
অরুণ কুমার : অর্ধ শতাব্দী অপেক্ষার পর চালু হতে চলেছে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যেকার হলদিবাড়ি চিলাহাটি রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন, এর নাম দেওয়া হয়েছে মিতালী এক্সপ্রেস। এটি ঢাকার সেনানিবাস স্টেশন থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত চলাচল করবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই চিলাহাটি- হলদিবাড়ি পথে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিগত ২০২১ সালের ২৭শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ভার্চুয়ালি এই ট্রেনের উদ্বোধন করা হয়েছিল, কিন্তু করোনা পরিস্থিতির জেরে ভিসা সমস্যায় এই ট্রেনের যাত্রা শুরু করা যায় নি। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়ায় এই ট্রেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই মর্মে বাংলাদেশ এই ট্রেনের রুট, সময়সূচি, ভাড়া সহ একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তার প্রেক্ষিতে আগামী ২৬শে মার্চ থেকে এই ট্রেন চালুর একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ২৬শে মার্চ মিতালী এক্সপ্রেস যাত্রা শুরু করতে পারছে না বলে জানা গেছে। ভারত সরকার এই মুহূর্তে টুরিস্ট ভিসা না দেওয়ায় এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, আগামী ২৭শে মার্চ থেকে ভারত সরকার ১৫৬টি দেশের নাগরিকদের ই টুরিস্ট ভিসা দেওয়ার কাজ ফের শুরু করবে। তাই মিতালী এক্সপ্রেসের যাত্রা শুরুর দিন পিছিয়ে সম্ভবত ১লা বৈশাখ হওয়ার সম্ভাবনা। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সাথে ভারতের হাইকমিশনার বিক্রমকুমার দোরাইস্বামী একটি বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে। তাই সভা ঠিক থাকলে আগামী ১লা বৈশাখ থেকে যাত্রা শুরু করবে বহু প্রতীক্ষিত মিতালী এক্সপ্রেস।
তবে যাত্রা শুরুর আগে জেনে রাখি, মিতালী এক্সপ্রেস একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন যাত্রীবাহী ট্রেন যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মধ্যে যাতায়াত করবে। এটিই তৃতীয় যাত্রীবাহী ট্রেন যা এই দুই দেশের মধ্যে চলাচল করবে। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই রুটে ট্রেন চলাচল। সম্প্রতি এই রুটে পণ্যবাহী ট্রেনের যাতায়াত শুরু হয়েছে। এবার চালু হতে যাচ্ছে এই রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন। ঢাকা থেকে জলপাইগুড়ির দূরত্ব রেলপথে ৫৯৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশ অংশে পড়েছে ৫২৬ কিলোমিটার। বাকি ৬৯ কিলোমিটার ভারতের অংশে। ট্রেন থেকে আয় ভাগাভাগির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ভারতকে। দূরত্ব অনুপাতে ভাড়ার ৮৫ ভাগ বাংলাদেশ এবং বাকি ১৫ ভাগ ভারত পাবে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দুপুরে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রাতে ঢাকায় পৌঁছে ফের নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে যাবে ট্রেনটি। পথে এদেশের হলদিবাড়ি স্টেশনে দাঁড়াবে ট্রেনটি। সেখানেই ট্রেনটির ইঞ্জিন ও চালক পরিবর্তন হবে। ঢাকা থেকে হলদিবাড়ি পর্যন্ত বাংলাদেশের ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেনটিকে নিয়ে আসবেন বাংলাদেশ রেলের চালকরা। হলদিবাড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত ভারতের ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেনটিকে নিয়ে যাবেন ভারতীয় চালকরা। ফেরার সময় ওই একই পদ্ধতি পালন করা হবে।

মিতালী এক্সপ্রেস ছাড়াও ঢাকা-কলকাতা রুটে ‘মৈত্রী’ এবং কলকাতা-খুলনা রুটে ‘বন্ধন’ নামে দুটি ট্রেন চলে দুই দেশের মধ্যে। যদিও করোনার জন্য টুরিস্ট ভিসা দেওয়া বন্ধ থাকায় বর্তমানে ওই ট্রেন দুটিও বন্ধ রয়েছে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে নিউ জলপাইগুড়ির দূরত্ব ৫৯৫ কিলোমিটার। চিলাহাটি–হলদিবাড়ি পথে ব্রডগেজ রেললাইন। বর্তমানে রেলে ব্রডগেজ ট্রেন চালানোর মতো কোচ নেই। আমদানি করে আনতেও বছর দুয়েক লেগে যাবে। ফলে এই পথে ট্রেন চালানোর সুযোগ নেই। তবে ভারত ১০টি কোচের একটি ব্রডগেজ ট্রেন কোচ দিতে রাজি হয়েছে। আপাতত ভারতের কোচ দিয়েই এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। রেল সূত্রে আরও জানা গেছে, মিতালীর সব কামরা হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সব ধরনের কর সহ এসি বার্থে যাত্রীপ্রতি তিন হাজার ৭৪০ টাকা, এসি সিটে দুই হাজার ৮০৫ টাকা এবং এসি চেয়ারে এক হাজার ৮৭০ টাকা ভাড়া পড়বে। বাংলাদেশ রেলের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সোম ও বৃহস্পতিবার মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে যাবে। ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে ছাড়বে রোববার ও বুধবার। ট্রেনটি ভারতের নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ছাড়বে দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছাবে রাত ১০টা ৩০ মিনিটে। একইভাবে ঢাকা থেকে ছাড়বে রাত ৯টা ৫০ মিনিটে, ভারতে পৌঁছাবে সকাল ৭টা ৫ মিনিটে। ট্রেনটি দিনের বেলা ৪৫৬ আসন নিয়ে এবং রাতে ৪০৮ আসন নিয়ে চলাচল করবে।

বাংলাদেশের মানুষের জন্য মৈত্রী এক্সপ্রেস অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ট্রেন। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা করাতে আসেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তার মধ্যে অনেকের নানা শারীরিক জটিলতার কারণে বিমানে চড়ায় নিষেধাজ্ঞা থাকে। অনেকের বিমানের টিকিট কাটার সামর্থ্য থাকে না। আবার সড়কপথে বাসে কলকাতা আসার ধকল নিতে পারে না শরীর। এই পরিস্থিতিতে তাদের একমাত্র ভরসা দুদেশের সংযোগ রক্ষাকারী ট্রেনগুলি। রেল মন্ত্রক সূত্রের খবর, একে একে চালু হয়ে যাবে বাকি ট্রেনগুলিও। মিতালী এক্সপ্রেসের সংযোজনের ফলে তা হবে উল্লেখযোগ্য সেতুবন্ধন বিশেষ করে দক্ষিণের সাথে উত্তরের যোগাযোগের ক্ষেত্রে। আবার বলা যায় এদিকে, বাংলাদেশে পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে কলকাতা থেকে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছনো যাবে ঢাকায়। তাছাড়া বনগাঁ লোকালকে পেট্রাপোল পর্যন্ত চালানোর পরিকল্পনা নিয়েছে পূর্ব রেল। সেক্ষেত্রেও সীমান্ত পার করে সরাসরি ট্রেনে উঠে পড়তে পারবেন ওপার থেকে আসা মানুষেরা। এদিকে দীর্ঘ ৪৩ বছর ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার পর ২০০৮ সালে প্রথমবার মৈত্রী এক্সপ্রেস দিয়েই নতুন করে শুরু হয়েছিল ভারত-বাংলাদেশের ট্রেন চলাচল। ২০১৭ সালে যাত্রা করে বন্ধন এক্সপ্রেস। করোনায় যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ থাকলেও করোনাকালে বাংলাদেশ-ভারতে রেলপথে পণ্য পরিবহন চলেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারত থেকে রেলপথে বাংলাদেশে পণ্য রফতানি হয় ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন। আগের অর্থবছর রফতানির পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন।
আগামী ১লা বৈশাখ নতুন বাংলা বছরের প্রথম দিনে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে রেল পরিষবা শুরু করতে চাইছে ভারত ও বাংলাদেশ। এই রেল যোগাযোগের ফলে দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে এবং উভয় দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বাণিজ্যিক সৌহার্দের বন্ধন দীর্ঘস্থায়ী লাভ করবে বলে আন্তর্জাতিক মহলের ধারণা।তাছাড়া আগামী কয়েক বছরে ভারত বাংলাদেশের রেল যোগাযোগে যুগান্তর ঘটবে বলে মনে করছেন অনেকে।
Photo source- Mitali Express official FB page.