শিশু নিকেতন ও জলপাইগুড়ি

লেখক পঙ্কজ সেন

১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর প্রথম থেকেই জলপাইগুড়ির এই শিশু বিদ্যালয়ে “মিড ডে মিল” চালু হয়েছিল।

১৯৪১ সালের ৬ই জানুয়ারি মাত্র ১৩ জন শিশুকে নিয়ে পথ চলা শুরু হয় জলপাইগুড়ি শহরের এক অন্যতম খ্যাতনামা শিশুবিদ্যালয় “শিশু নিকেতন”এর। বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জলপাইগুড়ি জেলার প্রথম বিধায়ক তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের স্ত্রী অরুনা দাশগুপ্ত (১৯০৬-১৯৮৫)। শিশুদের শিক্ষার ভিতকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে এই মহীয়সী নারী যখন “শিশু নিকেতন” নামক এই শিশু শিক্ষাকেন্দ্রটি স্থাপন করেছিলেন তখন তার সেই উদ্যোগকে সর্বান্তকরণে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিলেন খগেনবাবু ও অবনীধর গুহনিয়োগী (আর্যনাট্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা)। অরুণাদেবী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সমাজসেবার কাজে বিশেষ অবদান রেখেছেন। ইংরেজ বিরোধী আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন স্বামীর সঙ্গে। ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর “শিশু নিকেতন”এর “মিড ডে মিল” তিনি প্রথম থেকেই চালু করেছিলেন।

প্রথমদিকে খগেনবাবুর বাড়িতেই (শহরের নবাব বাড়ির বিপরীত দিকে তিনি ভাড়া থাকতেন, বর্তমানে বাড়িটির কোন চিহ্ন নেই) বিদ্যালয় বসত। কিন্তু পরবর্তীতে সেই স্থান থেকে সরিয়ে ১৯৪৮ সালে বাবু পাড়ায় (জলপাইগুড়ি পুরসভার ৮ নং ওয়ার্ড) তার বর্তমান স্থানে অধিষ্ঠিত হয়।

বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির প্রথম এবং আমৃত্যু সভাপতি ছিলেন অবনীধর গুহনিয়োগী এবং প্রথম সম্পাদিকা ছিলেন অরুণা দাশগুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন সময়ে বাংলার রূপকার বিধানচন্দ্র রায় (কার্যকাল ১৯৪৮ – ১৯৬২) এবং রাজ্যপাল পদে থাকাকালীন সময়ে হরেন্দ্র কুমার মুখার্জি (কার্যকাল ১৯৫১ – ১৯৫৬) এই বিদ্যালয়ে পদার্পণ করেছিলেন। বিদ্যালয়ে এসে বিধানচন্দ্র রায় যে চেয়ারটিতে বসে আসন গ্রহণ করেছিলেন তা আজও বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে অতি সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখা আছে। এছাড়াও স্বপনবুড়ো, উদয় শংকর, অমলা শংকরের মতো ব্যক্তিত্ব এই বিদ্যালয়ে পা রেখেছিলেন।

জলপাইগুড়ির বিখ্যাত চিকিৎসক তথা প্রাক্তন বিধায়ক স্বর্গীয় ডঃ অনুপম সেন এক দীর্ঘ সময় (২৮ বছর) শিশু নিকেতনের সম্পাদক ছিলেন। অবশ্য শিশু নিকেতন ছাড়াও শহরের আরও কয়েকটি বিদ্যালয় ও কলেজের পরিচালন কমিটির সঙ্গেও অনুপমবাবু যুক্ত ছিলেন। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে “বঙ্গরত্ন” সম্মানে সম্মানিত করে। ১৯৯১ সালে এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়ের ৫০ বছর এবং ২০১৬ সালে বিদ্যালয়ের ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান খুবই জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়েছে। বিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেই দেখতে পাওয়া যায় একটি সুদৃশ্য জলের ফোয়ারা (যা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ) এবং একটি কংক্রিটের তৈরি রেলগাড়ি। পূর্বে বিদ্যালয়ের একটি নিজস্ব ঘোড়ার গাড়ি ছিল, যা বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের আনা দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। জলপাইগুড়ি শহরের শিশুদের এই প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের শহরের অত্যন্ত গর্বের এবং আনন্দের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *