মূল লেখক উমেশ চন্দ্র চতুর্বেদী
হিন্দি থেকে অনুবাদ : পিনাকীরঞ্জন পাল
এপ্রিল ১৫, ২৩২৫ এর সকাল। ভারতীয় বিজ্ঞান নগরী ‘শ্যামলা কুঞ্জ”এর উন্নয়ন আধিকারিক রম্মু সাহেবের বাড়ির যন্ত্রমানব ‘এক্স-৩৩’-র মন কিছুতেই নিজের কাজে বসছিল না। সে একটা ঘটনা নিয়ে ভীষণভাবে বিব্রত ছিল। ঘটনাটা তার কাছে অবশ্য আশ্চর্যজনকও বটে। গতকাল সে একটি ব্রেকটাই নেওয়ার পরিবর্তে লুকিয়ে দুটো ব্রেকটাই নিজের বাহুর নির্ধারিত স্থানে ভরে নিয়েছিল। একটা ব্রেকটাই তার চব্বিশ ঘণ্টার আহার। তা হলে দুটো ব্রেকটাই একই দিনে কি করে শেষ হয়ে গেল? এমনটা অবশ্য গতকাল সে প্রথমবার করেনি। এর আগে যখনই সে লুকিয়ে দুটো ব্রেকটাই আত্মসাৎ করত তো দু’দিন পুরো তার খিদে পেত না। কিন্তু আজই প্রথম এমনটা হল যে, দুটো ব্রেকটাই একদিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে সে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিল। ভাবছিল যে তার কোন মারাত্মত্মক অসুখ করেনি তো।
পুরনো আমলের রোবটরা যদি আজকের এই এক্স-৩৩’কে দেখতে পেত তবে অবশ্যই চমকে উঠত। কেননা, আজকালকার যন্ত্রমানবরা শুধু চিন্তাই করার ক্ষমতা রাখে না, তারা আহার করা পর্যন্ত শুরু করেছে। এই ব্রেকটাই তাদের প্রধান আহার। অবশ্য মানুষের সঙ্গে এদের আহার করার অনেক পার্থক্য ছিল। তারা মুখ দিয়ে | আহার করত, সেগুলো পেটে পৌঁছাত কিন্তু এক্স-৩৩ তার আহার্যবস্তু নিজের বাহু নির্ধারিত খোলে ভরে নেয়। সেখান থেকেই সে সম্পূর্ণ শরীরের জন্য শক্তি পেয়ে থাকে। এই এক্স-৩৩’র নির্মাণ ভারতীয় বিজ্ঞানী ডাঃ সালমন বায়জাদা করেছিলেন। আহার ভরবার নির্দিষ্ট স্থান বাহুতে করার প্রস্তাব অবশ্য তিনি স্বয়ং দিয়েছিলেন। ব্রেকটাইগুলোও ছিল এক বিচিত্র বস্তু। মাটি আর বালুর মিশ্রণে তড়িৎপ্রবাহের প্রচণ্ড প্রত্যাঘাতে তৈরি এই ব্রেকটাইগুলি যন্ত্রমানবরা অতি সানন্দে আহার করে।
সাড়ে দশটা নাগাদ ডাঃ রমেশ রম্মু সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এলে রম্মুবাবু এক্স-৩৩’কে নোনতা রুটি আর চাফি আনার জন্য বলে। এই নোনতা রুটি আর চাফি আজকালকার লোকেদের ফেভারিট ব্রেকফাস্ট। তেল-মশলাবিহীন এই রুটি ঘাস আর শাক দিয়ে তৈরি হয়। তবুও নাকি ভীষণ সুস্বাদু। চা আর কফিকে মিলিয়ে তৈরি করা হয় চাফি।
প্রায় কুড়ি মিনিট পরে এক্স-৩৩ ব্রেকফাস্ট নিয়ে উপস্থিত হয়। কাজের প্রতি এতটা অমনোযোগী ও তো আগে কখনও ছিল না। এইজন্য রম্মু সাহেব এক্স-৩৩’কে ধমক দিয়ে বলেন, ‘প্রত্যেকটা কাজে এত সময় লাগছে কেন….আগে তো এরকম ছিল না। কি হয়েছে আজকে তোর ?”
“আজ্ঞে…সাহেব…. আজ আমার শরীরটা বিশেষ ভাল নেই। এক্স-৩৩’র দুর্বল জবাব।
‘তোর শরীর দেখব নাকি নিজের ডিউটি। এদিকে আমার যে দেরি হয়ে যাচ্ছে, সেটা জানিস না’, রম্মু সাহেবের রাগ তখনও কমেনি।
সাহেবের ধমক খেয়ে এক্স-৩৩ আরও ভেঙে পড়ে। দুঃখে তার মাথায় লাল রঙের রেখা ফুটে উঠতে থাকে। যখন সে দুঃখী হত তখন এমনই হত। আর প্রসন্ন থাকলে তার মাথায় কমলা এবং সবুজ রঙয়ের লেখা ফুটে উঠত। আবার যখন সে হতাশ হয়ে পড়ত, তখন নীল-কালো রেখা ভেসে উঠতো।
এক্স-৩৩’র এই দুঃখের মুহূর্তে সাহেবের স্ত্রী ললিতা ম্যাডামের কথা মনে পড়ে। তিনি ওকে ভীষণ ভালবাসতেন। কিন্তু এখন তো তিনি এখানে নেই। আমেরিকার অন্তরীক্ষ নগরী ‘নিউগিনি সিটি’র ভাইরাস ইঞ্জিনিয়ার রূপে বর্তমানে সেখানেই কর্মরত রয়েছেন। প্রতি মাসের ১০, ২০ এবং ৩০ তারিখে তিনি ছুটিতে বাড়ি আসেন। এক্স-৩৩ হিসাব কষে দেখে যে বাড়ি ফিরতে তার আর পাঁচদিন বাকি রয়েছে। তার মন খুশিতে নেচে ওঠে, ‘আসতে দাও ললিতা ম্যাডামকে। এমন বকা খাওয়ার যে, সাহেব তা চিরদিন মনে রাখবেন। এখন তো আর তিনি আগের মত ভীতু স্ত্রী নন’।
এক্স-৩৩’র মাথায় লাল রেখা দেখে ডাঃ রমেশের দুঃখ হয় এবং তিনি বন্ধুকে বলেন, ‘তুই কিন্তু মিছি-মিছিই ওকে বকাঝকা করছিস। আমার মনে হয় ওর সত্যিই শরীর খারাপ।
‘তুইও পারিস। ওসব ছেড়ে অন্য কথা বলত। রম্মু সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন।
রমেশ একজন যন্ত্রমানব চিকিৎসক। যন্ত্রমানবদের চিকিৎসার জন্য তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত সম্মান ভারতের অ্যাপেলো মেডিকেল কলেজ (যন্ত্রমানব প্রতিষ্ঠান) বারাণসী থেকে অর্জন করেছেন। শুধু ভারতেই নয়, বিদেশেও তিনি প্রসিদ্ধ।
কাপ-ডিশ পরিষ্কার করতে করতে এক্স-৩৩ রম্মু সাহেবের শেষ কথাগুলি শুনে নিজেকে প্রচণ্ড সে মনে আঘাত পায়। সে তৎক্ষণাৎ রম্মু সাহেবের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
গড়গড় করে রম্মু সাহেবের কাছে এসে এক্স-৩৩ বলে, ‘আমাকে আপনার চাকরি থেকে ছুটি দিন, সাহেব’। এক্স-৩৩’র মুখ থেকে কথাগুলি শুনে রম্মু সাহেবের সঙ্গে ডাঃ রমেশ নিজেও হতবাক হয়ে পড়েন। এক্স-৩৩ যে এতটা ভাবপ্রবণ হয়ে উঠেছে, তাঁরা এটা চিন্তাও করতে পারেননি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে এবার রম্মু সাহেব কোন রকমে এক্স-৩৩’কে বুঝিয়ে ডাঃ রমেশের হাসপাতালে যেতে রাজি করান।
কিছুক্ষণ পরে তিনজনকেই ডাঃ রমেশের হাসপাতালে ঢুকতে দেখা যায়। সেখানে অসুস্থ যন্ত্রমানবদের ভিড় লেগেই ছিল। ডাক্তারবাবুকে দেখে তারা লাইন দিয়ে দাঁড়াতে শুরু করে।
ডাঃ রমেশ এক্স-৩৩’কে নিয়ে সোজা নিজের চেম্বারে চলে যান। সেখানে ওর সমস্যাগুলি শুনে প্রথমে তো চুরি করে ব্রেকটাই নেওয়ার জন্য বকা দেন, তারপর ওকে পরীক্ষা করতে শুরু করেন।
পরীক্ষা করে তিনি জানতে পারেন যে, এতকাল এক্স-৩৩’কে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। অত্যধিক পরিশ্রম করলে ক্লান্তি আসাটাও স্বাভাবিক। আর এই ক্লান্তি দূর করতে অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন দেখা দেয়। এইজন্যই দু’টি ব্রেকটাই গতকাল শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ডাঃ রমেশ এন্ম-৩৩-এর শরীরের মধ্যভাগ পরীক্ষা দেখেন যে, মানুষের স্নায়ুর মতই এক্স-৩-এ কয়েলগুলি অভিশয় অনুভূতিপ্রবণ উঠেছে। তাঁর উপলব্ধি ছিল চমকে দেওয়ার মত। তিনি পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে এক্স ৩৩র সমস্যা মূলত মনস্তত্ত্বভিত্তিক। এইজন্য তিনি রম্মু সাহেবকে একান্তে ডেকে বোঝান, এখন থেকে যেন তিনি এক্স-৩৩’র প্রীতিপূর্ণ, ব্যবহার করেন।
এরপর তিনি এক্স-৩৩’কেও একান্তে নিয়ে বোঝান, ‘আর কোনদিন চুরি করবে না। তোমার শরীর ঠিকই আছে। যেদিন বেশি কাজ করবে, তো বেশি ব্যয় হবেই। এইজন্যই গতকাল দু’টি ব্রেকটাই শেষ গিয়েছিল। আর শোন…. রম্মু যদি কখনও অল্পস্বল্প বকাও তবে তারজন্য যদি এতটা মন খারাপের কি আছে। তুমি তো আর ওর চাকর নও। তুমি তো ওর পরিবারেই একজন সদস্য। মন খারাপের কোন প্ৰশ্নই ওঠে না।
এক্স-৩৩ মনোযোগ দিয়ে ডাঃ রমেশের কথাগুলি শুনল।
“‘আচ্ছা, আমার একটা কথা মানবে এক্স -৩৩”
“হ্যাঁ।”
“তবে কথা যে, এখন থেকে আর তুমি মনখারাপ করবে না।”
“‘প্রমিস’, ‘বলে এক্স-৩৩ ডাঃ রমেশের সঙ্গে করমর্দন করে। তারপর রম্মু সাহেব এবং এক্স ৩৩ নিজেদের বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়।
অন্যদিকে ডাঃ রমেশ নিজের সহকারি ডাক্তারকে রোগীদের আদেশ দিয়ে এক্স-৩৩’র ভাবনাগুলিকে ভালমত বোঝার জন্য গবেষণাগারে প্রবেশ করেন।