে তা হলে তিনি আমাদের ভিখারিতে পরিণত করে দেবেন।’

রাজা ছিলেন কান-পাতলা। তিনি চিন্তায় ডুবে যান। রাজা ভাবেন, মন্ত্রীদের এই আশঙ্কা অমূলক নয়। ফেরোমান চতুর আর বুদ্ধিমান তো বটেই, তার সঙ্গে ওর শক্তি বেড়ে গেলে অনেক কিছুই করতে পারে। ফেরোমানের প্রতি রাজার বিশ্বাসের আসন টলমল করে উঠল। —তা হলে কি করা উচিত? কান-পাতলা রাজা প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন।

ফেরোমানের ওপর শত্রুর গুপ্তচর হবার অভিযোগ এনে তার শিরচ্ছেদের আদেশ দেওয়া উচিত। তার জীবিত থাকাটা আমাদের জন্য মারাত্মক হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর উদ্দেশ্যপূর্ণ করার পরামর্শ দেন রাজাকে।

ফেরোমানের ভয়ে ভীত রাজা পরের দিনই তাকে রাজদরবারে ডেকে বলেন, দেশদ্রোহী ফেরোমান, আমি জানতে পেরেছি যে তুমি শত্রুর গুপ্তচর আর চিকিৎসক সেজে আমার রাজ্যের গুপ্ত তথ্য শত্রুদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছ। এইজন্য আমি তোমার শিরচ্ছেদের আদেশ দিচ্ছি। কাল সকালে তোমাকে কারাগারে নিয়ে গিয়ে শিরচ্ছেদ করা হবে।

রাজার মুখ থেকে এই আদেশ শুনে ফেরোমান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তাঁর সেবা, সততা আর রাজ্য শাসনে সহযোগিতার এই পারিশ্রমিক দিচ্ছেন মহারাজ। তবুও তিনি হতোদ্যম না হয়ে বলেন, মহারাজ আপনি নিশ্চয়ই কোন ভুল করছেন। আমি তো আপনার এক সৎ সেবক। আমি কোনরকম রাজদ্রোহ করিনি। আমি নিজের নিষ্ঠা আর সেবার দ্বারাই রাজ্যে উচ্চপদে আসীন হয়েছি। তবুও যদি কোন ব্যাপারে অপ্রসন্ন হয়ে আপনি আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চান তা হলে আমাকে নিজের একটি ছোট চিন্তার, সমাধান করার অবসর দিন।

–কি সেই চিন্তা? তাড়াতাড়ি বল।

—মহারাজ, আমার ঘরে একটি বহুমূল্য চিকিৎসা গ্রন্থ রাখা আছে। তাতে স্বাস্থ্যলাভের প্রচুর, অব্যর্থ ওষুধের বিবরণ লেখা রয়েছে। মরার আগে সেই গ্রন্থ আমি আপনাকে উপহার দিয়ে যেতে চাই। তাতে এমনও ওষুধের বিবরণ লেখা আছে যা প্রয়োগ করে আমার শিরচ্ছেদ হবার পরেও আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।

রাজার মনে সেই অদ্ভুত গ্রন্থকে দেখার ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। তিনি ভাবেন, এই ব্যক্তির কাছে এরকম কোন গ্রন্থ থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। তাই এই গ্রন্থ তাঁর একান্তই দরকার।

একজন প্রহরীর সঙ্গে ফেরোমানকে সেই গ্রন্থ আনার জন্য তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিছু সময় ধরে ফেরোমান নিজের সংগ্রহে থাকা গ্রন্থগুলিকে উল্টেপাল্টে দেখেন। কিছু বস্তু ওদিক করে একটি গ্রন্থ বার করেন। রাজদরবারে রাজার হাতে সেই গ্রন্থ তুলে দেন।

কৌতূহলবশত রাজা ইউরোকাস রাজদরবারেই সেই গ্রন্থের পাতা উল্টাতে শুরু করেন। পাতাগুলি পরস্পরের সঙ্গে জুড়েছিল। তাই অভ্যাসবশত নিজের জিভে আঙুল দিয়ে গ্রন্থের পাতাগুলি উল্টিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তবুও কোন পাতাতেই কিছুই দেখতে না পেয়ে রাজা ফেরোমানের দিকে তাকান।

ফেরোমান নিবেদন করেন, মহারাজ আরও কয়েকটি পাতা উল্টান।পরবর্তী পাতাগুলিতে নিশ্চয়ই আপনি কিছু অদ্ভুত ওষুধের বিবরণ পাবেন।

রাজা জিভে আঙুল দিয়ে আরও পাঁচ পাতা উল্টাতেই হঠাৎ মূর্ছিত হয়ে সিংহাসনে পড়ে যান। দেখতে দেখতে রাজার প্রাণ বেরিয়ে যায়।

রাজদরবারের উপস্থিত সকলে বিলাপ করে ওঠেন। ফেরোমান একদৃষ্টিতে রাজাকে প্রাণত্যাগ করতে দেখেন। তিনি গ্রন্থের পাতাগুলিতে এমন শক্তিশালী বিষ মাখিয়েছিলেন যে জিভে তার স্পর্শ লাগা মাত্রই রাজার জীবনলীলা সমাপ্ত গিয়েছিল।

রাজা ইউরোকাস ফেরোমানের মত যোগ্য আর সৎ ব্যক্তির ওপরে মিথ্যা অভিযোগ এনে মৃত্যুদণ্ড দিতে চেয়েছিলেন, তাঁর অকৃতজ্ঞতার শাস্তি রাজা সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে গেলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *