সেনপাড়া ও জলপাইগুড়ি

লেখক পঙ্কজ সেন

জলপাইগুড়ি শহরের পূর্ব প্রান্তের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা আদতে সেনপাড়া বলে পরিচিত। পরিকল্পিতভাবে এর এক বৃহৎ অংশের বাসিন্দারা অনৈতিকভাবে অঞ্চলটির নামের বিকৃতি এবং পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছেন। সেন সম্প্রদায়ের মানুষেরা জলপাইগুড়ি শহর এবং সন্নিহিত অঞ্চলগুলিতে এক শতাধিক বছরেরও অনেক আগে থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন। মূলতঃ কৃষি নির্ভর সেন সমাজে শিক্ষার বিস্তার ঘটে অনেক বিলম্বে। তাই আজও সেন পাড়ার সেন পদবিভূক্ত জলপাইগুড়ির শতাধিক বছর পুরনো পরিবারগুলো থেকে একজনও চিকিৎসক, জেলাশাসক, আইপিএস বা অনুরূপ কোন পদে পৌঁছতে পারেন নি। জলপাইগুড়িতে সেনপাড়ার সেন সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বপ্রথম ১৯২৪ সালে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বৈকুন্ঠনাথ সেন। তার এই অভাবনীয় সাফল্যের জন্য তিনি জলপাইগুড়ি বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়িতে চাকুরি গ্রহণ করেন। বৈকুণ্ঠপুর রাজ এস্টেটের সুবিশাল জঙ্গলমহলে তিনি বনদপ্তরের হিসাব পরীক্ষকের কাজ পান। কালক্রমে রাজা প্রসন্নদেব রায়কতের তিনি একান্ত আস্থাভাজন ও স্নেহভাজন ব্যাক্তি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালে তিনি নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জলপাইগুড়ি পৌরসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময় বর্তমান সেনপাড়া ও হাকিমপাড়া দুই নং ওয়ার্ড নামে পরিচিত ছিল।

এর পরবর্তীতে বিক্ষিপ্তভাবে কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক ইত্যাদি পেশায় যুক্ত থাকলেও শিক্ষার সামগ্রিক চিত্রটা কখনই আশা ব্যঞ্জক ছিল না। নারী শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে সেন সম্প্রদায়। তাই, শহরে বসবাস করা সত্ত্বেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেন সম্প্রদায় পিছিয়েই পড়তে থাকে। এর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে সেনপাড়ার নামের বিকৃতি এবং এর ভৌগোলিক পরিধির ক্রমসংকোচন। এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন নগণ্য সংখ্যক সচেতন ব্যক্তিত্ব। সেনপাড়া সন্দীপন ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ স্বর্গীয় হিরণ সেন ছিলেন এমনই এক প্রতিবাদী চরিত্র। এক নিবেদিত সমাজকর্মী এবং সেনদরদী ছিলেন তিনি। ১৯৮১ সালের অক্টোবর মাসে তার অকাল মৃত্যু অনেকেরই চোখে আজও রহস্যাবৃত। হিরন সেনের অনুপস্থিতিতে সেনপাড়াকে অস্বীকার করার প্রক্রিয়া যেন আরো জোরদার হয়ে পড়ে। জিলাস্কুল সংলগ্ন অঞ্চল থেকে ভাটাখানা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমির উল্লেখযোগ্য অংশের আদি মালিক ছিলেন সেন সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিরা। জমির পুরনো খতিয়ানগুলিতে এই অঞ্চলটি সেনপাড়া বলে পরিচিত শতাধিক বছরেরও আগে থেকে। শিক্ষার পর্যাপ্ত প্রসার না হওয়ার কারণে পিছিয়ে পড়া সেন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। অস্তিত্ব রক্ষার সহজতম পন্থা হিসেবে পূর্বপুরুষের জমি বিক্রয় করতে শুরু করেন তারা।কর্মসূত্রে বা অন্যান্য কারণে জলপাইগুড়িতে আসা ব্যক্তিরাই মূলতঃ এই সকল জমি ক্রয় করতে থাকেন। শহরের প্রকৃত আদি বাসিন্দা না হওয়া এই ব্যক্তিদেরই একাংশ সেনপাড়ার নামের বিকৃতি ঘটিয়ে হাকিমপাড়া লিখতে শুরু করেন। পিছিয়ে পড়া, অসচেতন এবং অসংগঠিত সেন সম্পদায়ের মানুষেরা, যারা ছোট-খাটো কাজে কর্মে নিযুক্ত থেকে দিনযাপনে বা অস্তিত্ব রক্ষায় রত, তারা কোনদিনই সেভাবে এই অপপ্রয়াদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেননি। এই সুযোগে তথাকথিত ‘হাকিম পাড়া’র ব্যাপক বিস্তার ঘটতে থাকে সেনপাড়ায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালে সেনপাড়া জিলাস্কুল মোড়ের দুর্গা পূজাটির সূচনা হয়েছিল অবহেলা এবং বৈষম্যের প্রতিবাদ হিসেবেই। করলা নদীর পূর্ব প্রান্তের শতবর্ষ প্রাচীন দুর্গাপূজা এখনও হাকিমপাড়ায়(উষসি সংলগ্ন এলাকায়)উদযাপিত হয়ে থাকে। এই পূজায় সেন সম্প্রদায়ের মানুষেরা ছিলেন অপাংক্তেয় এবং অনেকটাই অবাঞ্ছিত। এর প্রতিবাদেই উৎসাহী জনাকয়েক যুবক মিলে “সেনপাড়া সার্বজনীন দুর্গাপূজা”র সূচনা করেন ১৯৫২ সালে। এই পূজার জমিটি সেন সম্প্রদায়ভুক্ত এক প্রাচীন পরিবার দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করেছিলেন। সংলগ্ন কালীমন্দির ছিল ওই পরিবারের একান্ত নিজস্ব পারিবারিক মন্দির।

দুর্বল এবং অনগ্রসর সেন সম্প্রদায় কি শেষে সেনপাড়ায় হাকিমপাড়াবাসী বা নিজভূমে পরবাসী হিসাবে থাকবে ? সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে, সরকারি দলিল দস্তাবেজকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট দেখিয়ে, কতিপয় ব্যক্তি শুধু ব্যক্তিগত উদ্যোগেই কি শত বছরের ঐতিহ্যে গর্বিত একটি স্থানের নাম বদলে দিতে পারেন? প্রতিটি জমির আদি খতিয়ান ঘেঁটে দেখলেই প্রমাণিত হয়ে যাবে যে সেনপাড়ার প্রকৃত সীমানা শুরু হয়েছে জিলাস্কুল মোড়েরও কিছু আগে থেকে।

পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় অর্থাৎ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে শহরকেন্দ্রিক অর্থনীতির অভিমুখের বদল ঘটে। কৃষিভিত্তিক সমাজ ধীরে ধীরে চাকরি ভিত্তিক হয়ে পড়ে। বলাই বাহুল্য কৃষি নির্ভরশীল সেন সমাজ এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। সেন সমাজের দুর্দশার শুরু তখন থেকেই। আর্থিক অনগ্রসরতার সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটে শিক্ষার দৈন্য এবং অপ্রতুলতার। এই বিষয়ে অবিশ্বাস্য একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা যেতে পারে। আশির দশকের শেষ দিক অবধি জলপাইগুড়ি শহরের সেনপাড়ায় সেন পদবীভূক্তদের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণের সংখ্যা ছিল নিতান্তই হাতে গোনা। প্রথম বিভাগে পাশ সেভাবে ছিল না বললেই চলে। অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে ৯০ এর দশকে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে স্টার মার্কস পাওয়া থেকে আই আই টির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপক এরকম কিছু কৃতিত্ব অর্জন করেন সেনপাড়ার সেন সম্প্রদায়ের কেউ কেউ। তবে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার হার এখনো অনেক কম। অনেকেরই একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, সেন সম্প্রদায় সংরক্ষণের আওতায় আছে প্রথম থেকেই! এটি একটি উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। ২০০০ সালের শেষ দিকে খেন কমিউনিটির আওতায় সেন সম্প্রদায়কে ওবিসি(বর্তমানে ওবিসি বি)ভুক্ত করা হয়। তার আগে পর্যন্ত সাধারণ(জেনেরাল ক্যাটাগরি) শ্রেণীভূক্ত হিসাবেই সেন গোষ্টিভুক্ত মানুষেরা পরিচিত ছিল।

হিরন সেন পরবর্তী সময়ে সেনপাড়ার নাম পরিবর্তনের এই ধারাবাহিক অপচেষ্টার প্রতিবাদে সরব থাকতেন প্রয়াত নীতিশ সেন। এসএসবিতে কর্মরত নীতিশদা ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদে’র চিঠিপত্র বিভাগে এই বিষয়ে বেশ কিছু প্রতিবাদ জ্ঞাপক পত্র লিখেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, তার অকাল মৃত্যুতে এই প্রতিবাদ প্রচেষ্টা স্তিমিত হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালের মাঝামাঝিতে উজ্জ্বল সেন এবং তার সহযোগীরা সেনপাড়ার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের সামিল হয়েছিলেন। ভাবলেও অবাক লাগে যে সরকারি বা প্রশাসনিক কোন ঘোষণা ছাড়াই সেনপাড়া যেন চুপিসারে হাকিম পাড়ায় বদলে যাচ্ছে। আমরা কি ইচ্ছা করলেই উষসি এলাকায় জমি বা বাড়ি কিনে তার ঠিকানা সেনপাড়া লিখতে পারি ? ১৮৮৫ সালে জলপাইগুড়ি পৌরসভার প্রতিষ্ঠার সময়,সেন পাড়া এবং হাকিম পাড়ার ব্যাপ্তি কতদূর অবধি ছিল ? জলপাইগুড়ি জিলাস্কুল যে জমির উপর প্রতিষ্ঠিত তার প্রকৃত মালিক কে বা কারা ছিলেন ? বর্তমান স্থানে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার সময় তার ঠিকানা কি ছিল ?

অত্যন্ত সংবেদনশীল এই বিষয়টিতে জেলা প্রশাসনের নিরপেক্ষ হস্তক্ষেপ প্রার্থনীয়। অতীত দলিল, দস্তাবেজের উপর ভিত্তি করে সেনপাড়ার প্রকৃত পূর্ব সীমানা নির্ধারণ করা আশু বাঞ্জনীয়। এই ব্যাপারে জলপাইগুড়ি পুরসভার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *