(তিব্বতের লোককথা)
পিনাকী রঞ্জন পাল : গুরু সো-চুং-ঝা’র আশ্রমে তার শিষ্য সামী কয়েক বছর ধরেই আছে। মনপ্রাণ ঢেলে সে গুরুদেবের সেবা করে, আশ্রম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে আর গুরুর বাণীগুলিকে মনে গেঁথে নেয়। যে কোন কাজই হোক, সহজ কিংবা কঠিন, ছোট অথবা বড়, গুরুদেব তার ওপরেই নির্ভরশীল ছিলেন। গুরুদেবের স্নেহ পেয়ে সামী নিজেকে ধন্য মনে করত— সামীর অন্য সঙ্গীরা যেখানে দীক্ষা পেয়ে, পড়ার পাঠ শেষ করে চলে গেছে, আর গুরুদেব সেখানে সামীকে এখন পর্যন্ত দীক্ষা দিলেন না। আরও অনেক শিষ্য এল আবার চলেও গেল। কিন্তু সামী আশ্রমেই রইল। লোকেরা বলাবলি করত যে সামী দীক্ষারই উপযুক্ত নয়। তাই গুরুদেব ওর প্রতি নজর দেন না।
একবার আশ্রমে আসা কিছু নতুন শিষ্যের দীক্ষান্ত সমারোহ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে সামীর মনে আশঙ্কা ভর করে। সন্ধ্যায় সমস্ত কাজ শেষ করে সামী ভাবতে বসে— ‘কি কারণ হতে পারে যে আমাকে দীক্ষা দেবার কথা বললে গুরুদেব এড়িয়ে যান? সম্ভবত তিনি জীবনভর আমাকে এইভাবেই সেবক বানিয়ে আশ্রমে রাখতে চান যাতে তাঁর স্বার্থ সিদ্ধি হয়। অথবা গুরুদেব নিজেই স্বয়ং ভণ্ড। গুরুমন্ত্র দেওয়ার গুরুদেবকেও তো সিদ্ধপুরুষ হতে হবে।’
এ সব চিন্তা করতে করতে মাথার যন্ত্রণা শুরু হলে সামী নিজের কুটিরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে পুনরায় সেই চিন্তা নাড়া দিয়ে ওঠে ‘গুরুদেব আমাকে দীক্ষা দিচ্ছেন না কেন? এটা বলাতো উচিত নয় যে তিনি ভণ্ড। দূর দূর থেকে শিষ্যারা তাঁর কাছে আসে। তা ছাড়া, গুরুদেব আমার মনের কথাও বুঝতে পারেন। যাই হোক না কেন ওকে ছেড়ে অন্যত্র যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমি জ্ঞানের কাঙ্গাল, কিন্তু এখানে থেকে জ্ঞান অর্জন করাটাও কি উচিত হবে।’
সামী পাশ ফিরে শোয়। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে সামীর মন খুশিতে ভরে যায়— ‘গুরুদেবকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা মনে আনাও পাপ। হয়ত আমার এখন পরীক্ষার সময় উত্তীর্ণ হয়নি। অথবা আমার মধ্যে কিছু খামতি আছে যা গুরুদেব বার করে দিতে চাইছেন। বরং এখানে থেকে ওঁনার সেবা করাই উচিত হবে।
এরপর সামা বিছানা ছেড়ে উঠে প্রাতঃকৃত করে গুরুদেবের কাছে উপস্থিত হয়। গুরু সো-চুং-ঝা প্রতিদিনের মতই তখন ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। সামী গুরুদেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই তিনি বলেন- “বৎস সামী, সন্ধ্যায় মনে আসা বিচার নিরর্থক ছিল। ওসব ভেবে মনকে দূষিত কর না।মধারাত্রির বিচার কিছুটা সঠিক ছিল। আর ভোরবেলার বিচারের মধ্যে গাম্ভীর্য আর পরিপক্কতা দুই-ই ছিল।’
এ কথা শুনেই সামী হচকচিয়ে যায় এবং গুরুদেবের যোগ্যতা নিয়ে তার আর কোন সন্দেহ থাকে না। কাঁপা কাঁপা হাতে সে গুরুদেবের পা জড়িয়ে ধরে। সেই সময় তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে।
শুরুদেব তাকে ধরে তোলে, ‘ওঠো বংসা। আজ আমার পাশের গ্রামে ভোজনের নিমন্ত্রণ আছে। তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে। যাও, পূজা-পাঠ শেষ করে তৈরি হয়ে এস।
সামী কুটিরে প্রবেশ করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসে। এরই মধ্যে গুরুদেরও পেট ভরে খেয়ে নিয়েছিলেন। সামী তো জানতেও পারেনি।
গুরু আর শিষ্য জঙ্গল, খেত, মাঠ পার করে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিছুদুর পর্যন্ত তো সামীর ভালই লাগছিল। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খিদেও বাড়তে লাগল। সামী ক্লান্ত হয়ে পড়ল। অন্যদিকে গুরুদেব তখন জোর কদমে পথ চলছিলেন। যেন ভোজন যাওয়াটা অতি মহত্বপূর্ণ কোন বিষয়। গুরুদেবের উৎসাহ দেখে সামী স্তম্ভিত হয়ে যায়।
গ্রামের প্রথম বাড়িটির সামনে পৌঁছে গুরুদেব থেমে যান। এটাই বাড়ি বৎস্য সামী, দরজার কড়া নাড়ো।’ সামী কড়ার দিকে হাত বাড়াতেই গুরুদেব বলেন ‘থামো সামী, মনে হচ্ছে আমার ভুল হয়েছে। সম্ভবত এটা নয়, দ্বিতীয় গলির প্রথম বাড়িটি হবে।’ দু’জনে এগিয়ে চলেন।
দ্বিতীয় গলির প্রথম বাড়ির সামনে পৌঁছে সামী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। “কিছুক্ষণ পরে তো ভোজন পাওয়াই যাবে।” সামী দরজার কড়া নাড়ার জন্য হাত বাড়াতেই গুরুদেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এটাও সেই বাড়ি নয়। হয়ত বা গ্রামের পূর্ব দিকের প্রথম বাড়িটা হবে। এটা তো পশ্চিম দিক। চলো।’
সন্ধে পর্যন্ত এইভাবেই সামী আর গুরুদেব প্রতিটি বাড়ির সামনে খিদে পেটে ঘুরতে থাকেন আর শেষে আশ্রমে ফিরে আসেন। সামীর শরীরে আর কোন শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। ও ভাবে— ‘এটা কি গুরুদেবের কোন চালাকি নাকি সত্যিই গুরুদেব বাড়ি খুঁজে পাননি?’
এই ঘটনার কিছুদিন পরে সামী এক সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে আশ্রমে আসে। সমস্ত দিন গুরুদেব ওকে কোন কাজে ব্যস্ত রেখেছিলেন। সন্ধ্যায় ফেরার পথে ভাবছিল যে আজতো গুরুদেব অবশ্যই খুশী হবেন, কেন না আমি ওনার দেওয়া কাজ শেষ না করলেও অন্য শিষ্যদের চেয়ে ভাল করে কাজ করেছি।
এই আশা নিয়ে গুরুদেবের ঘরে ঢোকার মুখে সামী শুনতে পায় গুরুদেব কারও সঙ্গে যেন কথা বলছেন। হঠাৎ নিজের নাম শুনে সামী দাঁড়িয়ে পড়ে। শুরুদেব সেই অজানা ব্যক্তিকে বলছিলেন— ‘দেখো মহাশয়, নিজের জিনিস সযত্নে রাখো। এখনই সামী নামে আমার এক শিষ্য এসে পড়বে। ও বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এই পর্যন্ত শুনেই সামী ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে। ও কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি যে পরম পূজনীয় গুরুদেব ওর সম্পর্কে এরকম বিচার রাখেন। সামী ক্রোধে অন্ধ হয়ে একটা লাঠি নিয়ে গুরুদেবকে মারার জন্য ঘরে প্রবেশ করলে গুরুদের ব্যাপারটা অনুধাবন করে দ্রুত পালিয়ে অন্য ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন।
বাইরে দাঁড়িয়ে সামী ক্রোধে পরপর করে কাঁপছিল— ‘গুরুদেব, আমি আপনাকে পূজা করেছি, বছরের পর বছর আপনার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি আর আপনি তার এই স্বীকৃতি দিলেন? দীক্ষা দেননি, তবুও আমি সহ্য করেছি, সেদিন আপনি ভোজন করে গেছেন আর আমাকে খালি পেটে দোরে দোরে ঘুরিয়েছেন। আমি চুপ করে থেকেছি। কিন্তু আমার চরিত্রের ওপর লাগান অপবাদ আমি সহ্য করব না। বেরিয়ে আসুন। সামী লাঠি ঘুরিয়ে বলতে থাকে।
গুরুদেব দরজায় ওপাশ থেকে বলেন— ‘শাস্ত হও সামী, আর নিজের মনের সঙ্গে কথা বল।’
সামী কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর মনে হচ্ছিল যেন ভেতরের ক্রোধে ভরা আগ্নেয়গিরি ফেটে গিয়ে লাভা বাইরে বেরিয়ে আসছে আর ওর ভেতরে গভীর এবং অসীম জ্ঞানের ভাণ্ডার তৈরি হয়েছে।
সামী লাঠি ছুঁড়ে ফেলে চোখ বন্ধ করে দরজার পাশে বসে পড়ে। আদের বাইরে বার হলে সামী তাঁর পা দুখানি জড়িয়ে ধরে। গুরুদেব ওকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর শুকে নিজের কক্ষে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘বৎসা সামী, তোমার শিক্ষা আজ সম্পূর্ণ হয়েছে। যাও আর নিজের জ্ঞানের আলো অন্যত্র ছড়িয়ে দাও।’
যথা আড্ডা গুরুদের। কিন্তু প্রার্থনা করছি আপনি আমাকে জ্ঞান প্রদানের জন্য যে রাস্তা গ্রহণ করেছিলেন তার অর্থ ব্যক্ত করুন।’ সামী হাত জোড় করে বলে।
তুমি আমার প্রিয় শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তোমার ভেতরে ক্রোধ আর ঈর্ষা ছাই চাপা আগুনের মত ছিল। চেষ্টা করেও সেগুলিকে বার করা সম্ভব হচ্ছিল না। তোমার পথের শেষ বাধা ছিল এরা। আমি বিভিন্নভাবে সেগুলিকে উত্ত্যক্ত করতে চেয়েছি যাতে তোমার অন্তঃমন শুদ্ধ সোনার মত পবিত্র হয়। সেদিন তোমাকে ক্ষুধার্থ অবস্থায় বাড়ি বাড়ি ঘোরালাম, কিন্তু তুমি ক্রোধ দমন করে নিলে। ক্রোধ দমন করা ঠিক নয়, তার থেকে মুক্তি পেতে হবে। আজ নিজের চরিত্রের ওপর ছেটান কলঙ্ক তোমাকে ক্রোধান্বিত করেছে আর তোমার ভেতরে জমে থাকা আমার প্রতি প্রচণ্ড ক্রোধ বাইরে বেরিয়ে আসে। ব্যস।
গুরুদেবের কথায় সামীর দুচোখে জলে ভরে ওঠে। শুরুর মহিমা গাইতে গাইতে সেখানেই সামী ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ে। এরপর আরও কয়েক বছর শুরুর সেবা করার পরে সামী জনকল্যাণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। শিশুদের প্রতি সামীর বিশেষ টান ছিল। নিজের সাধারণ জীবন, প্রেম তথা জনকল্যাণের কাজের জন্য সামী তিব্বতে আজও পূজনীয়।