এশিয়ার প্রথম ফার্মাসি স্কুল “জ্যাকসন মেডিকেল স্কুল” ও জলপাইগুড়ি

লেখক পঙ্কজ সেন

ভারতে ফার্মাসি শিক্ষার এক প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান হল “জ্যাকসন মেডিকেল স্কুল”। জলপাইগুড়ি শহরেরর বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ডক্টর আনন্দ গোপাল ঘোষের দেওয়া তথ্য অনুসারে ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ শাসকরা জলপাইগুড়িতে এই স্কুলটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮ সালে এই স্কুলটি জলপাইগুড়ি ফার্মেসি কলেজ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৩০ সালে তৈরি হয় স্কুল ভবন। তবে কারো কারো মতে, ১৯৩২ সাল থেকে শুরু হয়েছিল স্কুলের পঠন পাঠন। জ্যাকসন মেডিকেল স্কুল উদ্বোধনের দিন বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন যে ৬ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল শহরের বিশিষ্ট সাংবাদিক সুরেশ চন্দ্র পাল এবং তৎকালীন জেলা বোর্ডের সহ-সভাপতি তথা রায়বাহাদুর জয়গোবিন্দ গুহ। জলপাইগুড়ি বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির সর্বশেষ রাজা প্রসন্নদেব রায়কত এবং বিশিষ্ট সমাজসেবী ও জাতীয়তাবাদী শিল্পপতি যোগেশ চন্দ্র ঘোষ এই স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় প্রচুর আর্থিক সহায়তা করেছিলেন।

পেশায় উকিল তথা জেলা বোর্ডের সহ-সভাপতি তথা রায়বাহাদুর জয়গোবিন্দ গুহর অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব হলো জলপাইগুড়িতে ১৯৩০ সালে মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠা। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাকে রাজশাহী ডিভিশনের জেলা বোর্ডগুলি ঘুরতে হয়েছিল এবং দেশীয় রাজ্য কোচবিহারেও যেতে হয়েছিল। তিনি ঘুরে ঘুরে সমস্ত জেলার সমর্থন আদায় করেছিলেন। তাই জ্যাকসন মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তাদের মধ্যে জয়গোবিন্দ বাবুর নাম জলপাইগুড়িবাসীর মনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বর্তমান বি ফার্ম ছাত্রাবাস

শুরুতে এই মেডিকেল স্কুলে এল.এম.এফ কোর্স করানো হতো, পরবর্তী সময়ে সেখানে ফার্মেসিতে স্নাতক স্তরের পড়াশুনা শুরু হয়। তথ্য বলছে, “জ্যাকসন মেডিকেল স্কুল” ভারতের তথা এশিয়ার প্রথম ফার্মাসি স্কুল। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসনের নামেই স্কুলটির এই নামকরণ হয়েছিল বলে জানা যায়।তবে বর্তমানে জ্যাকসন মেডিকেল (১৯৩০-১৯৪৮) স্কুলের কোন পৃথক অস্তিত্ব নেই। ১৯৪৮ সালে স্কুলটি পরিণত হয়েছে ফার্মাসি কলেজে। ষাটের দশকে এক বছর উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের ক্লাস জলপাইগুড়ি ফার্মেসি কলেজে হয়েছিল। তবে ব্রিটিশ আমলে তৈরি স্কুল বিল্ডিং, ছাত্রাবাস, আবাসন এবং ক্লাসরুম এখনো আগের মতই আছে এবং কলেজের অংশ হিসেবেই সেগুলি এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ইংরেজ আমলের ডিপ্লোমা ছাত্রাবাস ২০১৮ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এই কলেজে বি.ফার্ম কোর্স চালু হয় ২০০৩ সালে। কলেজের সামনে নবনির্মিত দ্বিতল ভবনটি এই বি ফার্ম কোর্সের জন্য ২০০৩ সালে চালু করা হয়েছিল। বি.ফার্ম কোর্সের ছাত্রদের ছাত্রাবাস অবস্থিত শহরের ক্লাব রোড এলাকায় (পুলিশ লাইন) পি.ডাবলু.ডি মেসের পার্শ্ববর্তী এলাকায়।

জলপাইগুড়ির অনেক নামধারী ডাক্তার জ্যাকসন মেডিকেল স্কুল থেকে পাশ করেছেন, যারা পরবর্তীতে ডাক্তার হিসেবে জলপাইগুড়িতে ভালো অনুশীলন করেছিলেন। ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যালের অগ্রজ ডক্টর মোহিত সান্যাল মূলতঃ একজন চিকিৎসক ছিলেন। স্থানীয় ফনীন্দ্রদেব বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করে তিনি জলপাইগুড়িস্থ জ্যাকসন মেডিকেল স্কুলে চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়ন করেন। সেখান থেকেই তিনি এল.এম.এফ ডিগ্রি নিয়ে জলপাইগুড়িতে চিকিৎসার মাধ্যমে সেবা কার্য শুরু করেন।

ফার্মাসি কলেজের গেট

স্বাধীনতার আগে জলপাইগুড়ির এই মেডিকেল স্কুলকে কেন্দ্র করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি প্রাণবন্ত চর্চাও ছিলো। মেডিকেল স্কুলের পড়ুয়া ছাত্র এবং পাশ করে বেরুনো ছাত্র জেলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে একটি বড় জায়গা জুড়ে থাকতো। মেডিকেল স্কুলের পক্ষ থেকে প্রতিবছর একটি মেলা হত; মৃত রোগীদের শব ব্যবচ্ছেদের পর ওষুধ জারিত করে রাখা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রদর্শনী রীতিমতো সারা জাগানো ছিলো। সর্বস্তরের মানুষ ভিড় করত ওই মেলায়। ১৯৪৮ সালে স্কুল উঠে যাওয়ার পরেও, পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকেও এই মেলা অনুষ্ঠান চালু ছিলো।

Asia's first pharmacy school "Jackson Medical School" and Jalpaiguri
নতুন বি ফার্ম ভবন

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : উমেশ শর্মা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *