লেখক পঙ্কজ সেন
উত্তরবঙ্গের প্রেসিডেন্সি কলেজ অর্থাৎ “আনন্দ চন্দ্র কলেজ” হলো জলপাইগুড়ি তথা সমগ্র উত্তরবঙ্গের গর্ব। উল্লেখ্য যে, আজ শহরের কলেজপাড়ায় যে স্থানে এই কো-এড কলেজটি অবস্থিত পূর্বে কিন্তু সেখানে ছিল না। কলেজটি সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল রেসকোর্স পাড়ায় নয়া বস্তির একটি বাড়িতে। বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগ সেখানে একই সঙ্গে চলতো। নয়া বস্তির এই কলেজ থেকেই পাস করেছিলেন জলপাইগুড়ি জেলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক দেবেশ রায়। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি এই কলেজেই শিক্ষকতা করেন। শহরের বিশিষ্ট চা শিল্পপতি কামিনী কান্ত রাহুত ১৯৪২ সালে তার পিতৃদেব আনন্দ চন্দ্র রাহুতের উদ্দেশ্যে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নলিনীকান্ত, অবনীকান্ত ও রমনীকান্তের সঙ্গে একত্রে জমি ও অর্থসহ দেড় লক্ষ টাকা দান করে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অবশ্য রাহুত পরিবার ছাড়াও জলপাইগুড়ি শহরের আরোও কিছু শিক্ষানুরাগী মানুষ এই বিষয়ে যুক্ত ছিলেন। নয়া বস্তির সেই জায়গা থেকে চল্লিশের দশকের শেষ দিকে কলেজটি আজকের বর্তমান স্থানে চলে আসে। কিন্তু এই নব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে ১৯৪৯ সালের ২৯শে এপ্রিল একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যায়। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে দেশভাগের যন্ত্রণায় জনমানসে এক বিষাদময় অবস্থা চলছিল। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় এই নবগঠিত কলেজের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে বালুরঘাট থেকে ফেরার পথে আকাশ পথে জলপাইগুড়িতে এসেছিলেন। তার বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “তাদের এরোপ্লেন যেমন অনেক পাহাড়-পর্বত, নদী পার হয়ে এসেছে, তেমনি আনন্দ চন্দ্র কলেজও নানা বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। কিন্তু সেই দিন কিছু উশৃংখল ছাত্রের আচরনে ও স্লোগানে ডক্টর রায় ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন না করেই চলে গিয়েছিলেন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মর্মাহত হন শহরের শিক্ষা- সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে যুক্ত আবালবৃদ্ধবনিতা।১৯৪৯ সালের ২ই মে, কলেজের টিচার্স কাউন্সিলের এক সভা বসে। ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সম্পাদক সুধীর কুমার বিশ্বাস এবং পরিচালক সমিতির সভাপতি তথা অধ্যক্ষ ইন্দুভূষণ মজুমদার ৪ঠা মে, বুধবার কিছু উশৃংখল ছাত্রের এহেন আচরণের তীব্র নিন্দা করেন এবং কলেজের উন্নতিকল্পে তিনটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। পরদিন থেকে কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এইরূপ অছাত্রসুলভ আচরণের নিন্দা করা হয় শহরের সর্বত্রই। ৭ই মে স্থানীয় ফনীন্দ্রদেব বিদ্যালয়ে ঐ কলেজের ছাত্র ও অভিভাবকদের একটি সভা বসে। সেদিনের ঘটনা, পরিচালক কমিটির সিদ্ধান্ত ইত্যাদি বিষয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে বিস্তর আলোচনা সেখানে হয়। কলেজটি যাতে পুনরায় চালু হয়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে মত প্রকাশ করেন সবাই (সূত্র জনমত পত্রিকা, ৬ই জুন ১৯৪৯, সোমবার)।

শোনা যায়, কামিনী কান্ত রাহুতের উদ্যোগে ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যাল এরূপ অচলাবস্থা দূরীকরণের জন্য অভিযুক্ত ছাত্রদের নিয়ে কলকাতায় গিয়ে ডক্টর বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ছাত্ররা তাদের ভুল স্বীকার করলে ডাক্তার রায় তাদের ক্ষমা করে দেন। এই কলেজে পঞ্চাশের দশকের কিছু নামকরা অধ্যাপকরা হলেন ইংরেজি বিভাগের সন্তোষ বটব্যাল, দীনেশ বিশ্বাস, বাংলা বিভাগের জীবন সিংহ রায়, ইতিহাস বিভাগের রেবতী লাহিড়ী, বিজ্ঞান ও অংক বিভাগের সুনীল দাস ,সুনীল ঘোষ, জিতেন বিশ্বাস। অধ্যক্ষ শ্রী ইন্দু ভূষণ রায়, ব্রজেন দত্তগুপ্ত, ডক্টর তুষার কান্তি চৌধুরী (আর্মি অফিসার ছিলেন) প্রভৃতি।

উচ্চশিক্ষা প্রসারে এবং জলপাইগুড়ির সুনাম রক্ষার জন্য সেদিন কামিনী কান্ত রাহুত সহ শহরের অন্যান্য বিশিষ্ট জনদের অবদান উল্লেখযোগ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরবর্তী নির্বাচনে কামিনী কান্তবাবু সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে পরিচালক সমিতির সদস্য ও তৎপরে ১৯৫৩ সালে সম্পাদকের গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করে ১০ বছর সমাসীন থেকে কলেজটিকে শুধু উত্তরবঙ্গে নয় সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এক অন্যতম উচ্চতায় গড়ে তুলেছিলেন।

অনেক গুণী মানুষ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং দেবেশ রায় এই কলেজের শিক্ষক ছিলেন। এই কলেজ থেকে পাশ করা অনেক শিক্ষার্থী আজ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। বর্তমানে কলা এবং বিজ্ঞান শাখায় পাস ও অনার্স কোর্সে পাঠদানের সুব্যবস্থা এখানে আছে। উত্তরবঙ্গের মধ্যে শুধুমাত্র শিলিগুড়ি কলেজ এবং জলপাইগুড়ির আনন্দ চন্দ্র কলেজেই মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ রয়েছে। ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে এখানে চালু হয়েছে বাংলায় স্নাতকোত্তর বিভাগ। শারীর শিক্ষার উপর বিপিএড কোর্স আপাতত বন্ধ আছে। সেই সঙ্গে কলেজে আছে একটি উন্নত মানের এনসিসি বিভাগ। কলেজের উপর তলায় রয়েছে নেতাজী সুভাষ ওপেন ইউনিভার্সিটির পাঠদানের ব্যবস্থা। যেখানে প্রতি শনি ও রবিবার ক্লাস হয়। ভূগোল বিভাগ তিনতলায় সবার উপরে। সম্প্রতি কয়েক বছর আগে এখানে মাস কমিউনিকেশন এবং জার্নালিজমের উপর পড়া শুরু হয়েছে। আনন্দ চন্দ্র কলেজের লাইব্রেরী এবং ল্যাবরেটরি যথেষ্ট উন্নত মানের। খেলাধুলার জন্য কলেজে একটি বড় আকারের মাঠ রয়েছে। কলেজ প্রাঙ্গণের সামনের মাঠে রয়েছে একটি কংক্রিটের স্থায়ী মঞ্চ, যেখানে কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়। কলেজের হোস্টেলটি কলেজ সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : উমেশ শর্মা, ছবি লেখক।