‘ভারতীয় বিপ্লববাদের জননী’ মাদাম কামা

পিনাকী রঞ্জন পাল

ভারতবর্ষের স্বাধীনতালাভের জন্য বিদেশে বসবাসকারী যে সমস্ত ভারতীয়রা আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন মাদাম কামা তাদের অন্যতম। তাঁর পুরো নাম মাদাম ভিকাজি রুস্তমজি কামা। তাঁকে ‘ভারতীয় বিপ্লববাদের জননী’ নামে অভিহিত করা হয়। ১৮৬৮ সালে মুম্বই শহরের এক ধনী পার্শী পরিবারে মাদাম কামার জন্ম। তাঁর পিতার নাম শেঠ সোরাবজি ফ্রোমোজি প্যাটেল। ১৮৮৫ সালে মুম্বই হাইকোর্টের সলিসিটর কে রুস্তম কামার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু শীঘ্রই ইংরেজ বিদ্বেষী ও চরম পন্থায় বিশ্বাসী মাদাম কামার সঙ্গে তাঁর স্বামীর মতান্তর হয় এবং পরিণতি বিচ্ছেদে শেষ হয়।

মাদাম কামা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মতামত সংগঠনের জন্য ১৯০১ সালের এপ্রিল মাসে ইংল্যান্ডে যান। তিনি সেখানে ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটি’ নামে একটি সমিতি গঠন করে ইংল্যান্ডের ভারতীয় তরুণ সম্প্রদায়কে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই কাজের সূত্রে তাঁর পরিচয় হয় সর্দার সিং রাওজি রানা, শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার মতো চরমপন্থী ভারতীয়দের সঙ্গে।

১৯০৩ সালে শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা ‘হোমরুল লিগ’ নামে একটি লিগ গঠন করেন। এর মুখপাত্র’ ‘ইন্ডিয়ান সোসিওলজি’ পত্রিকার অন্যতম কর্ণধার ছিলেন মাদাম কামা। ভারতবর্ষে এই পত্রিকাটি বিনামূল্যে বিতরণ করা হত। ১৯০৭ সালের আগস্ট মাসে জার্মানির স্টুগার্টে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোসিওলজিস্ট কংগ্রেসে মাদাম কামা যোগদান করেন। সেই বিশ্বসভাতে মাদাম কামা ভারতবর্ষের পক্ষে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা খুব হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল। বক্তৃতাকালে তাঁর হাতে ছিল ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতের জন্য নির্মিত এক ত্রিবর্ণ পতাকা। তাতে ছিল লাল, গেরুয়া ও নীল-পরপর এই তিনটি রং। ওপরে লাল রং, তাতে আটটি আধফোটা সাদা পদ্ম, মাঝখানে গেরুয়ার ওপর দেবনারীতে লেখা ছিল ‘বন্দেমাতরম’, তলায় নীল রঙের ওপর একধারে সূর্য ও অন্যধারে অর্ধ চন্দ্র এবং তারা। সেদিন মাদাম কামার এই বক্তৃতা নিয়ে ইউরোপে ব্যাপক হইচই পড়ে গিয়েছিল।

১৯০৭ সালের অক্টোবর মাসে তিনি আমেরিকা গিয়ে প্রচারকার্য চালান ও নিউইয়র্কে কয়েকটি ভারতীয় সমিতিকে রাজনৈতিক কার্যকলাপে প্রণোদিত করেন। ১৯০৮ সালের ২০ নভেম্বর মাদাম কামার প্রচেষ্টায় লন্ডনের ক্যাকস্টন হলে লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ নেতাদের উপস্থিতিতে এক জাতীয়তাবাদী ভারতীয় সভার ব্যবস্থা করা হয়। মাদাম কামা ব্রিটিশের দমন নীতি থেকে রেহাই পাবার জন্য ১৯০৯ সাল থেকে প্যারিসে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি এখানে থেকেই বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এখান থেকেই তিনি গোপনে ভারতে অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো ও ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন।

১৯১৩ সালে বিপ্লবীদের কাজকর্ম অত্যন্ত উগ্ৰ হয়ে ওঠে। বাংলা থেকে অনুশীলন সমিতি এবং ন্যাশনাল কলেজের নলিনীকিশোর ওহ বিশিষ্ট ছাত্রেরা বিদেশে যেতে আরম্ভ করলে তাদের সঙ্গে মাদাম কামার সখ্যতা গড়ে ওঠে। নলিনীকিশোর গুহ ‘বাংলার বিপ্লববাদ’ বইয়ে মাদাম কামার সঙ্গে বিপ্লবীদের বিচিত্র কর্মপ্রচেষ্টার উল্লেখ করেছেন। মাদাম কামা প্যারিস থেকেই কলকাতার ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকাটি পরিচালনা করতেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে ফ্রান্সের মাসাই-এ ভারতীয় সৈনিক দলের মধ্যে প্রচারের অভিযোগে মাদাম কামাকে প্রথমে বর্দো ও পরে ভিলিতে নজরবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৩৪ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে মাদাম কামা পরলোকগমন করেন।

Photo source- google.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *