‘তপন’ বিভ্রাট

সূচনা চ্যাটার্জী, হাওড়া

মদনদা পড়লেন মহাবিপদে। ভোর হতে না হতেই অনাহুত এক ফোন কল। সদ্য কাঁচা ঘুম ভাঙ্গেনি তখনও মদনদার, তার ওপর কৈশোরের স্বভাববশত নিদ্রাভঙ্গের পর চায়ের কাপটিতে চুমুক না দিলে কোনো কাজই সঠিকভাবে করতে পারেন না ঘুম প্রিয় মদনদা সে। ফোন কলটি রিসিভ করতেই অপরদিক থেকে ভেসে এলো — হ্যালো মদন না, আমি রমেশ। কেমন আছো? অনেকদিন কোনো যোগাযোগ হয়নি।
মদন দা : তা আছি বাছা, কিন্তু তোমার কি এমন প্রয়োজন যে, সাতসকালে ঘুমটি আমার ভাঙিয়ে দিলে?
রমেশ : সরি। বলছি, তোমার কাছে আমাদের কলেজের সেই জুনিয়র তপনের নম্বর আছে?থাকলে একটু পাঠিও তো এই নম্বরে, কাল রাতে একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখলাম, দরকার ছিল তাই।
মদন দা : বেশ, পাঠিয়ে দিচ্ছি।
একে তো, তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছে চা ছাড়াই , তার ওপর গত রাতে স্ত্রী কমলা অশান্তি করে পিতৃগৃহে চলে গেছে। তাই সাংসারিক সমস্ত কাজের ভার তাই আজ মদনদার ওপরই বর্তাবে। সেকথা মনে পরতেই দ্বিগুণ মাথা গরম হয়ে গেল মদনদার। রমেশের অনুরোধ অনুসারে কন্ট্যাক্ট লিস্ট এ ‘তপন’ খুঁজতে পেলো দুটো নাম — ‘তপন দাস’ ও ‘তপন রায়’। একবার ভাবলেন — রমেশকে একবার জিজ্ঞেস করে নিলে হতো পদবীটা। দাস ও রায় দুজনেই তো জুনিয়র কলেজের। মদন দা সিদ্ধান্ত নিলেন, তপন দাসের নম্বরটাই পাঠিয়ে দিই। আবার রমেশকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলে বহুক্ষণ কথা বলবে সে, সময় প্রচুর নষ্ট হবে, বাড়ির কাজ লাটে উঠবে। তাই যেকোনো একটা পাঠিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হই। তপন রায়ের নম্বর প্রয়োজন পড়লে আবার ফোন করবে।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। তপন দাসের নম্বরটা দিলেন পাঠিয়ে রমেশকে।
নম্বরটা পেয়ে আর বিলম্ব না করেই সে উক্ত নম্বরে ফোন করে বসলো। গত রাতে সে স্বপ্নে দেখেছে , তপন রায়ের মায়ের মৃত্যু হয়েছে। দুঃস্বপ্নটি দেখা মাত্র ঘুম ভাঙে রমেশের। আবেগবিহ্বল হয়ে পড়ে রমেশ। এরূপ এক দুঃস্বপ্ন তাকে প্রচন্ড চিন্তিত করে তোলে। কলেজ জীবনে, তপন রায়ের বাড়ি গিয়ে সব বন্ধুরা মিলে কত হই – চই, কত আড্ডা, কত আনন্দ। তপন দাস ও উপস্থিত থাকতো সেখানে। তপন রায়ের মা, ওদের সকলের জন্য সুন্দর সুন্দর খাবার বানিয়ে আনতেন। সন্তানসম পুত্রদের খেয়াল রাখতেন , যথেষ্টই ভালোবাসতেন। রমেশদের সকলের খুব প্রিয় ছিল, তাদের ‘ কাকিমা’। এই দুঃস্বপ্নে তাই রমেশ বড়োই বেদনাহত। তাই তৎক্ষণাৎ ঠিক করে, সকালে যেভাবেই হোক, তপন রায় কে সে ফোন করে খবর নেবে। যদিও কর্মসূত্রে, দীর্ঘদিন প্রায় ১৩-১৪ বছর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়াতে কারোর নম্বর কারোর কাছে ছিল না। তাই অতি প্রত্যুষে ই সে মদন দা কে ফোন করে বলে ” তপনের নম্বর আছে ?” মদনদার দেওয়া নম্বরে ফোন করতেই অপর দিক থেকে এলো শোকাহত এক কণ্ঠস্বর।
হ্যালো কে?
রমেশ : তপন বলছিস? আমি রমেশ রে, বঙ্গবাসী কলেজ, ১৯৯৫ ব্যাচ।
তপন দাস : হ্যাঁ রে বল
রমেশ : তোরা সবাই কেমন আছিস? কাকিমা – কাকু কেমন আছেন? দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকায় ফোন নম্বরটাও ছিল না, মদন দা দিলো।
তপন দাস : আর, বলিস না রে। গতকাল রাতে মা মারা গেছেন । মনটা খুব খারাপ। বাবাও প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছেন। বোনটাকে রাখা যাচ্ছে না, খুব কষ্ট হচ্ছে রে!
রমেশ : কি বলছিস এসব ভাই !!! কীকরে হলো? কি হয়েছিল কাকিমার?
দাস : হার্ট অ্যাটাকে ভাই …….
রমেশ : খুব খারাপ খবর রে। আমার ও শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে। এখন তো আমি মুম্বাই তে আছি, কাজের খুব প্রেসার। মাস খানেক পর বাড়ি যাবো, তখন তোদের বাড়ি যাবো একবার। তোরা খুব সাবধানে থাকিস কিন্তু।
দাস : হ্যাঁ
ফোন টা রেখে, রমেশের দুঃখ ত্বরান্বিত হলো, এই দুঃস্বপ্ন সত্যি হবে, সে ভাবতেও পারে না। বারংবার ভেবেছে , তপন কে ফোন করলে ও যেন বলে , কাকিমা ভালো আছেন। চোখটা জলে ভরে উঠলো রমেশের। কাকিমার স্মৃতিচারণ করতে লাগলো সে , স্বভাবতই অশ্রুধারা আর বাধ মানলো না তার।
এরপর কেটে গেল দীর্ঘ ছয় মাস
মদনদা এতদিনে ধরে নিয়েছে রমেশ হয়তো তপন দাসের ফোন নম্বর ই চেয়েছিলো ! রমেশের এক মাস পর পাওয়া ছুটি ক্যানসেল হয়েছে, আজ দীর্ঘ ৬ মাস পর ছুটিতে বাড়ি আসছে রমেশ। এই ৬ মাসে একবারও আর তপনকে ফোন করার সাহস পায়নি সে, প্রবল শোকাচ্ছন্নতাই প্রধান কারণ। ভেবেছে, বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসবে। আজ প্লেন থেকে নেমে সে নিজ গৃহাভিমুখী হলো। ফ্লাইট লেট থাকায় বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই প্রায় রাত ১০:৩০ হয় তার রমেশের। ট্যাক্সি ধরতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ দেখলো পাশ দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত তপন রায়।
রমেশ : তপন, এই তপন ! আমায় চিনতে পারছিস? রমেশ রে, বঙ্গবাসী কলেজ , ১৯৯৫ ব্যাচ।
ফিরে তাকালো তপন রায়, বাল্যবন্ধু রমেশকে এত দীর্ঘ দিন পর দেখে আবেগবিহ্বল হয়ে পড়লো রায়। জড়িয়ে ধরলো বন্ধু কে।
রমেশ : কেমন আছিস? তোদের বাড়ির ৬ মাস আগের খবর টায় খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি
রায় : কোন খবর বলতো? ৬ মাস আগে ভাইটার মেয়ে হলো, পরিবারে প্রথম কন্যা সন্তান ! সবাই খুব খুশি , কিন্তু তুই দুঃখ পেলি কেন? আর এই খবরটা তুই পেলি ই বা কোথা থেকে?
হঠাৎ পাশ থেকে ডাক এলো, কি রে রমেশ? কেমন আছিস বাবা?
পাশ ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলো রমেশ।
রমেশ : কা… কা… কা….
প্রচণ্ড ভয়, শিহরণে গুটিয়ে গেল রমেশ
রায়ের মা : আমায় চিনতে পারছিস না বাবা? তোর কাকিমা? কলেজে পড়ার সময় কত এসেছিস আমাদের বাড়ি, ভুলে গেলি আমায়??
রমেশ : ত … ত (তপন রায়ের দিকে তাকিয়ে গোঙাতে থাকে রমেশ)
রায়ের মা : আশীর্বাদ করি বাবা
এই বলে , তপন রায়ের মা হাত বাড়ায় রমেশকে আশীর্বাদের উদেশ্যে।
হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় রমেশের, সে তো জানে তার প্রিয় কাকিমা মারা গেছেন! যার জন্য অশ্রুপাত করেছে সে। ফোনে তপনের থেকে এটাই তো শুনেছিল সে। সেই কাকিমা এখানে… কিছু বুঝতে পারে না রমেশ। ঘামে সারা শরীর ভিজে যায় তার। মাত্রাতিরিক্ত অ্যাড্রিনালিন হরমোন ক্ষরিত হতে থাকে তার। মৃত কাকিমা তার সামনে, মানে ভুত!!
রায় : কি হলো রমেশ, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?? এরম করছিস কেন?
এরপর ই তপন রায়ের মা এর হাত রমেশের শির স্পর্শ করে।
আর, নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না তপন। অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
তপন রায় ও রাস্তার লোক ধরা ধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায় তাকে।
প্রায় ৬ দিন পর জ্ঞান আসে রমেশের। সেবা যত্নের পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয় রমেশ। তপন রায় সর্বক্ষণ থাকতো তার কাছে, যতটা পারতো সাহায্য করতো।
কিছুটা সুস্থ হতেই রমেশকে অভয় দিয়ে তপন রায় সমস্ত ব্যাপারটা জানতে যায়। রমেশ তাকে সব কথা বলে, অবশেষে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে এবং রমেশ ও তপন রায় প্রথমে তপন দাসের বাড়ি যায় দেখা করতে এবং তারপর রমেশ গিয়ে তপন রায়ের মা ,তার প্রিয় কাকিমার কাছে গিয়ে তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে আসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *