প্রথাভাঙার সাহসী পদক্ষেপ : বাঙালী কন্যা ঊষসী করের বিয়ে ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

পিনাকী রঞ্জন পাল : বাঙালি বিবাহ মানেই এক ঐতিহ্যপূর্ণ, রীতিনীতি আর আচার-অনুষ্ঠানের সমাহার। তবে আধুনিক প্রজন্মের মধ্যে এই প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি এরই এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়েছেন ঊষসী কর, যিনি নিজের বিয়েতে প্রথাগত রীতি ভেঙে ফেলেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন সমাজমাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছে, তেমনই অন্যদিকে তুমুল সমালোচনার ঝড়ও বয়ে গেছে।

ঊষসীর বিয়ের শর্ত : এক বিপ্লবের সূচনা

ঊষসী কর তাঁর বিয়েতে দুটি শর্ত বাবাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমত, বাবার সারাজীবনের সঞ্চয় নিঃশেষ করে সোনার গয়না কিনবেন না। দ্বিতীয়ত, কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করবেন না। বাবার অর্থব্যয়ের প্রতি তাঁর এই সংবেদনশীলতা এবং পিতৃতান্ত্রিক ধর্মীয় ব্যবস্থার প্রতি তাঁর প্রতিবাদ এক সাহসী পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা যেতে পারে।

ইমিটেশনের গয়না: ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ

ঊষসী কর তাঁর বিয়ের দিন পরেছেন ৯৫% ইমিটেশনের গয়না। বাঙালি বিবাহে সোনার গয়নাকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক চাপ সৃষ্টি হয়, তা এড়িয়ে তিনি একটি সচেতন বার্তা দিয়েছেন। তাঁর মতে, “বাবার টাকায় ফুটানি মারা অত্যন্ত অশ্লীল।” এর বদলে নিজের প্রয়োজনীয় খরচ, যেমন জামাকাপড় ও ফটোগ্রাফার, নিজের টাকায় সামলেছেন।

ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এড়িয়ে

ঊষসী তাঁর বিয়েতে কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান রাখেননি। কন্যা সম্প্রদান, সিঁদুরদান, শাঁখা-পলা—সবই এড়িয়ে গেছেন। তাঁর মতে, এই আচার-অনুষ্ঠান পিতৃতান্ত্রিকতার প্রতীক। সমাজের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর এই অবস্থান এক নতুন ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।

প্রথা ও আধুনিকতার সংঘর্ষ

ঊষসীর বিয়ে আসলে প্রথা ও আধুনিকতার সংঘর্ষের একটি উদাহরণ। একদিকে রয়েছে ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখানোর চাপ, অন্যদিকে নিজের বিশ্বাস ও মতামত প্রতিষ্ঠার লড়াই। ঊষসীর মতে, “বাবার কষ্টের সঞ্চয় শেষ করে মেয়েকে সাজানোর প্রথা বন্ধ হওয়া উচিত।”

তবে তাঁর বাবা পুরোপুরি এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। ঊষসীর কথায়, “কিছু রোজকার ব্যবহার্য গয়না কিনতে বাধ্য হয়েছিলাম।” কিন্তু বিয়ের অধিকাংশ খরচ তিনি নিজেই বহন করেছেন।

সামাজিক প্রথার দৃষ্টিতে হয়তো ঊষসীর বিয়ে ছিল “আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি,” কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল এক সাহসী পদক্ষেপ। সমাজের চাপ থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মতো করে বিয়ে করার এই ভাবনাই হয়তো ভবিষ্যতে সমাজে বড়সড় পরিবর্তন এনে দেবে।

সমাজমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া: প্রশংসা ও ট্রোলিংয়ের দ্বন্দ্ব

ঊষসীর বিয়ের ছবি ও বক্তব্য পোস্ট করার পর থেকেই সমাজমাধ্যমে শুরু হয়েছে বিতর্ক। একদিকে অনেকেই তাঁর সাহসিকতাকে প্রশংসা করেছেন। কেউ বলেছেন, “এ ধরনের ট্যাবু ভাঙা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।” অন্যদিকে, সমালোচকরা একে “ঐতিহ্যের অবমাননা” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, “এ সব কার্টুন ধরনের বিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির অপমান।” কেউ তাঁকে ‘ছোটলোকি’ বলেছেন, কেউ আবার বিদ্রুপ করে বলেছেন, “নতুন কিছু না করলে কীভাবে আকর্ষণীয় হবে?” কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, “সোনা কিনতে না পারলে ইমিটেশনে সাজলেও বেনারসী কেন?” আবার কেউ সমর্থন করে লিখেছেন, “সোনার গয়না কেনার জন্য অনেক পরিবার চাপে পড়ে যায়। ইমিটেশন গয়না পরে বিয়ে করাই উচিত।”

সমাজের দুই পক্ষের তর্ক

ঊষসীর পদক্ষেপে সমাজ মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক পক্ষ তাঁর এই সাহসিকতাকে আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তার প্রতীক হিসেবে দেখছে। অপর পক্ষ একে বাঙালি বিবাহের ঐতিহ্য এবং রীতিনীতির প্রতি অবমাননা হিসেবে দেখছে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, ঊষসী সমাজের প্রচলিত চিন্তাধারায় ঝাঁকুনি দিতে পেরেছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বিবাহ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপিকা রোহিণী ধর্মপাল ঊষসীর এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে, “বিয়ে মানেই বিশাল খরচের আয়োজন নয়। সামান্য খরচে আইনি বিয়ে করলেই যথেষ্ট। ঊষসী এই প্রথাভাঙা পদক্ষেপে যে সাহস দেখিয়েছে, তা প্রশংসনীয়।”

অন্যদিকে শিক্ষিকা মোনালিসা মাইতির মতে, “ট্রোলিং যারা করে, তারা নিজেরাই হয়তো বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধির শিকার। নিজের মতো করে জীবন চালানোয় কোনো অন্যায় নেই।”

ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা: বিতর্কের কেন্দ্রে বাঙালি বিবাহ

বাঙালি বিবাহ প্রথার সঙ্গে আবেগ, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। একদিকে সিঁদুর, শাঁখা-পলা, সোনার গয়না—এসব ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। অন্যদিকে, ঊষসীর মতো প্রগতিশীল ব্যক্তিরা এসবকে পিতৃতান্ত্রিক এবং আর্থিকভাবে অযৌক্তিক বলে মনে করেন। এই বিতর্ক আসলে একটি বৃহত্তর প্রশ্নের জন্ম দেয়—আধুনিকতার নামে কতটা পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য?

ঊষসীর বার্তা: পরিবর্তনের পথে সাহসিকতা

ঊষসী করের বিয়ে শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত ঘটনা নয়। এটি একটি সামাজিক বার্তা বহন করে। তিনি দেখিয়েছেন যে বিয়ে কেবলমাত্র ঐতিহ্যের নাম করে বিশাল খরচ এবং ধর্মীয় প্রথার উপর নির্ভরশীল হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার প্রত্যেকেরই থাকা উচিত।সমাজের রীতিনীতি ও প্রথাগুলোর বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ প্রমাণ করে, পরিবর্তন সম্ভব। ঊষসীর এই সিদ্ধান্ত অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

শেষ কথা

ঊষসীর পদক্ষেপ বাঙালি বিবাহের প্রচলিত ধারণায় একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এটি একদিকে যেমন সমাজকে ভাবতে বাধ্য করছে, তেমনই অন্যদিকে প্রথাগত রীতির প্রতি ভালোবাসা এবং সম্মানের প্রশ্নও তুলছে। সমাজ হয়তো এই পরিবর্তন সহজে মেনে নেবে না, কিন্তু পরিবর্তনের পথে হাঁটতে গেলে এমন বিরোধিতা তো থাকবেই। আজ হয়তো ঊষসী একা, কিন্তু কাল তাঁর মতো আরও অনেক ঊষসী জন্ম নেবে, যাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্তে সাহসী হতে শিখবেন। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, ঊষসীর মতো মানুষেরাই নতুন পথে হাঁটতে সাহস দেখান, যা সমাজকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

Leave a reply

  • Default Comments (0)
  • Facebook Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *