একটি স্বর্ণমুদ্রা (নেপালের লোককথা)

পিনাকী রঞ্জন পাল : নেপালের এক গ্রামে একটি ভীষণ দরিদ্র দম্পতি বাস করত। তারা এত দরিদ্র ছিল যে দিনে দুবেলা খাবারও জুটত না। বাহাদুর নামে তাদের বার বছরের একটি ছেলে ছিল। বাহাদুর সবসময় খেলেই কাটাত। বাহাদুরের বাবা শমশের বাহাদুর সর্বদা নিজের ভাগ্য নিয়েই চিন্তা করত।

বাহাদুরের মা তাকে বারবার বোঝাত, আমি জানি যে তোমার স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না, কিন্তু তবুও তোমাকে কিছু তো অবশ্যই করতে হবে, এইভাবে দিনের পর দিন কাটান সম্ভব নয়।

—”ঠিক আছে, এখন চুপ করো তো। কাল কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ব। আমার এই ভগ্নস্বাস্থ্য দেখে কেউ কাজ দিতে রাজি হয় না। কাকে গিয়ে বলব।” শমশের বিরক্তি সহকারে জবাব দেয়।

–”কিছু না কিছু তো করতেই হবে।” বাহাদুরের মা জোর দিয়ে বলে আর শমশের বাহাদুর ভাঙা খাটিয়ায় বসে হুকোয় টান দিতে থাকে।

সেদিন বিকেলে বাহাদুর তার বন্ধুদের সঙ্গে মাটির ঘর তৈরি করে খেলা করছিল। হঠাৎ তার দৃষ্টি কোন চকচকে জিনিসের ওপর পড়ে। সে দৌড়ে গিয়ে জিনিসটি হাতে নিয়ে দেখে যে একটি স্বর্ণমুদ্রা। বাহাদুর খুশিতে নেচে ওঠে।

সে ঘরে ফিরে জিনিসটি বাবাকে দেখায়। সোনার মুদ্রা দেখে বাহাদুরের মা-বাবার আনন্দের সীমা থাকে না। তারা তিনজন নিলে চিন্তা করতে থাকে, “এই সোনার মুদ্রা দিয়ে কি কেনা যায়?”

— “এই মুদ্রার বদলে আমাদের একটি ভেড়া কেনা উচিত। তার উল বেঁচে আমরা জীবিকা চালাতে পারব।” বাহাদুরের বাবা সর্ব প্রথমে পরামর্শ দেয়।

কিন্তু বাহাদরের মা’র এই পরামর্শ পছন্দ হয় না। সে বলে, “বাহাদুর সোনা আমার। তোমার পিতা কোন পছন্দসই পরামর্শও দিতে পারে না। ওর কথা শুনো না। আমাদের তো এই মুদ্রার পরিবর্তে প্রচুর পরিমাণে খাবার জিনিস কিনে আনা উচিত, যাতে কিছুদিন পর্যন্ত আমরা আরামে থাকতে পারি।”

— “না মা, না! খাবার জিনিস কেনাটা বেকার হবে। কিছুদিন পরেই তো আবার না খেয়ে মরতে বসতে হবে। আমি তো এই মুদ্রা দিয়ে কোন অদ্ভুত জিনিসই কিনতে চাই।” বাহাদুরের কথা তার মায়ের মনে ধরে না, তাই সে রাগ করে মুখ ফিরিয়ে বসে।

— “বাহাদুর, সোনা। বাবা আদর করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, এই মুদ্রা নিয়ে আমরা কিছু মুরগিও তো কিনতে পারি। তাদের ডিম বেচে পয়সা হবে এবং খাবার কাজেও আসবে।”

— “অনেক হয়েছে, তোমাকে আর মাথা খাটাতে হবে না! চলেছেন মুরগি কিনতে,”‘ বাহাদুরের মা মুখ বেঁকিয়ে বলে।

— “মুদ্ৰা আমি পেয়েছি, অর্থাৎ এর মালিক আমি। এটা দিয়ে আমি পৃথিবীর কোন অদ্ভুত জিনিস কিনব।'” বলে বাহাদুর স্বর্ণমুদ্রা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে বাজারের দিকে রওনা হয়।

বাজারে পৌঁছে বাহাদুর প্রত্যেক দোকানদারকে স্বর্ণমুদ্রা দেখিয়ে বলে, “এই মুদ্রার বদলে আমি পৃথিবীর আশ্চর্যজনক জিনিস চাই।”

বাহাদুরের কথা শুনে সকলেই হেসে উঠে। আর এক দোকানদার তো বলেই ফেলল যে, “তোমার থেকে আশ্চর্যজনক কি আর কিছু আছে।”

কারও কথা না শুনে বাহাদুর বাজারে ঘুরতে থাকে। তখন সে দেখে এক দোকানে একটি বাঁদর নানারকম কেরামতি দেখাচ্ছে। নাচ-গানও করছে। তার বাঁদরটাকে ভীষণ পছন্দ হয় এবং দোকানদারকে গিয়ে বলে, “আপনি এই স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে আমাকে বাঁদরটি দেবেন কি?”

একটি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বাঁদর চাইছে শুনে দোকানদার আনন্দে নেচে ওঠে এবং বলে, “শুধু বাঁদর নয় এর সঙ্গে তোমাকে শিকলও দেব।” বাহাদুর স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে শিকল ধরে বাঁদর নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

স্বর্ণমুদ্রার বদলে একটি বাঁদর নিয়ে আসায় বাহাদুরের মা-বাবা দারুণ রেগে যায়। মা বলে, “ঘরে তিনজনেরই খাবার নেই, হয়েছে। আবার এক প্রাণীকে আনা হয়েছে।”

প্রথম দু-চারদিন তো বাঁদর বেশ শান্ত ছিল। কিন্তু তারপরেই শুরু হয়ে গেল তার নাচন-কোঁদন। সে প্রতিবেশীদের ছাদে, কখনও বা তাদের ঘরে গিয়ে ক্ষতি করে আসত। প্রতিবেশী সকলে বাঁদরের জ্বালাতনে অতিষ্ট হয়ে নালিশ করতে আসে বাহাদুরের মা-বাবার কাছে। তারা আগেই দুঃখী ছিল, প্রতিবেশীদের নালিশ শুনে আরও দুঃখী হয়ে পড়ল।

একদিন, নাচন-কোঁদন করতে করতে বাঁদর গ্রাম ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে যায়। সেখানে গভীর জঙ্গলে এক পাকাবাড়ির ছাদে গিয়ে বসে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে বাঁদর সেখানে কারও দেখা পায় না। বাড়ি ছিল নিস্তব্ধ। তবে একটি ঘরে প্রচুর হীরে মোতি জড়ো করা ছিল। বাঁদর মুঠো করে হীরে মোতি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে হীরেমোতিগুলি বাহাদুরকে দিয়ে দেয়। বাহাদুর বাঁদরের কৃতিত্বে ভীষণ খুশি হয়। এইভাবে বাঁদর রোজ দুপুরে সেই জঙ্গলবাড়িতে যেত এবং যতটা সম্ভব হীরে মোতি সঙ্গে করে নিয়ে আসত। তখন বাহাদুরের মা বাঁদরকে ভাল ভাল খাবার রান্না করে খাওয়ায়। সম্পূর্ণ পরিবারে চাঁদের হাট বসে গিয়েছিল।

বাঁদর যে জঙ্গল-বাড়ি থেকে হীরে মোতি আনত সেটা ছিল এক রাক্ষসের। হীরে মোতি কমে যেতে থাকায় রাক্ষস চিন্তায় ডুবে যায়। সে ভাবে, চোরের সন্ধান করা ভীষণ জরুরি, নয়ত সব হীরে মোতি নিয়ে যাবে।

চোরকে ধরার জন্য সেদিন রাক্ষস বাইরে না গিয়ে ঘরেই লুকিয়ে থাকে। প্রতিদিনের মত সেদিনও বাঁদর এসে নির্ভয়ে হীরে মোতি নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালে রাক্ষস তার হাত ধরে বলে, “আহ! তুমিই তবে সেই চোর। আজ ধরা পড়ে গেছ।”

অচানক রাক্ষসকে দেখেও বাঁদর বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে বলে, “আরে মামা। তুমি কেন শুধু শুধু নিজের ভাগ্নের প্রতি ক্ষেপে যাচ্ছ?”

—”মামা? ভাগ্নে? কি সব কথা বলছ?” রাক্ষস আশ্চর্য হয়ে বলে।

— “ও, তা হলে তুমি আমাকে চিনতে পারোনি। অবশ্য চিনবেই বা কেমন করে? মা আমাকে কখনও এখানে নিয়ে আসেনি। তুমিও আমাকে ভুলে গেলে,” বাঁদর কাঁদো কাঁদো স্বরে জানায়।

তারপর লাফ মেরে বলে, “কিন্তু মামা, আমি তোমাকে ভুলিনি। মামীর মৃত্যুতে আমরা ভীষণ দুঃখ পেয়েছি।” বাঁদর রাক্ষসের উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই বলে যাচ্ছিল, “আমি নতুন মামীর সন্ধান করার জন্য এখানে এসেছি। পাশের এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছি।”

— “নতুন মামী…”

— “হ্যাঁ, মামা, তোমার জন্য দ্বিতীয় স্ত্রী।”

— “মামা, এতো অল্প বয়সে ভগবান তোমাকে যত দুঃখ দিয়েছে এটা ভেবে মা প্রায় কাঁদেন।”

— “কিন্তু……”

— “তাই আমি তোমার জন্য এক সুন্দর মেয়ে দেখেছি। তোমাকে নিয়ে আমাদের ভীষণ চিন্তা।”

— “সুন্দর মেয়ে। কিন্তু প্রথমে আমার হীরে মোতি এনে দাও।”

— “আরে মামা, আমি তোমার হবু স্ত্রীর জন্যই তো হীরে মোতি নিয়ে গেছি। তাকে তোমার ধনবান হবার প্রমাণ দেওয়ার জন্য। সেই হীরে মোতিগুলি দিয়ে তার গলার হার তৈরি হবে।”

রাক্ষস বাঁদরের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করে ফেলে। সে তার হবু স্ত্রীর সম্পর্কে আরও অধিক জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

বাঁদর রাক্ষসকে তার হবু স্ত্রী সম্পর্কে এমন সুন্দর করে বর্ণনা করে যে রাক্ষসের বাঁদরের প্রতি বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না, সে নতুন স্ত্রীর কল্পনা করতে থাকে।

— “আচ্ছা মামা, এখন আমাকে যেতে হবে। কেননা, আমার হবু মামী আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তা আমি কি অল্প কিছু হীরে নিতে পারি, যা দিয়ে হবু মামী বিয়ের কাপড় কিনবে।” এতটা বলে বাঁদর দু’মুঠো হীরে নিয়ে রওনা দেয়।

এভাবে বাঁদর হবু স্ত্রীর নামে রাক্ষসের প্রায় সমস্ত ধন-সম্পদ বাহাদুরের ঘরে পৌঁছে দেয়। তারপর সে বাহাদুরকে সমস্ত কথা খুলে বলে।

রাক্ষসের কথা শুনে সবাই ভীত হয়ে পড়ে এবং বলে, তুমি তাকে এত বড় মিথ্যে কথা বল এখন তার স্ত্রী আমরা কোথায় পাব? আর তার বিয়ে দিতে না পারলে সে আমাদের সকলকে মেরে ফেলবে।

– “বৃথাই এতে ভয় পাচ্ছো, আমার পরবর্তী পরিকল্পনা তো আগে শোন।”

— “কোন ভাল উপায় বার করো?” বাহাদুরের মা বাবা প্রায় অনুরোধ করে।

— “দেখো, আমরা ঘাস-পাতা দিয়ে একটা পুতুল তৈরি করব। তাকে নববধূর সুন্দর দেখে পোশাক পরিয়ে দেব।'”

— “কিন্তু এতে কি হবে?”

— “দেখতে থাক এর পরে কি কি ঘটে?’

সবাইকে শান্ত করে বাঁদর রাক্ষসের কাছে দিনক্ষণ ঠিক করে আসে। রাক্ষস অধীরভাবে সেই দিনের অপেক্ষা করতে থাকে।

বিয়ের একদিন আগে বাঁদর রাক্ষসের কাছে পুনরায় গিয়ে সমবেদনা জানিয়ে বলে, “মামা, মনে হচ্ছে তোমার একাকিত্ব ঘোচাবার দিন এখনও আসেনি।”

— “কি বলতে চাইছো, পরিষ্কার করে বল?”

— “আমি একজন নামী পণ্ডিতের কাছ থেকে আসছি। তিনি বললেন যে কাল তোমার বিয়ের মুহূর্ত নেই। এক মাস পরে একটি ভাল দিন রয়েছে।'”

— “কিন্তু আমি আর এক মাস অপেক্ষা করতে পারব না, কোন উপায় বার কর।”

— “আমি পণ্ডিত মশাইয়ের কাছ থেকে উপায়ও জেনে এসেছি।”‘

— “তাড়াতাড়ি বল।”

—”বলছি, ধৈর্য ধর, প্রথমে কিছু ফলাহার করে নেই, প্রচণ্ড ধকল গিয়েছে আজ।'”

— “হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই নাও, যা মন চায় যাও।” বলে রাক্ষস ফলের ঝুড়ি বাঁদরের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

বাঁদর পেট ভরে ফলাহার করার পর বলে, “মামা, পণ্ডিত মশাই বলেছেন, যদি কাল তুমি বিয়ে কর তবে পনেরো দিন পর্যন্ত তোমার স্ত্রীকে দেখবে না, স্পর্শও করবে না। কেননা, বর্তমানে শনির দশা চলছে। যদি তুমি পণ্ডিতের কথা না মান অথবা স্ত্রীকে স্পর্শ কর তবে সঙ্গে সঙ্গে সে ঘাস-পাতার হয়ে যাবে। বিয়ে হতেই স্ত্রী এখানেই আলাদা থাকবে। কি রাজি তো?”

– “ঠিক আছে, আমি রাজি।” রাক্ষস তার স্বীকৃতি দিয়ে দেয়।

বিয়ে হয়ে যাবার পর সুন্দর কাপড় পরা নববধূকে রাক্ষসের বাড়ির এক ঘরে শুইয়ে দেওয়া হয়, এই বলে যে, “একে বিশ্রাম করতে দাও আর পণ্ডিতের কথা সর্বদা মনে রাখবে।”

বাঁদর নিজের বাড়ি ফিরে যায়। নবধুর ঘরের দরজা সর্বদা বন্ধই থাকে। রাক্ষস উৎসাহের বশে ঘুলঘুলি দিয়ে তাকে দেখত আর মনে মনে ভাবত, “স্ত্রী সবসময় একদিকেই ফিরে শুয়ে থাকে কেন। নড়ে না, চড়ে না। তবে কি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল নাকি?”

শেষে আর থাকতে না পেরে একদিন রাক্ষস তার স্ত্রীর ঘরের দরজা খুলে তাকে ছুঁয়ে দেখে, কিন্তু কোন নড়াচড়া করে না। তাকে ধরে জোরে নাড়ালে সেই ঘাস পাতার বধু এক দিকে গড়িয়ে পড়ে। রাক্ষসের বুক অনুশোচনায় ফেটে পড়ে। সে এটাই ভাবে যে তার স্পর্শ করার জন্যই সে ঘাস-পাতার হয়ে গেছে। নিজের ওপর তার দারুণ ক্রোধ হয়। সে দ্বিতীয় স্ত্রী আর সমস্ত ধন-সম্পদ হারিয়ে কাঁদতে বসে।

তাহলে এক স্বর্ণমুদ্রায় কেনা সেই বাঁদরটি সত্যি সত্যিই পৃথিবীর আশ্চর্যজনক জিনিস ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *