আনন্দচন্দ্র কমার্স কলেজ ও জলপাইগুড়ি

লেখক পঙ্কজ সেন

সমগ্র উত্তরবঙ্গের মধ্যে সর্বপ্রথম বাণিজ্য শাখার কলেজ হল জলপাইগুড়ি আনন্দ চন্দ্র কমার্স কলেজ। এটি জলপাইগুড়ি জেলা তথা শহরের একটি স্বনামধন্য প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। জলপাইগুড়ি কমার্স কলেজ ১৯৬২ সালের ৫ই নভেম্বর শহরের সোনাউল্লা বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে সান্ধ্য বিভাগে মাত্র ৫৪ জন ছাত্র দিয়ে তার যাত্রা শুরু করে। তৎকালীন কলেজের উপাধ্যক্ষ ডক্টর দীনেশ বিশ্বাস অধ্যাপক নরেশ চন্দ্র ভৌমিককে জলপাইগুড়ি শহরে একটি সান্ধ্য বাণিজ্য বিভাগ স্থাপনের প্রস্তাব দেন এবং সেই সাথে শিক্ষক পদের জন্য আবেদন করার আহ্বান জানান। অবশেষে নরেশ বাবু ১৯৬২ সালের ১০ই ডিসেম্বর এই সান্ধ্য কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে এই কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে স্থান সংকুলানের অভাবে কলেজটিকে সোনাউল্লা বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে আনন্দচন্দ্র কলেজের সান্ধ্য বিভাগের স্থানান্তরিত করা হয়।

আনন্দ চন্দ্র কলেজ জলপাইগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত হওয়ায় এবং অত্যন্ত কম জনবসতিপূর্ণ হওয়ার জন্য কলেজের কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যায় প্রতিকূল আবহাওয়া এবং যানবাহনের অভাবে বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হয়। এই সময়ের মধ্যে অধ্যাপক নরেশচন্দ্র ভৌমিক বাণিজ্য বিভাগটি টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে শহরের মধ্যে একটি নিজস্ব প্রাঙ্গণ স্থাপন করার স্বপ্ন দেখেন, যাতে সকল অসুবিধা দূরীভূত হয়। এই সময় সৌভাগ্যবশত নরেশবাবু ছাত্রদের কাছ থেকে টিউশন ফ্রী এবং অন্যান্য আরো কিছু ক্ষেত্র থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে তৈরি করা কলেজ তহবিল থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্র ডিবিসি রোডে অবস্থিত “আলিমা মঞ্জিল” (নূর মঞ্জিলের বিপরীতে অবস্থিত) নামে পরিচিত ভবনটি এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকায় ক্রয় করেন এবং কলেজে রূপান্তরিত করেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, জলপাইগুড়ি শহরের বিশিষ্ট উকিল ও চা শিল্পপতি খান বাহাদুর ওয়ালিয়ার রহমান তার মা আলেমা খাতুনের স্মৃতিতে এই ভবনটি নির্মাণ করেন। অবশ্য এই ক্ষেত্রে শহরের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষাবিদ নরেশ বাবুর এই প্রচেষ্টায় সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন। ভবন ক্রয়ের মত এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নরেশবাবু কলেজের সকল শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, সহকর্মীদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং তাদের থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছিলেন। কলেজের ছাত্ররা ছিল নরেশ বাবুর অনুপ্রেরণা এবং তারাই তাকে এই সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

খুবই অল্প সময়ের মধ্যে অধ্যাপক ভৌমিকের সুদৃঢ় নেতৃত্বে কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষ স্থান তৈরি করে। কলেজের নিজস্ব ভবন তৈরি হবার পর নরেশবাবু আনন্দ চন্দ্র কমার্স কলেজের এক পৃথক পরিচয়ের কথা ভেবেছিলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় আনন্দ চন্দ্র কমার্স কলেজের অন্তর্ভুক্তি মঞ্জুর করে। তাই প্রতিবছর ৯ই সেপ্টেম্বর তারিখটিকে কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। ১৯৭০ সালের পয়লা জানুয়ারি নরেশবাবু এই কলেজের একজন পূর্ণাঙ্গ অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

আনন্দ চন্দ্র কমার্স কলেজ স্থাপন করা এবং তাকে একটি পুর্নাঙ্গ পরিচিতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নরেশ বাবুর অবদান তুলনাহীন। আনন্দ চন্দ্র কমার্স কলেজ তার এই নিরলস প্রচেষ্টাকে আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তার সময়টিকে আনন্দ চন্দ্র কমার্স কলেজের এক স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। পরবর্তীতেও এই কলেজে সাফল্যের সঙ্গে অধ্যক্ষের ভূমিকা পালন করেছেন শিশির কুমার মজুমদার। এই কলেজ থেকে বহু কৃতি ছাত্র দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। আইএএস পুরুষোত্তম আগরওয়াল এই কলেজের প্রাক্তনী। কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ডক্টর সিদ্ধার্থ সরকার। বর্তমানে এই কলেজে কলা বিভাগেও পাঠদান শুরু হয়েছে। ২০১১ সালে এই মহাবিদ্যালয় তার সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ পালন করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *