সচেতনতামূলক গল্প : প্রলয়ের প্রলোভন

লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল

প্রথম পর্ব: সংগ্রামের দিনগুলো

জলপাইগুড়ি শহরের পান্ডা পাড়ার বাসিন্দা নরেন রায়। গরিব হলেও তার মধ্যে কখনও হাল ছেড়ে দেওয়ার মনোভাব দেখা যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে সে হকারের কাজ করলেও শারীরিক পরিশ্রমের কারণে দিনদিন সেই কাজ তার জন্য কঠিন হয়ে উঠছিল। এরপরই জীবিকার সন্ধানে নতুন পথে নামার সিদ্ধান্ত নেন নরেন। পরিবার চালানোর দায়িত্ব তো আর থেমে থাকে না। অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষমেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটি ই-রিক্সা কেনেন।

ই-রিক্সাটি নরেনের জীবনে যেমন আশা এনে দিয়েছিল, তেমনি তার পরিবারের জন্যও ছিল এটি এক আশীর্বাদ।

নরেন বলে, “মীনা, দেখো, ই-রিক্সাটা আমাদের জন্য অনেক আশা নিয়ে এসেছে। আজ না পারলেও, কাল ঠিক সফল হব।”

মীনা মৃদু হেসে বলে, “তুমি ভালো করলেই আমাদের দিন বদলাবে। কিন্তু সাবধানে চালাবে।”

নরেন তাকে আশ্বস্ত করে, “চিন্তা করো না, মীনা। আমি সবসময়ই সাবধানেই চালাবো।”

প্রতিদিন সেই ই-রিক্সায় যাত্রী নিয়ে জলপাইগুড়ি শহরের গলিগুলো চষে বেড়ায় নরেন। স্ত্রী মীনা এবং দুই মেয়েকে নিয়েই তার ছোট সংসার। মীনা তার সুখ-দুঃখের সাথী, তাদের মধ্যে নীরব বোঝাপড়া আছে।

নরেন যখন সকালে কাজ শুরু করে, মীনা প্রতিবারই তাকে বিদায় জানায়। তার ই-রিক্সার চাকা ঘুরলে পরিবারে আশার আলো জ্বলে ওঠে, কিন্তু সেই আশায় একটা ভয়ও থাকে—কোনোদিন যদি কিছু হয়?

দ্বিতীয় পর্ব: এক রহস্যময় যাত্রী

একদিন শীতের রাত, ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। নরেন স্টেশন রোড ধরে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ একটি ছায়ামূর্তি তার ই-রিকশার দিকে এগিয়ে আসে। যাত্রীর চোখে-মুখে এক অদ্ভুত রহস্যময়তা এবং তার বেশভূষাতেও এক ধরণের অনিশ্চয়তা। যাত্রী তাকে দাঁড়ানোর ইশারা করে, নরেন ই-রিকশা থামাতেই ওই যাত্রী চুপচাপ রিক্সায় ওঠে এবং বলে, “৭৩ মোড় নিয়ে যাবেন?”

নরেন হেসে বলে, “না আমি বাড়ি ফিরছিলাম!”

যাত্রী কাকুতি করে, “প্লিজ, কত সময় আর লাগবে। আমাকে একটু পৌঁছে দিন না। এদিকে তো কিছুই পাচ্ছি না। আমি ডবল ভাড়া দেব। “

নরেন মনে মনে ভাবে, এত করে যখন বলছেন, তখন পৌঁছে দিই নাহয়। আর টাকাও বেশি পাওয়া যাবে। মীনা খুশিই হবে আজ বেশি টাকা পেলে। মুখে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে চলুন।”

যাত্রী কিছুটা চুপ থেকে বলে, “আপনাকে ধন্যবাদ।”

যাত্রা শুরু হয় স্টেশন রোড থেকে, তারপর একে একে তারা পেরিয়ে যায় কদমতলা, চার নম্বর ঘুমটি। পুরো পথে নরেন অস্বস্তিতে থাকলেও কিছু বলে না। শীতের রাত হওয়ায় অনেক দোকান ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, কিছু কিছু দোকানদার তাদের দোকান বন্ধ করতে ব্যস্ত। রাস্তা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। যদিও শীতের রাতে জলপাইগুড়ি একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ে।

দাদাভাই ক্লাবের মোড় পাড় করে কিছুটা যাওয়ার পর একটা ছোট চায়ের দোকান খোলা দেখতে পাওয়া যায়। দোকানটি পার হওয়ার সময় যাত্রী নরেনকে ই-রিক্সাটি থামাতে বলে, “একটু থামান তো, চা খেয়ে আসি। আপনার জন্যও নিয়ে আসছি।”

নরেন ভাবে শীতের রাতে এক কাপ উষ্ণ চা হলে মন্দ কি, সে একটু হেসে সম্মতি জানায়। বলে, “আমি কি গাড়িটা পিছিয়ে দোকানের সামনে নিয়ে যাব।”

যাত্রী বলে,”না না, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।”

নরেন গাড়িতে অপেক্ষা করে। শহরের এদিকটা বেশ ফাঁকা, আর এই শীতের রাতে আরো যেন বেশি ফাঁকা মনে হচ্ছে। ফাঁকা থাকায় হিমেল হাওয়া বেশ লাগছে গায়ে। যাত্রী ই-রিকশা থেকে নেমে সেই চায়ের দোকান থেকে দুই কাপ ধোঁয়া উঠা চা নিয়ে এসে একটা কাপ নরেনকে দেয়। দুজনে গাড়িতে বসে চা পান করে। নরেন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এক চুমুক দেয় এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে।

তৃতীয় পর্ব: অজ্ঞান এবং সর্বস্ব হারানো

চায়ের কাপে চুমুক দিতেই নরেনের মাথা ঘুরতে শুরু করে। সে অনুভব করে শরীরে অবসন্নতা ভর করছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তার সমস্ত শক্তি কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে আসে। মাথা ভারী হয়ে আসে, চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে যায়। সে অনুভব করে, কোনোভাবে চেতনা ধরে রাখতে পারছে না, আর মুহূর্তের মধ্যেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

শীতের সকাল, ঠান্ডা বাতাস নরেনের চেতনা ফিরিয়ে আনে। জ্ঞান ফিরলে, তখন সে নিজেকে রাস্তার পাশে শুয়ে থাকতে দেখে। কিন্তু পাশে তার ই-রিক্সাটিকে দেখতে পায় না, নরেন গতরাতের কথা মনে করে শিউরে ওঠে, সে বিষয়টা আন্দাজ করে পকেটে হাত ঢোকায়। পকেটের টাকা-পয়সা, মোবাইল সব গায়েব। হতাশ এবং ভীত নরেন কোনোমতে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে।

স্বামী রাতে বাড়ি না ফেরায় মীনা অনেক খোঁজাখুঁজি করে রাত জেগে রাস্তার দিকে চেয়ে বসেছিল। ভোরে স্বামীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় স্বামীকে একা ফিরতে দেখে চমকে ওঠে মীনা। “কী হয়েছে? এ কী অবস্থা তোমার? সারা রাত কোথায় ছিলে? আমরা কত খোঁজাখুঁজি করেছি। ফোন করেছি!” মীনা কান্নাকাটি করতে থাকে।

নরেন হালকা গলায় বলে, “সব শেষ মীনা, ই-রিক্সাটাও চুরি হয়ে গেছে। সব নিয়ে গেল।” নরেন গতরাতের ঘটনা খুলে বলে মীনাকে।

মীনা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কান্নাকাটিতে পাড়ার লোকেরা ছুটে আসে। পাড়া- প্রতিবেশীরা এসে সব শুনে তাদের সান্ত্বনা দেয় এবং থানায় অভিযোগ করতে বলে। তাদের একজন বলে, “থানায় গিয়ে সব খুলে বলো, নরেন। হয়তো পুলিশ কিছু করতে পারবে।”

সকলের পরামর্শে নরেন থানায় গিয়ে অভিযোগ জানায়।

চতুর্থ পর্ব: পুলিশের তদন্ত

নরেন থানায় গিয়ে সব বলে। ডিউটি অফিসার কৌতূহল নিয়ে সমস্তটা শোনেন। “দাদাভাই ক্লাবের মোড় পাড় করে বললেন চা খেয়েছিলেন? চায়ের দোকানদারকে চেনেন?”

নরেন মাথা নাড়ে, “নাহ, ওকে চিনি না।”

অফিসার সুভাষ দত্ত তাকে আশ্বস্ত করেন, “চিন্তা করবেন না, আমরা তদন্ত শুরু করছি। চা খাওয়ার পরই অজ্ঞান হয়ে গেলেন, এমন ঘটনা আরও কয়েকজন ই-রিকশা চালকের সাথে ঘটেছে। আমরা এই মোড়ের দিকে বিশেষ নজর রাখছি।”

অফিসার সুভাষের নেতৃত্বে একটি টিম গঠন করা হয়। টিমটি ওই মোড়ে অভিযান চালায় এবং আশেপাশের এলাকার দোকানদারদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। দোকানদার শম্ভু প্রথমে কিছুই জানায় না। কিন্তু দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পরে বলে, “একটা ছেলে মাঝে মাঝে রাতের দিকে এখানে আসে। প্রলয় নাম তার। সে মাঝে মাঝেই চা নিয়ে যায় ই-রিকশা চালকদের জন্য।”

পঞ্চম পর্ব: প্রলয়ের কাহিনি

এরপর প্রলয়কে খুঁজে বের করে পুলিশ। প্রলয় এক সময় একজন ই-রিক্সা চালক ছিল। সে ভালোই উপার্জন করত, কিন্তু তার মধ্যে এক ধরণের নে’শা করার প্রবণতা দেখা দেয়। প্রথমে শুধু, জু’য়ার নে’শা, তারপর আস্তে আস্তে মা’দ’কাস’ক্তি। নে’শার প্রতি তার এতটাই আস’ক্তি ছিল যে, নিজের সংসারও ধ্বংস হয়ে যায়। পরিবারে তার প্রতি কেউ বিশ্বাস রাখতে পারেনি, আর তাই সে সমাজ থেকে আলাদা হয়ে একাকী জীবন যাপন শুরু করে।

তাকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে সে অস্বীকার করলেও, পুলিশি জেরার মুখে সে তার অপরাধ স্বীকার করে। প্রলয় বলে, “আমি চাইনি এমনটা করতে, কিন্তু আমার জীবনটাই তো এমন। নে’শায় আসক্ত, আর এই নে’শা মেটাতেই এসব করতে হয়। ই-রিক্সা চালকদের কাছে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না। তাদের কাছ থেকেই যা পারি, নিয়ে নিই।”

সুভাষ অফিসার কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, “তুমি জানো, এই অপরাধের শাস্তি কতো বড় হতে পারে? নে’শা করে নিজের জীবন নষ্ট করেছো, কিন্তু অন্যের জীবনও নষ্ট করতে চাইছো?”

প্রলয় মাথা নিচু করে, কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারে না। তার কাহিনির প্রতিটি বাক্যে কেবলই অনুশোচনার ছাপ।

ষষ্ঠ পর্ব: নরেনের দ্বন্দ্ব এবং সচেতনতার বার্তা

নরেন তার ই-রিক্সা ফিরে পায়, কিন্তু তার মনের ভেতর এক ধরনের অ’পরা’ধবোধ কাজ করতে থাকে। প্রলয়ের জীবনের দুর্বিষহ গল্প তার মনকে নাড়া দেয়। এদিকে মীনাও তাকে সাহস দেয়। সে বোঝে, নে’শার কারণে কীভাবে একজন মানুষ তার জীবন ধ্বংস করতে পারে। নরেন ভাবতে থাকে, হয়তো সেও একদিন এমন পরিস্থিতিতে পড়তে পারত।

এই ঘটনার পর নরেন পাড়ার ছেলেমেয়েদের সামনে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করে। পাড়া-মহল্লায় সে চায়ের দোকানে যায় এবং মানুষের সাথে নে’শার ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করে। সে তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলে। “দেখো, নে’শা কিছুই দেয় না, বরং সব কেড়ে নেয়। আজ প্রলয় যেভাবে আমাদের সমাজের এক ক্ষ’তিকারক হিসেবে গণ্য হচ্ছে, তার জন্য শুধুই তার ভুল সিদ্ধান্ত দায়ী।” সে ভাবে, তার অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো অন্য কেউ সচেতন হতে পারবে এবং তাদের জীবন বাঁচাতে পারবে।

শেষ কথা

নরেনের কথা শুনে পাড়ার যুবকেরা সচেতন হয় এবং তার জীবন সংগ্রাম তাদের মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

(গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক)

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *