ভাইফোঁটা

ভাইফোঁটার উদ্ভব নিয়ে লিখেছেন পিনাকী রঞ্জন পাল।

পাঁজিতে কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় যম-যমুনা-চিত্রগুপ্ত ও যমদূত পূজার উল্লেখ আছে। কথিত আছে,এদিন যমুনা তার সহোদর যমরাজকে স্বগৃহে আমন্ত্রণ জানিয়ে কপালে অক্ষয় তিলক পরিয়েছিলেন তাঁকে অমর করে রাখবেন বলে। ভাইফোঁটার উদ্ভব নিয়ে অন্য একটি মতবাদ হল, জৈন গুরু মহাবীর ৫২৭ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে নির্বাণ লাভ করলে রাজা নন্দিবর্ধন অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। রাজতন্ত্রী তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে কার্তিকের শুক্লা দ্বিতীয়ায় কপালে মঙ্গল টিপ পরিয়ে দিয়ে দীর্ঘায়ু কামনা করেন। উৎস যাই হোক, দীর্ঘ অনশনে বা অন্য কোনো কারণে ভাইবোনের সম্পর্ক সেখানে দুরত্বের সৃষ্টি করে, এদিনের আচার অনুষ্ঠানের মহিমা দু’জনকে কাছে এনে দেয়, এমনকি ফিরিয়ে দেয় সোনালি শৈশবকে। বঙ্গজ কায়স্থদের মধ্যে অনেকের ফোঁটা হয় প্রতিপদে।

পশ্চিমবঙ্গে শনি মঙ্গলবার ভাইফোঁটা পড়লে সেদিন ফোঁটার বদলে শুধু খাওয়া-দাওয়া আনন্দ আর’ উপহার বিনিয়ম। ফোটার দিন ভাইয়ের জন্মদিন পড়লে তিলকের বদলে কপালে দেওয়া হয় মধুর ফোঁটা। ফোঁটার দিন কোন ভাই উপস্থিত থাকতে না পারলে তাঁর নামে মন্ত্র পড়ে দেওয়ালে ফোঁটা দেওয়ার রেওয়াজ আছে। কম্পিউটারের এই যুগে অনেক অবস্থাপন্ন বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভাইফোটা সারছেন। ভাইফোটার এই সামাজিক স্বজন-উৎসব কে ঘিরে প্রতিবছর এক’ অভিনব সম্প্রতীর বন্ধন গড়ে উঠে নদীয়া জেলার অখ্যাত গ্রাম বিরহীতে। সেখানকার মদনমোহন মন্দিরের বিগ্রহকে সাক্ষী রেখে মুসলিম মেয়েরা হিন্দু-ভাইদের মাথায় ধান দূর্বা দেয়, হিন্দু মেয়েরা মুসলিমভাইদের কপালে দেয় চন্দনের ফোঁটা। জাতিভেদের সীমারেখাকে মুছে প্রায় ২৫০ বছর ধরে এই প্রথা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে কল্যাণীকে পেছনে ফেলে এই বিরহী গ্রাম। প্রবাহমান যমুনা নদীর পাশে ছোট্ট মদনমোহনের মন্দির। তাতে প্রতিষ্ঠা রয়েছে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ। আনুমানিক ১৭৬২ খ্রিঃ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে, মন্দিরে অধিষ্ঠিত মদনমোহন রাধার বিরহে বিষণ্ণ চোখে একা যমুনার দিকে তাকিয়ে থাকতেন বলেই নাকি এই গ্রামের নাম ‘বিরহী’। পরে মন্দিরের পূজারী স্বপ্নাদেশ পেয়ে নিমকাঠের এক রাধা মূর্তি তৈরি করে সেটিকে মদনমোহনের পাশে বসিয়ে নিত্য পূজা শুরু করেন।

মেয়েরা এই মদনমোহনের কপালে ফোঁটা দেয়। আবার গর্ভগৃহের দেওয়ালেও ফোঁটা দেয়। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের স্ত্রীর কোনও ভাই ছিল না বলে প্রতি বছর কার্তিকের শুক্লা দ্বিতীয়ায় মদনমোহনকে ভ্রাতৃজ্ঞানে ফোঁটা দিতে আসতেন। সেই থেকে আজও হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মহিলারা বিরহীর মন্দিরে সারি বেঁধে মদনমোহনকে ফোঁটা দিতে আসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *