লেখক : পঙ্কজ সেন
১৯০২ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি শহরের বিশিষ্ট নাগরিক তথা জলপাইগুড়ি পুরসভার অন্যতম সদস্য (১৮৯৫-১৯০৫ সাল) শশীকুমার নিয়োগীর আহবানে তার বসত বাড়িতে শহরের গন্যমান্য ব্যাক্তিদের উপস্থিতিতে একটি সভা আহূত হয়েছিল। এই সভাই ছিল শহরে আর্যনাট্য সমাজের জন্মের উৎস (১৯০৫)। সেই সময়ে জলপাইগুড়িতে স্বদেশী চিন্তাভাবনার প্রচারে ও প্রসারে এটিই ছিল সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠান। সেই স্বদেশীকতার জোয়ারে শশীবাবুর অনুরোধে শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তি তথা দানবীর মুন্সী মহম্মদ সোনাউল্লা উক্ত সমাজগৃহটি নির্মাণের জন্য যাবতীয় টিন, কাঠ, দরজা, জানলা দান করেছিলেন। এছাড়াও আর্যনাট্য সমাজ প্রতিষ্ঠায় অন্যান্য যাদের অবদান উল্লেখযোগ্য তারা হলেন, জগদিন্দ্রদেব রায়কত, জয়চন্দ্র সান্যাল, মাধব সান্যাল, ঈশান দাশগুপ্ত, তারিণী প্রসাদ রায়, তারাপ্রসাদ বিশ্বাস, সুরেশ্বর সান্যাল, ত্রৈলোক্যনাথ মৌলিক,অন্নদাচরণ সেন প্রমুখ।

১৯০৫ সালে আর্যনাট্য সমাজে “জাতীয় বিদ্যালয়” গড়ে তুলেছিলেন রাধাকুমুদ মুখার্জি ও বিনয় সরকারের মতো কিছু স্বদেশী যুবক। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন বঙ্কুবিহারী পাল, জ্যোতিষ সান্যাল, পঞ্চানন চক্রবর্তী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সিংহ, চুনীলাল প্রামানিক ও মাখনলাল ভৌমিক। আর্যনাট্য সমাজে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হবার পাশাপাশি শহরের নব্য যুবকদের চরিত্র গঠনের দিকেও নজর রেখে সামাজিক সভা-সমিতি খোলার ব্যবস্থাও ছিল। কোন বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে তার সেবার জন্য, অথবা বিবাহ- উৎসবে লোকবলের অভাবে এই যুবকদল এগিয়ে আসতেন পারিবারিকতার গরজে। শহরে অবসর বিনোদনের জন্য ১৯১৫-১৬র দিকে প্রতি শনি ও রবিবার এখানে নাটক পরিবেশিত হত। এছাড়াও শীতকালে শহরে যাত্রা গানের আসর বসতো শহরের বর্ধন প্রাঙ্গন, আর্যনাট্য সমাজ, কদমতলা পাঠগোলা প্রভৃতি স্থানে। রাজপরিবারের সদস্য জগদিন্দ্রদেব রায়কত শশীবাবুর সহকর্মী হিসেবে উক্ত সংস্থাটি প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য সহায়তা করেছিলেন। তিনি তার নিজের সংগৃহীত সুবৃহৎ লাইব্রেরিটি আর্যনাট্য সমাজে সর্বসাধারণের জন্য দান করেন। ১৯২৬ সালে সরোজিনী নাইডু ও ১৯২৮ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র এখানে পদধূলি দেন এবং তাদের অমূল্য বক্তৃতা প্রদান করেন। শশীবাবুর মৃত্যুর পর তার প্রিয় সহকারি তারাপ্রসাদ বিশ্বাস (মৃত্যু ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাস) দীর্ঘকাল এই সংস্থাটির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জলপাইগুড়িতে শিল্প- সংস্কৃতি প্রসারের আন্দোলনে আর্যনাট্য সমাজের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯১৪-১৫ সালের দিকে জলপাইগুড়ি শহরের বাঙালি ছেলেরা আর্যনাট্য সমাজের হার্ডকোর্টে লন টেনিস খেলতেন। শহুরে বাঙ্গালীদের টেনিস খেলা পঞ্চাশের দশকের পরে আর চলেনি। ফুটবল খেলাটাই প্রায় ষাটের দশক পর্যন্ত খুব জোরদার চলেছিল। পূর্বে আর্যনাট্য সমাজের সামনে বাঁধানো জায়গায় (যেখানে লন টেনিস খেলা হত) সেখানে দেশের স্বাধীনতার স্বার্থে রাজনৈতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। শিশির বোস পরবর্তীতে হরপ্রসাদ মিত্র (পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রর পিতা) এখানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আর্যনাট্য সমাজের প্রেক্ষাগৃহেই গড়ে ওঠে শহরের সর্বপ্রথম সিনেমা হল “নিউ চিত্রালি”। আর্যনাট্য সমাজ ছিল প্রথম দিকে কিছুটা রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান। মহম্মদ সোনাউল্লার উদ্যোগে সেখানে স্টার থিয়েটারের অভিনয় আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয় এবং “নটী বিনোদিনী”র অভিনয়ের উদ্যোগ গৃহীত হয়। তখনো আর্যনাট্য সমাজে কোনও মহিলা অভিনয় করতে পারতেন না। পুরুষেরাই মহিলাদের চরিত্রে অভিনয় করতেন। এই সংগঠনের প্রাক্তন সম্পাদক পবিত্র দে নিজেও বহু নারী চরিত্রে দীর্ঘদিন ধরে অভিনয় করেছিলেন। ষ্টার থিয়েটারে ১৯২৮ সালে বেশ কয়েকজন মহিলা অভিনয় করতেন। তাই সে অভিনয়ের অনুমতি দেয়নি আর্যনাট্য সমাজ কর্তৃপক্ষ। ফলে স্টার থিয়েটারের অভিনয় নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। এই বিতর্কের অবসান ঘটান স্বয়ং সোনাউল্লা সাহেব। তিনি উদ্যোগী হয়ে তার বাড়ির সন্নিকটে উন্মুক্ত স্থানে স্টার থিয়েটারের নাট্যাভিনয়ের ব্যবস্থা করে দেন। সোনাউল্লা সাহেব তার নিজের পাটের গুদাম ঘরটি দিয়ে আর্যনাট্ট সমাজ গৃহটিই শুধু নির্মাণ করেই দেননি, শশীবাবুর অনুরোধে সেই গুদাম ঘরের বারান্দা দিয়ে শহরের চার নম্বর ঘুমটির কাছে বড় মসজিদের সীমানার মধ্যে তৈরি করে দেন একটি পাঠশালা। তিনি তার মায়ের স্মৃতিতে তার নামকরণ করেন “করিমুন্নেছা বিদ্যালয়”। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আর্যনাট্য সমাজে সবচেয়ে বড় সংগীতের আসর বসতো, যার নাম ছিল “নিখিল বঙ্গ কলা প্রতিযোগিতা”। স্বর্গীয় নিশি কমল রায় আমৃত্যু আর্যনাট্য সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। নিখিল বঙ্গ কলা প্রতিযোগিতার শেষ দিনে ভারতের সকল নামকরা ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত শিল্পীরা এই অনুষ্ঠানে আসতেন। যেমন আল্লারাখা, কেয়ামত উল্লাহ, শান্তা প্রসাদ, মহাপুরুষ মিশ্র, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশির কণাধর চৌধুরী, পাহাড়ি সান্যালের দাদা দ্বিজেন সান্যাল, হীরাবাঈ বরোদেকর, এ.টি কানন সহ আরো অনেক সব বিখ্যাত শিল্পীরা। সারা রাত জুড়ে সংগীত প্রতিযোগিতা হতো। ওই মঞ্চে যে কত শিল্পীর পদধূলি পড়েছে সেটা পুরনো জলপাইগুড়ির বাসিন্দারা জানেন। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে জেলায় জেলায় রবীন্দ্রভবন নির্মাণের উদ্যোগে এই ঐতিহ্যশালী ভবন আর্যনাট্য সমাজ ‘রবীন্দ্র ভবন’ হয়ে যায়। একবার দ্বিজেন সান্যালের মেয়েরা এবং আরো অনেকে মিলে “চিরকুমার সভা” নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। হাফ টাইমে দুটি বড় বড় ঘি-এর লাড্ডু দেওয়া হত সকল দর্শককে। একবার শহরের সম্ভ্রান্ত ঘরের সতী বসু “সীতা” নাটকে সীতার অভিনয় করলেন। পাতালে প্রবেশের সময় সমাজের মঞ্চ দুফাঁক হয়ে গেল। সকলের চোখের সামনে সীতা পাতাল প্রবেশ করলেন। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। আর্যনাট্য সমাজের মাঠেও যাত্রাপালা হত। “প্রতিঘাতিনী সতী”তে সেই সময় যাত্রা জগতের নামী শিল্পীরা অভিনয় করেছিলেন। তখন ছেলেরাই মেয়ে সাজতো। তাদের সাজানো এত সুন্দর ছিল যে দেখে বোঝার উপায় ছিল না। ১৯৬১ সালে ছট পূজার দিন শেষ বিকেলে দোলনা পুলের বাঁধন ছিড়ে পড়ার ঘটনায় অনেক মানুষ হতাহত হলে শোকে জলপাইগুড়ি শহর মূহ্যমান হয়ে পড়ে। সেইদিন সন্ধ্যায় আর্যনাট্য সমাজ হলে লোকরঞ্জন শাখার অনুষ্ঠানে পঙ্কজ মল্লিক ও তার দলের সহ শিল্পীদের নিয়ে সংগীত পরিবেশনের অনুষ্ঠান বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। আর্যনাট্য সমাজের মাঠটিকে হেরিটেজ ঘোষণার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। কারণ এই মাঠে স্বাধীনতার আগে যাবতীয় রাজনৈতিক সভা-সমিতি অনুষ্ঠিত হতো। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ১৯২১ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এই মাঠে সভা করেন। ১৯২৯ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এই মাঠে জনসভা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জলপাইগুড়িতে এই মাঠেই প্রথম জাতীয় পতাকা তোলা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে জলপাইগুড়ি জেলার ১২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান এই মঞ্চেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তৎকালীন পৌরপতি প্রয়াত শ্রীহরি সরকার এই অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। জলপাইগুড়ি জেলা বইমেলা বেশ কয়েক বছর এই মাঠেই অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : উমেশ শর্মা