লেখক পঙ্কজ সেন
জলপাইগুড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্র ডিবিসি রোড সংলগ্ন তেলিপাড়ায় ১৯২৭ সালে এবং বাংলা ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে গড়ে ওঠে উত্তরবঙ্গ তথা জলপাইগুড়ি শহরের অন্যতম ঐতিহ্যমন্ডিত ও জাগ্রত যোগমায়া কালীবাড়ি। শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন রাধামোহন চক্রবর্তী, রেবতী মোহন চক্রবর্তী, কালু রাহুত, মোহিত ঘোষ, উপেন বর্মন, তরণী মোহন চক্রবর্তী, বাগচী পরিবার সহ শহরের আরও কিছু গণমান্য মানুষ। মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ে এক চিলতে টিনের চালায় মায়ের মূর্তিতে পুজো হতো। পূর্বে যন্ত্রের মাধ্যমে সাত্ত্বিক মতে পুজা পরিচালিত হতো। তৎকালীন সময়ে মাতৃ সাধনার পাশাপাশি এই মন্দির সংলগ্ন এলাকায় জলপাইগুড়ি জেলা তথা শহরের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ভিড় করতেন। তারপর ধীরে ধীরে মায়ের মন্দির পাকায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে কংক্রিটের মন্দিরে মৃন্ময়ী যোগমায়া কালো কষ্টিপাথরের মূর্তিতে বিরাজ করছেন।

উল্লেখ্য যে, যোগমায়া কালী বাড়ির মূল নকশা করেছিলেন জলপাইগুড়ি জেলার বিশিষ্ট বাস্তুকার রায় সাহেব কালীচরণ গুঁই। কালীবাড়ি সংলগ্ন দুর্গাপূজা প্রাঙ্গণের গম্বুজ ওয়ালা গর্ভগৃহটির পরিকল্পনাও তিনি তৈরি করেছিলেন। যোগমায়া কালী মন্দিরের ভিতরে বর্তমানে মোট তিনটি মন্দির রয়েছে। যথা, যোগমায়া কালী মন্দির, শিব মন্দির এবং বাবা লোকনাথের মন্দির।
যোগমায়া কালীমন্দিরের ভেতরে বর্তমান কালী মায়ের বিগ্রহটি প্রদান করেছিলেন জলপাইগুড়ি শহরের পুরনো বাসিন্দা হিসেবে পরিচিত ঘোষ দস্তিদার পরিবার। এই পরিবারের সদস্য শ্রী বিশ্বরূপ ঘোষ দস্তিদারের কথায় মায়ের মূর্তিটি তার দাদু ওপার বাংলার বরিশাল জেলা থেকে জলপাইগুড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীতে প্রতিবেশী ও স্বজনদের পরামর্শে পরিবারটি মায়ের বিগ্রহটি যোগমায়া কালী মন্দিরে স্থাপন করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত মা এখানে পূজীত হয়ে আসছেন।

কালী মন্দিরের পাশে যে শিব মন্দিরটি রয়েছে তা পরিচিত যোগেশ্বর মন্দির হিসেবে। স্বর্গীয় সুরেন্দ্রনাথ সেন এই শিব মন্দির স্থাপন করেন। বাবা লোকনাথের মন্দিরে দিনে দুইবার করে পূজা হয়। লোকনাথের আবির্ভাব দিবস ও তিরোধান দিবসকে কেন্দ্র করে এখানে বড় পুজো হয়। বাবা লোকনাথকে নিরামিষ ভোগ প্রদান করা হয়।

যোগমায়া কালী মন্দিরের ভেতর অবস্থিত নাট মন্দিরে প্রতিবছর নিয়ম মেনে দুর্গাপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, মা অন্নপূর্ণা ও বাসন্তী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই মন্দিরে দুর্গা পূজার প্রথম প্রচলন হয় ১৯৪৬ সালে। বর্তমানে দুর্গাপূজা ৭৭ তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। আবার ২০২৩ সালে নাট মন্দিরে অনুষ্ঠিত বাসন্তী পূজা ৯৮ তম বর্ষে পদার্পণ করলো।
নাট মন্দিরের পাশে রয়েছে তীর্থযাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগার। বিশিষ্ট নাগরিক তাপস মুকুটমণি মহাশয় তার স্বর্গীয়া মাতা আশালতা মুকুটমনির স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেন। পূর্বে যেখানে এখন নাট মন্দির রয়েছে সেখানেই মায়ের মূল মন্দির ছিলো।

১৯৬৮ সালে তিস্তার মহাবন্যায় সমগ্র জলপাইগুড়ি শহর প্লাবিত হলেও যোগমায়া কালী মন্দির সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিলো। বন্যার পরে যোগমায়া মন্দির কমিটি, ভারত সেবাশ্রম সংঘের সহযোগিতায় বিশাল বড় ত্রান শিবিরের কাজ সম্পাদনা করে এখানে।
পূর্বে অর্থাৎ ৭০ এর দশকে মায়ের আরতি শেষে বাতাসা হরির লুঠ প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হতো। এখনোও সন্ধ্যা বেলায় ঢাকের বাদ্য সহ আরতি হয় এবং শেষে শঙ্খ বাজিয়ে শান্তি জল ছেটানো হয়, উপস্থিত ভক্তদের চরনামৃত প্রদান করা হয়। কিন্তু হরির লুঠ দেওয়া হয় না।
প্রতি বছর দীপান্বিতা কালী পুজোতে এই মন্দিরে মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। সমগ্র মন্দির চত্বরকে খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়। পাঁচ রকম পদ দিয়ে মাকে ভোগ প্রদান করা হয়। বিশেষ করে খিচুড়ি, ডালনা, শাক, ভাজা, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি ও ফলমূল দেওয়া হয়। আংশিক দিনে মায়ের ভোগে মাছ দেওয়া হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার পুজোর বিশেষ দিনেও মাকে মাছ বন্ধ রেখে নিরামিষ ভোগ প্রদান করা হয়। আগে মায়ের উদ্দেশ্যে পাঠা বলি হলেও বর্তমানে তা একেবারেই বন্ধ আছে। পুজো শেষে মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত ভক্তদের উদ্দেশ্যে খিচুড়ি ভোগ বিতরণ করা হয়। এই মন্দির ট্রাস্টি বোর্ড পরিচালনা করে থাকলেও মন্দিরে আগত ভক্তদের দেওয়া দান-দক্ষিণা দিয়েই মায়ের পূজো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। মন্দিরে নিত্য পুজো হয়। এছাড়াও অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় তিথি অনুযায়ী ভোগ ও যজ্ঞ করা হয়।
মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে চারজন আরও অতিরিক্ত সহকারী পুরোহিত মন্দিরে পুজোর কাজে সহযোগিতা করে থাকেন। জনার্দন চক্রবর্তী, কালাচাঁদ চক্রবর্তী, হিমাংশু চক্রবর্তী, অমৃতানন্দ কালিদাস এই মন্দিরের বিশিষ্ট পুরোহিত। চন্ডী পাঠের ক্ষেত্রে অমৃতানন্দ এর জুড়ি মেলা ভার। সার্বজনীন যোগমায়া কালী মন্দির কমিটির বর্তমান সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ হলেন অঞ্জন ব্যানার্জি এবং উৎপল মোহন্ত। পহেলা বৈশাখ, ষষ্ঠী পুজো, মঙ্গল চন্ডী পূজো, শিবরাত্রি, বাসন্তী পূজো, দুর্গা পুজো ও জগদ্ধাত্রী পুজোতে মন্দিরে অসম্ভব রকম ভক্ত সমাগম হয়। এছাড়াও বিবাহের পর নব দম্পতিরা তাদের নতুন জীবনে প্রবেশ মায়ের আশীর্বাদ নিয়েই শুরু করেন। শিশুদের অন্নপ্রাশনের ক্ষেত্রেও ভক্তরা মায়ের আশীর্বাদ নিতে শিশু সহ এই মন্দিরে উপস্থিত হন। পরীক্ষার আগের দিন এই মন্দিরে মাকে শ্রদ্ধা ভরে দর্শন করাটাও পরীক্ষার্থীদের কাছে একটা বড় প্রাপ্তি ছিলো। শহরবাসী তাদের যে কোন শুভ কাজের ক্ষেত্রে মায়ের আশীর্বাদ নিতে মন্দিরে উপস্থিত হন।
কয়েক বছর পূর্বেও এই মন্দির প্রাঙ্গনে খুবই চোরের উপদ্রব হয়েছিলো। বর্তমানে ভক্তদের সুবিধার্থে মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে, ফলে চুরির ব্যাপারটা একদম কমে গেলেও উৎসবের দিনগুলিতে ভিড়ের মাঝে ভক্তদের সতর্ক থাকা ভালো।
জলপাইগুড়ি পুরসভার প্রাক্তন পুর সদস্য হেরম্ব নাথ ঘোষের সর্বাপেক্ষা কৃতিত্ব হলো তেলিপাড়া নামক পাড়াটির আধুনিক নামকরণ করা। এখানে তত্ত্ববিদ্যা ভবন, লক্ষী নারায়ন মন্দির, যোগমায়া কালী বাড়ি প্রমুখও কয়েকটি মন্দির থাকায় তিনি জলপাইগুড়ির পুর বোর্ডে সংলগ্ন রাস্তাটির নাম “টেম্পল স্ট্রিট” করার প্রস্তাব দিলে পুর বোর্ড তা অনুমোদন করে।