পিনাকী রঞ্জন পাল : শীতল হাওয়ায় গা ছমছম করছে। ধোঁয়াটে আকাশের নিচে বিশাল জঙ্গলটি যেন এক রহস্যময়ী রাজ্য। নিশার আলোতে ঝিলমিল করছে পাতাগুলো, আর জঙ্গলের গভীরে কোথাও দূরে হুহু আওয়াজ। রাতের এই সময়টাতে প্রকৃতির এক অন্য রূপ প্রকাশ পায়। এই জঙ্গলের পাশেই ছোট একটি গ্রাম, নাম তার শ্যামপুর।
শ্যামপুর গ্রামের একধারে রয়েছে ছোট্ট একটা বাড়ি। বাড়িটির সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবক, নাম তার অরূপ। অরূপ গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করে। চেহারায় শান্ত স্বভাবের, কিন্তু মনটা যেন সর্বদা কোনো এক দুঃস্বপ্নে ভীত।
অরূপের জীবনের একমাত্র আকর্ষণ ছিলো তার প্রেমিকা মেঘলা। মেঘলা গ্রামেরই মেয়ে, কিন্তু শহরে পড়াশোনা করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ওরা দুজন ছোটবেলা থেকেই একে অপরের সাথে বড় হয়েছে। সেই মিষ্টি মেয়েটির স্মৃতি এখনো অরূপের মনকে আকুল করে তোলে। মাঝে মাঝে গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে অরূপ ভাবে, মেঘলা যদি ফিরে আসে! মেঘলার সাথে কাটানো সেই দিনগুলো যেন বারবার তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
একদিন সন্ধ্যায়, অরূপ যখন বাড়ির সামনে বসে আকাশের তারা গুনছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে একটি চিঠি এসে পৌঁছায়। চিঠিটি খুলতেই অরূপের চোখ বড় হয়ে যায়। চিঠিটি মেঘলার! বহুদিন পর তার চিঠি! মেঘলা লিখেছে, সে শিগগিরই গ্রামে আসছে। এতদিন পর মেঘলা আবার ফিরছে—এই খবরটি অরূপের হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়।
পরদিন সকালে, গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে অরূপ দেখে মেঘলার আগমনের জন্য গ্রামবাসীরা কতটা উচ্ছ্বসিত। মেঘলা ছিল গ্রামের সবার প্রিয়। মেয়েটি গ্রামের উন্নয়নে প্রচুর কাজ করেছিল। শহরে পড়াশোনা শেষে সে বিদেশে চলে যায়, সেখানেও সে সুনামের সাথে কাজ করে। কিন্তু মেঘলা নিজের গ্রামকে ভুলতে পারেনি, তাই সে ফিরে আসছে।
যথাসময়ে মেঘলা গ্রামে আসে। গ্রামবাসী তাকে স্বাগত জানায়। মেঘলা আবার সেই আগের মতোই প্রাণবন্ত। অরূপের সাথে দেখা হতেই মেঘলার চোখে জল এসে যায়। অরূপও তাকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়। এতদিনের দূরত্ব, এতদিনের অপেক্ষা—সব কষ্ট যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়।
মেঘলা অরূপের কাছে এসে বলে, “তুমি জানো, অরূপ, আমি শহরে পড়াশোনা করতে গিয়ে বুঝেছি, আমার হৃদয়টা এই গ্রামেই পড়ে আছে। আমি বিদেশে গিয়েও বুঝেছি, প্রকৃত সুখ এখানে, তোমার কাছে।”
অরূপ অবাক হয়ে বলে, “তুমি কি তাহলে এবার এখানেই থাকবে?”
মেঘলা হেসে বলে, “হ্যাঁ, আমি তোমার সাথেই থাকব। আমরা মিলে এই গ্রামকে আরো সুন্দর করে তুলব। তুমি আমার সাথে থাকবে তো, অরূপ?”
অরূপ মৃদু হেসে বলে, “আমি তো বরাবরই তোমার সাথে আছি, মেঘলা।”
গ্রামের পথে হাতে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে অরূপ ও মেঘলা ভাবতে থাকে ভবিষ্যতের কথা। গ্রামকে সুন্দর করার পরিকল্পনা করতে করতে ওরা যেন এক নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
একদিন সন্ধ্যায়, যখন চাঁদ আকাশে উঁকি দেয়, অরূপ ও মেঘলা গ্রামের পুকুরের পাশে বসে। পুকুরের জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব ঝলমল করছে। মেঘলা অরূপের কাঁধে মাথা রেখে বলে, “তুমি জানো, অরূপ, আমি সবসময় তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের জীবন—সবকিছু যেন তোমার সাথেই যুক্ত।”
অরূপ মৃদু হাসে, “তুমি জানো, মেঘলা, আমি যখন তোমাকে হারিয়েছিলাম, তখনই বুঝেছিলাম, তুমি আমার জীবনের অমূল্য রত্ন। আমি সবসময় তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।”
মেঘলা অরূপের হাত ধরে বলে, “আমরা এবার একসাথে থাকব, অরূপ। আমরা মিলে নতুন জীবনের সূচনা করব।”
এরপর দিনগুলি কাটতে থাকে সুখময় ভাবে। অরূপ ও মেঘলা একসাথে গ্রামের উন্নয়নে কাজ করতে থাকে। গ্রামবাসীদের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে গিয়ে ওরা বুঝতে পারে, প্রকৃত সুখ মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকার মধ্যে, তাদের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে।
এভাবে কেটে যায় অনেকগুলো বছর। একদিন, অরূপ ও মেঘলা গ্রামের মন্দিরের সামনে বসে। সূর্যাস্তের আলোতে সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মেঘলা হেসে বলে, “অরূপ, আমাদের জীবনটা যেন এক সুন্দর গল্প। আমরা একসাথে আছি, একসাথে কাজ করছি, একসাথে স্বপ্ন দেখছি।”
অরূপ মৃদু হেসে বলে, “হ্যাঁ, মেঘলা, আমাদের জীবনটা সত্যিই এক সুন্দর গল্প। আমরা একসাথে আছি, একসাথে থাকব, এটাই আমাদের জীবনের সার্থকতা।”
মেঘলা অরূপের কাঁধে মাথা রেখে বলে, “তুমি জানো, অরূপ, তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তুমি না থাকলে আমি কখনোই সুখী হতে পারতাম না।”
অরূপ মৃদু হেসে বলে, “তুমি জানো, মেঘলা, তুমিও আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ।”
এইভাবে, অরূপ ও মেঘলার জীবন ভালোবাসা ও সুখে পূর্ণ হয়ে ওঠে। ওরা একসাথে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করতে থাকে। জীবনকে সুন্দর ও সুখী করে তোলার জন্য ওদের ভালোবাসা ও পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা ছিল এক অনন্য উদাহরণ।
গ্রামের মানুষদের কাছে অরূপ ও মেঘলার ভালোবাসা ছিল এক মহান অনুপ্রেরণা। ওদের দেখে গ্রামের সবাই ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ ও মূল্য বুঝতে পারে। ওদের ভালোবাসা ছিল নির্ভেজাল ও প্রকৃত, যা কেবল একে অপরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল।
এভাবে, অরূপ ও মেঘলার জীবন চলতে থাকে এক সুন্দর গল্পের মতো, যা ভালোবাসা, সুখ ও সম্প্রীতির এক অমূল্য উদাহরণ হয়ে থাকে। ওদের ভালোবাসার গল্প গ্রামে রয়ে যায় এক চিরন্তন স্মৃতি হিসেবে, যা ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে এক প্রেরণার উৎস হয়ে থাকে।