উত্তরের বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের বকেয়া অর্থ দ্রুত মেটানোর দাবি : ১৮ জুলাই পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করবে ট্রাইবুনাল

অরুণ কুমার : উত্তরের বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের বকেয়া রাশি অবিলম্বে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে । তার আগেই কতজন শ্রমিক কত পরিমাণ অর্থ পাবে সে বিষয়ে আগামী ১৮ জুলাই প্রকাশিত হবে ফাইনাল রিপোর্ট। রাজ্যের উত্তরে সবথেকে বড় শিল্প হিসেবে চা শিল্পকে ধরা হয়ে থাকে যার সঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ শ্রমিক যুক্ত রয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং এই তিনটি জেলার প্রায় ২৯ টি চা বাগান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকার ফলে এবং মালিকপক্ষ শ্রমিকদের প্রাপ্য বকেয়া অর্থ দিনের পর দিন না দেওয়ার ফলে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে থাকে এবং পরবর্তীতে এই বন্ধ চা বাগান ইস্যু নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের দ্বারা জনস্বার্থ মামলা করা হয় ২০০৬ সালে। তার পরবর্তীকালে সুপ্রীম কোর্ট একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে পুরো বিষয়টি দেখাশোনার জন্য এক সদস্যের একটি কমিটি তৈরি করে দেন । এক সদস্যের এই ট্রাইবুনাল পরবর্তীকালে এই বন্ধ ২৯ টি চা বাগানের বকেয়া অর্থ বিষয়টিকে নিয়ে তদন্ত শুরু করে। জানা গেছে এই ২৯ টি চা বাগানের শ্রমিকদের বকেয়া অর্থের পরিমাণ ৩৩০ কোটি টাকা।

এক সদস্যের কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভয় মোহন সাপ্রে। তিনি একের পর এক বৈঠক করে চলেছেন সমস্যার সমাধানে। আগামী ১৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ বিষয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করবেন বলে জানা গিয়েছে। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হলে স্পষ্ট হবে উত্তরবঙ্গের বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের বকেয়া পরিমাণ কত বা প্রকৃত কি অবস্থায় রয়েছে এটা স্পষ্ট হবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
এ বিষয়ে জানা গেছে গত ২৭ মে ২০২২ এ মামলার সংখ্যা ১৬/ ২০১২ এই বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে নিযুক্ত এক সদস্যের কমিটির ট্রাইবুনাল অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভয় মোহন সাপ্রে শিলিগুড়ি গেস্ট হাউসে জনস্বার্থ মামলার শুনানির কাজ আরম্ভ করেন। জানা গেছে এই শুনানি বন্ধ এবং পরিত্যক্ত চা বাগানের শ্রমিকদের বকেয়া সুনিশ্চিত করার একটা প্রক্রিয়ার অন্যতম পদক্ষেপ যা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে আরো জানা গেছে তালিকাভুক্ত ডুয়ার্সের ২৯ টি চা বাগানের মধ্যে থেকে ১৩ টি চা বাগান কর্তৃপক্ষ বা ম্যানেজমেন্ট এই বৈঠকে তাদের কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি। যে সমস্ত বাগান থেকে প্রতিনিধি আসেনি সেই বাগান গুলি হল রামঝোরা, জয় বীরপাড়া, কাঁঠালগুড়ি, শিকারপুর ভান্ডারপুর, রায়পুর, শ্রীনাথপুর, ডিমডিমা, রেড ব্যাংক , বান্দাপানি, মধু সুরেন্দ্রনগর এবং লঙ্কাপাড়া।

এই শুনানির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য আরেকটি বিষয় হল যে বড় বড় কেন্দ্রীয় ইউনিয়নের নেতৃত্ব এই শুনানির সময় অনুপস্থিত ছিলেন। এই সমস্ত বড় বড় ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের দাবি ছিল এই ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাদেরকেও যুক্ত করতে হবে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জাস্টিস অভয় মোহন সাপ্রে বলেছিলেন, প্রত্যেকটি বাগান থেকে প্রত্যেকটি ইউনিয়নের একজন করে সদস্য এখানে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন কিন্তু বাস্তবে দেখা দিয়েছে তাদের অনুপস্থিতী। বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে ২০২১ নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভয় মোহন সাপ্রে একটি আদেশ জারি করেছিলেন এই বিষয়ে যাতে এই ভেরিফিকেশন পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় ইউনিয়নের নেতারা অংশগ্রহণ করতে পারে কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তাদের অনুপস্থিতি এবং অনাগ্রহ। এই ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে চা বাগানের তৃণমূল কংগ্রেস চা শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি, বিজেপির চা শ্রমিক সংগঠন , কংগ্রেসের চা বাগান শ্রমিক সংগঠন এন ইউ পি ডব্লিউ, এবং আরএসপির চা শ্রমিক সংগঠন এরা ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় বা হেয়ারিং এর সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিতি দেখা গেছে।

আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যারা জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেতমজুর সমিতির এই বৈঠক এবং আলোচনায় আগাগোড়াই যেমন ছিলেন কিন্তু অপরদিকে অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের উদাসীনতা এবং তাদের অনুপস্থিতি বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে । কারণ বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের কথা এই সমস্ত শ্রমিক সংগঠনগুলির না বলাতে তারা নিজেদের অসহায় ভাবতে আরম্ভ করেছে বলে সূত্রের খবর।

জানা গেছে এদিকে প্রায় ২৩ হাজার দাবি পত্র ফরম পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেতমজুর কিষান সমিতির পক্ষ থেকে জমা দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর পক্ষ থেকে ৬০০০ দাবি পত্র ভেরিফিকেশন করে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে বলা হচ্ছে এই দাবি পত্র গুলো যথেষ্ট নড়বড়ে অর্থাৎ ও দায়সারা ভাবে জমা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হতে পারে যে মুজনাই বাগানের শ্রমিকদের ৯৬০টি দাবি পত্র ভেরিফিকেশন করে জমা দেওয়া হয়েছে মাত্র পনেরো থেকে কুড়ি মিনিটের মধ্যে।

এদিকে সূত্রের খবর রাজ্যের শ্রমবিভাগ যেখানে ২১০০০ ফর্ম যথারীতি ভেরিফিকেশন করেছে , প্রভিডেন্ট ফান্ড দপ্তর ১৭০০০ ফর্ম ভেরিফিকেশন করেছে অপরদিকে যারা জনস্বার্থ মামলা করেছেন অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেতমজুর কিষান সমিতি তারা ১৪০০০ ফর্ম ইতিমধ্যেই ভেরিফিকেশন করেছেন। বিভিন্ন চা-বাগানের ম্যানেজমেন্ট পরিচালন সমিতি তারা ১২০০০ ফর্ম ভেরিফিকেশন করে জমা দিয়েছেন। এদিকে আরো জানা গেছে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভয় মোহন সাপ্রে এই ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া যেভাবে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেত মজুর কিসান সমিতি স্পষ্টভাবে বলেছে, লাগাতার ভেরিফিকেশন চলার ক্ষেত্রে তারা সবসময় সময় দিতে প্রস্তুত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিগত দুমাস ধরে রাজ্যের শ্রমদপ্তর অত্যন্ত ঢিমে তালে চলেছে এই ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া মাসে মাত্র ২-৭ দিন ধরে করা হয়ে থাকে যার ফলে এই কাজ ধীর গতিতে চলেছে। এ ভেরিফিকেশন এর কাজ ধীরগতি চলার পেছনে এটাও একটা অন্যতম কারণ।

পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেতমজুর কিষান সমিতি আরো অভিযোগ করে বলেছে শ্রমদপ্তর প্রভিডেন্ট ফান্ড দপ্তর এবং বাগান কর্তৃপক্ষ এই ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার বিষয়টি অত্যন্ত ঢিলেমি তাহলে চলেছে অনভিজ্ঞতার কারণে যেটা দুর্ভাগ্যজনক। জানা গেছে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জাস্টিস অভয় মোহন সাপ্রে বলেছেন আগামী জুন মাসের মধ্যে সমস্ত রকম দাবি সংক্রান্ত নথি প্রস্তুত করে তা বিএসসি কমিটির কাছে পেশ করতে হবে আর যদি ম্যানেজমেন্ট তার কাছে কোনো রেকর্ড না থাকে বা তিনি রেকর্ড তথ্য জমা দিতে ব্যর্থ হন তাহলে তাকে লিখিতভাবে বলতে হবে যে তার কাছে কোনো রেকর্ড নেই।

এই সময়ে বিভিন্ন ইউনিয়নের তরফ থেকে বকেয়া গ্র্যাচুইটির বিষয়টিও তো রাখা হয় পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেতমজুর সমিতির পক্ষে জাস্টিস সবাইকে জানানো হয় যে অধিকাংশ বাগানে গ্র্যাচুইটির অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে তারা। এর অন্যতম কারণ হলো যে শ্রমদপ্তর দ্বারা ঢাকা বৈঠকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাগান কর্তৃপক্ষ অনুপস্থিত থাকছে যার ফলে যে অভিযোগ উঠছে অভিযোগের নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না এক্ষেত্রে যাতে অভিযোগের নিষ্পত্তি দ্রুত করা হয় সে বিষয়টি জাস্টিস সাপ্রের কাছে আবেদন রাখা হয় পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেতমজুর সমিতির পক্ষ থেকে।

সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অনুরাধা তলোয়ারের বক্তব্য হলো উনারা আশা করছেন আগামী ১৮ জুলাইয়ের পর ২৯ টি চা বাগানের শ্রমিকদের যে অবস্থা সেটি স্পষ্ট হবে এবং তাদের যে বকেয়া রয়েছে তা তাদের প্রাপ্য অর্থ তারা পাবে এবং বাগান কর্তৃপক্ষ এতদিন ধরে যে শ্রমিকদের সাথে অমানবিক আচরণ করে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে আদালত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এদিকে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন গুলির মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের বিজেপি কংগ্রেস এবং আরএসপি এদের নেতৃবৃন্দের সাথে আমরা কথা বলেছিলাম টেলিফোনে। এক্ষেত্রে ন্যাশনাল রেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন কংগ্রেসের আইএনটিটিইউসি সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মনি কুমার ডারনাল জানিয়েছেন আমরা কেবল দুটি বাগানের ক্ষেত্রেই এই কাজটি করেছি সাহিত্য করেছি এই কাজটি দ্রুত সম্পন্ন হোক আমরা চাই আমরা সবরকম সহযোগিতা আমাদের স্থানীয় চা বাগান স্থায়ী প্রতিনিধি দাঁড়া এই ট্রাইব্যুনালে যোগদান আমাদের রয়েছে।
আরএসপি প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি হলে তাঁর এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। বিজেপির ক্ষেত্রেও তাই কারণ তাদের ট্রেড ইউনিয়নের বিষয়টি চা-বাগানের ক্ষেত্রে কতটা শক্তিশালী দেখা যায়নি এ বিষয়ে মন্তব্য পাওয়া যায়নি। অবশেষে তৃণমূল কংগ্রেসের চা বাগান শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা রাজেশ লাকড়ার
সাথে কথা হলে তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, আমরা তো সব রকম সহযোগিতার কাজ করে চলেছি ট্রাইবুনালের ব্যাপারে যাদের শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য বকেয়া পায় সে বিষয়টা আমরাও সবরকম সহযোগিতা করেছি পরবর্তী শুনানির এবং ভেরিফিকেশন এর ক্ষেত্রে আমাদের সবরকম সহযোগিতা থাকবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

এদিকে উত্তরের বন্ধ চা বাগানের শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন পক্ষ এই অপেক্ষায় রয়েছে যে আগামী জুলাই মাসে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হবে ২৯ টি বন্ধ চা-বাগানের বকেয়া কার কত রয়েছে সে বিষয়টি। দেখার বিষয় কত তাড়াতাড়ি ভেরিফিকেশন এর কাজ শেষ হয় এবং সময়মতো ১৮ জুলাই জাস্টিস অভয় মোহন সাপ্রে তার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এর জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *