নিবন্ধ : বাংলা নববর্ষের সেকাল – একালের চিত্রপট

পিনাকী রঞ্জন পাল : বাংলা নববর্ষ, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ, বাঙালির সংস্কৃতির এক অঙ্গনে সবচেয়ে প্রাণবন্ত, প্রাণোচ্ছ্বল এবং আবেগময় একটি দিন। কালের পরিক্রমায় নববর্ষ পালনের রীতিনীতি, আবেগ ও অনুষঙ্গ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। আজকের এই একালে নববর্ষ আগের মতো শুধু ‘আচার’ নয়, তা হয়ে উঠেছে এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মানসিক পুনর্জন্মের প্রতীক।

নববর্ষের ভোর : স্মৃতি আর বাস্তবতার মিলন
আগে নববর্ষের সকাল মানেই ছিল মাটির ঘরে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে জেগে ওঠা, উঠোনে জল ছিটিয়ে পরিষ্কার করা, তুলসী গাছে জল দেওয়া, চিরুনি করে চুল বাঁধা, সাদা শাড়ি বা ধুতি পরে বাড়ির বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেওয়া। এখন সে চিত্রটা শহুরে জীবনে অনেকটাই রূপান্তরিত হয়েছে।

এই একালে নববর্ষের সকাল শুরু হয় মোবাইল ফোনের শুভেচ্ছাবার্তায়। সামাজিক মাধ্যমে ভেসে আসে রঙিন পোস্ট, ডিজিটাল কার্ড, মিম, শুভেচ্ছা ভিডিও। পরিবারে একত্রে প্রণাম ও আশীর্বাদের বদলে এখন দেখা যায় ভার্চুয়াল কল, হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও বা ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ভালবাসা আদান-প্রদান।

তবুও এক ধরনের চেষ্টার ছাপ দেখা যায়—এই আধুনিকতা আর প্রযুক্তির ভিড়ে হারিয়ে গেলেও বাঙালির হৃদয়ে এখনও নববর্ষের সকালে একটা আলাদা অনুভূতির জায়গা আছে।

বাজার ও ব্যবসার ভোর : গ্রাম হোক বা শহর—নববর্ষ মানেই নতুন খাতা, হালখাতা। ব্যবসায়ীরা লাল রঙের মোটা মলাটে নতুন খাতা সাজিয়ে রাখেন দোকানে। আগে ঘরে ঘরে মিষ্টি পাঠানো হতো, খদ্দেরদের হাতে উপহার তুলে দেওয়া হতো—“নতুন বছরে ভালো থাকুন” বলে।

এখনও অনেক জায়গায় এই রীতি রক্ষা করা হয়, কিন্তু প্রযুক্তি আর বাণিজ্যিক দৌড়ে সেটাও অনেকটাই ফর্মালিটিতে পরিণত হয়েছে। বড় বড় শপিং মল বা ব্র্যান্ডেড দোকানে নববর্ষ উপলক্ষে ছাড়, অফার, ডিজিটাল হালখাতা—এই সব নিয়েই এখন নববর্ষের সকালের ব্যস্ততা।

বাঙালিয়ানা খাবারের সকাল : একসময় নববর্ষ মানেই ছিল পান্তাভাত, ইলিশ মাছ, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ আর মাটির হাঁড়িতে জল। ঘরে ঘরে রান্না হতো লুচি-সুজি, পায়েস, মাংস। এখনও এই রীতিতে একটা টান রয়েছে। তবে শহরের হাল এখন অনেকটাই রেস্টুরেন্ট নির্ভর। ‘নববর্ষ স্পেশাল মেনু’ নাম দিয়ে হোটেল, রেস্টুরেন্ট কিংবা ফুড ডেলিভারি অ্যাপে চলে উৎসবের স্বাদ। সেই প্রাচীন স্বাদ, গন্ধ ও পারিবারিক উষ্ণতা আজ অনেক ক্ষেত্রেই সরে এসেছে আধুনিক আয়োজনে।

সকালবেলার সাংস্কৃতিক দিক : নববর্ষের সকালে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় পাঠ্যপুস্তক থেকে বেরিয়ে তরুণরা গাইতে দেখা যায় —”এসো হে বৈশাখ”। এখন অনেক জায়গায় হাউজিং কমপ্লেক্সেও হয় ছোট আয়োজন—নববর্ষের প্রভাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা পাঠ, বাচ্চাদের আলপনা আঁকা প্রতিযোগিতা।

তবে টেলিভিশনের প্রভাব এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এই ঘরোয়া আয়োজনকে অনেক সময়েই ছাপিয়ে যায়। সকালের অনুষ্ঠান দেখা হয় মোবাইল স্ক্রিনে, ল্যাপটপে, কখনও কখনও রেকর্ড করা ইউটিউব লিংকে।

নববর্ষের সকাল একালের মানুষে : এই একালের নববর্ষের সকাল অনেকটাই শহুরে, দৌড়ঝাঁপের মধ্যে বন্দী। গ্রামে এখনও কিছুটা সরলতা রয়ে গেছে, কিন্তু শহরে দিনটা অনেক সময়েই শুধুই “আরও একটা দিবস” হয়ে দাঁড়ায়। ছুটির দিনের মতো করে ঘুম, শপিং বা ফ্রেন্ডস গ্যাদারিং—নতুন বছরের প্রথম দিনে এই ধারা দেখা যায়। কিন্তু এর মধ্যেও এক ধরনের ভালো লাগা, নিজের শিকড়ের খোঁজ, নস্টালজিয়া কাজ করে।

একালের নববর্ষ মানে কেবল অতীতের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং অতীত আর আধুনিকতার মিলনের এক নব অনুরণন।

বাংলা নববর্ষ এখন কেবল ঐতিহ্যের নয়, তা হয়ে উঠেছে নতুন ভাবে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করার একটি উপলক্ষ। যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তির মাঝে, এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা বাঙালি, আমাদের রয়েছে নিজস্ব শিকড়, সংস্কৃতি, এবং এক রঙিন আবেগময় পরিচয়। এই একালের প্রেক্ষাপটে নববর্ষ হয়তো বদলে গেছে, কিন্তু তার অন্তরালের আবেগ ও মানুষকে ছুঁয়ে যাবার ক্ষমতা আজও অটুট।

জলপাইগুড়ি নিউজ পরিবারের তরফে সকলকে জানাই শুভ নববর্ষ! শুভ হোক প্রতিটি সকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *