লেখক পঙ্কজ সেন
বর্তমান জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলা মোড়ে অবস্থিত জলপাইগুড়ি শহরের দ্বিতীয় (প্রথম বান্ধব নাট্য সমাজ বা দীপ্তি টকিজ) পুরনো সিনেমা হল হলো “আলোছায়া” বা বর্তমান “রূপমায়া”। ১৯৪৮ সালে শহরের বাবু পাড়ার বাসিন্দা কালু সিংহ এই সিনেমা হল গড়ে তোলেন পরিবারের দুই কন্যা আলো ও ছায়ার নামে। হলটির প্রতিষ্ঠাতা (ফাউন্ডার) ছিলেন তৎকালীন জলপাইগুড়ি শহরের জেলা কংগ্রেস সভাপতি ডক্টর ধীরাজ মোহন সেন। হলে প্রদর্শিত সর্বপ্রথম ছবি হলো মাইকেল মধুসূদন (বাংলা)।

পরবর্তীতে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আলোছায়া হলের মালিকানা পরিবর্তিত হয়। কালু সিংহ হলটির মালিকানা অর্থের বিনিময়ে হস্তান্তর করেন তৎকালীন জলপাইগুড়ি শহরের বিশিষ্ট মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী চম্পালাল সারোগীর কাছে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত শহরের এই অতি পুরনো হলটির মালিকানা ও পরিচালন ক্ষমতা সারোগী পরিবারের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। এই সময়ে চম্পা লাল বাবু হলের পূর্ব নামকরণ (আলোছায়া) পরিবর্তন করে তার বড় নাতনি মায়া সারোগী’ র নামে করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। হলের নতুন নাম স্থির করা হয় “রূপমায়া”। মায়া সারোগী বর্তমানে উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে বিবাহ সূত্রে রয়েছেন। সারোগী পরিবার কর্তৃক হলে প্রদর্শিত প্রথম ছবি ছিল, বাংলা ছায়াছবি “বিষ কন্যা”(১৯৫৬)। এই সময় থেকে রূপমায়া হলের ম্যানেজার ছিলেন জলপাইগুড়ি শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামী লক্ষণ মৌলিক। এক দীর্ঘ সময় তিনি এই হলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৪ সালে বার্ধক্য জনিত কারণে চম্পালাল বাবুর মৃত্যু হলে রূপমায়া হলের পূর্ণ দায়িত্ব তার দুই ছেলের উপর বর্তায়। তারা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দায়িত্ব সহকারে হলের পূর্ণ রক্ষনাবেক্ষণ আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে করে এসেছে।
৮৪৫ আসন বিশিষ্ট রূপমায়া হলে বর্তমানে মোট ছয় থেকে সাত জন কর্মী রয়েছেন। যেমন, লাইট ম্যানের কাজে যুক্ত আছেন রানা দাস ও প্রদীপ ভৌমিক, টিকিট বুকিং ক্লার্ক মানিক ঘোষ ও শ্যামল ঘোষ। শ্যামল ঘোষের বাবা মৃত গণেশ ঘোষ এক দীর্ঘ সময় রূপমায়া হলের স্থায়ী ও পুরনো কর্মী ছিলেন।
১৯৬৭ সালে শাম্মী কাপুর ও আশা পারেখ অভিনীত বলিউড ছবি “তিসরি মঞ্জিল” প্রদর্শনের সময় হঠাৎ হলে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় উত্তেজিত দর্শক ক্ষিপ্ত হয়ে হলের বেশ অনেকগুলি চেয়ার ভাঙচুর করে। একটি মাড়োয়ারি ছবি “নান্নী বাঈ কি মায়রো” প্রায় এক মাস এবং “জয় সন্তোষী মা” দুই মাস চলেছিল। ২০০০ সালে জিৎ অভিনীত বাংলা ছবি “সাথী”একটানা ২২ সপ্তাহ রূপমায়া হলে প্রদর্শিত হয়, যা এই হলে আজও রেকর্ড। দেব অভিনীত প্রথম সুপারহিট ছবি “আই লাভ ইউ” রূপমায়া হলে প্রদর্শনের সময় একদিন স্বয়ং টলিউড অভিনেতা দীপক অধিকারী বা দেব রূপমায়া হলে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেদিন সারা শহরে দেবের আগমন উপলক্ষে এক আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। এছাড়া ২০০৮-০৯ সালে টলিউড অভিনেতা অঙ্কুশ রূপমায়া হলে পা রেখেছিলেন। ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জলপাইগুড়ি শহরের বিভিন্ন ক্লাব মাঝেমধ্যেই রূপমায়া হলে চ্যারিটি শোয়ের ব্যবস্থা করত, বর্তমানে যা একেবারেই বন্ধ।
রূপমায়া হলের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, হলটি খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং বেশিরভাগ সময় বাংলা ছায়াছবি প্রদর্শিত হয়। তবে হিন্দি বই মাঝেমধ্যেই লাগানো হয়, যেমন “দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে”, ” হান্ডেড ডেজ” ইত্যাদি হিন্দি ছবিও প্রদর্শিত হয়েছিল।

কেবল ও মোবাইলের দাপটে সারা দেশের সঙ্গে জলপাইগুড়িতেও সিনেমা হলের সেই পূর্বের গরিমা আজ আর না থাকলেও, রূপমায়া হলের বর্তমান কর্তৃপক্ষ তাদের পূর্বপুরুষের এই অমূল্য সম্পদকে যে কোনো মূল্যে বজায় রাখতে চান। ২০০৬ সালে রূপশ্রী হলের যে করুন পরিণতি হয়েছিল, রূপমায়া হলের ক্ষেত্রে তা কখনোই হবে না বলে সারোগী পরিবার বিশ্বাসী এবং একমত। হলে বর্তমানে দর্শকের উপস্থিতি কম থাকলেও তারা হল চালিয়ে যাবেন। আমরা আশাবাদী আজ না হোক কাল হলের সেই পূর্ব স্বর্ণযুগ পুনরায় ফিরে আসবে। আবার জন কোলাহলে গমগম করবে রূপমায়ার চারিদিক। সেই দিন অতি দ্রুত ফিরে আসুক এই কামনা করি।
তথ্য সহায়তা : সারোগী পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রী বাবলু সারোগী।