কেঁদে ট্রেন থামাতেন ভাষাচার্য

১৯০০ থেকে ১৯৯২ প্রায় গোটা শতাব্দীর সিংহভাগ সময় জুড়ে যিনি বাংলা সাহিত্যের জগতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। বৈদিক ভাষাতত্ত্ব থেকে গোয়েন্দা কাহিনি সর্বত্র যাঁর লেখনি ছিল সমানভাবে সাবলীল। ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের যিনি ছিলেন সুযোগ্য উত্তরসূরি। সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষাতত্ত্বের দিকনির্দেশক পন্ডিত, আমাদের সাহিত্য ইতিহাসের প্রধান প্রণেতা ডঃ সুকুমার সেনের ছেলেবেলার কথা লিখেছেন পিনাকীরঞ্জন পাল।

ভাষাতাত্বিক, প্রাবন্ধিক, ঐতিহাসিক ও লোকতাত্বিক ডঃ সুকুমার সেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন আজ থেকে একশো বাইশ বছর আগে ১৯০০ সালের ১৬ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার হেদোর কাছে গোয়াবাগানে। আগে তার বাস ছিল বর্ধমানের গাছপালায়। ঘেরা শান্ত গ্রাম গোতানে।

খুব ছোটবেলা থেকেই সুকুমার সেন ছিল ভীষণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও জেদিপ্রকৃতির। একবার কাকার বিয়েতে ছোট্ট সুকুমার ‘নিতবর’ হয়ে পালকি চেপে চলেছে। সঙ্গে তার বাবাও রয়েছেন। পালকি বিয়ে বাড়িতে পৌঁছনোর পরে সবাই | বরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ ‘নিতবর’কে অভ্যর্থনাও করলো না। মনে মনে খুব রাগ হলো সুকুমারের। সে তাই পালকি থেকে নামলো না এবং ভীষণ বায়না ধরে তখনই সেই পালকি চড়েই ক্ষুদে নিতবর’ বাড়ি ফিরে এসেছিল। তার এই আত্মমর্যাদাবোধ সেদিন সকলকেই অবাক করেছিল।

আট বছর বয়সে গান শিখতে শুরু করেছিল সুকুমার। কিন্তু চার-পাঁচে মাসের বেশি আর গান শেখা হয়নি। গান না শিখলেও কান্নার দাপটে রেল ইঞ্জিন থামিয়ে দিতে পারতো সুকুমার। কি অবাক হচ্ছো নাকি ? শোন তবে সেই কাহিনি। সুকুমার তখন খুবই ছোট। একদিন শেওড়াফুলি স্টেশনে সুকুমারের বাবা তাকে নামিয়ে আশেপাশেই কোথায় যেন গিয়েছেন। বাবাকে দেখতে না পেয়ে কিছুক্ষণ পরে সুকুমার চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। এমন সময় পাশ দিয়ে যাওয়া একটা শানটিং ইঞ্জিন তার কান্না শুনে থেমে পড়লো এবং ইঞ্জিনের ড্রাইভার নেমে এসে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কান্না থামালো।

১৯১২ সালের জানুয়ারি মাসে সুকুমার সেন মিউনিসিপ্যাল স্কুলে ফিফথ ক্লাসে ভর্তি হয়। স্কুলে সনৎকুমার চৌধুরী নামে এক সহপাঠী সুকুমারের নাম রেখেছিল ‘ডেসিম্যাল থ্রি’, কারণ এই নামে ডাকলে তাকে সহজেই রাগানো যেত।

শৈশব থেকেই তার নানান ধরনের বই পড়ার নেশা ছিল। ছড়া শুনতে ও পড়তে খুব ভালোবাসত। বাবা বা দাদার কাছে শুনতো ভূতের গল্প। যোগীন্দ্রনাথের ‘ছবি ও গল্প’ বইটি সুকুমারের পড়া প্রথম বই। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ কবিতাটি তার মনে দারুণ দাগ কেটেছিল।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘রাক্ষসখোক্ষস’, ‘ভূতপেত্নী’, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আরব্য উপন্যাস’ দক্ষিণারঞ্জনের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’; উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির বই, রবীন্দ্রনাথের ‘ইংরাজি সোপান’ প্রভৃতি বই পড়তো সুকুমার। স্কুলে ভর্তির আগে থেকেই লাইব্রেরির বই এনে পড়ার নেশা ছিল তার। বই পড়ার প্রবল নেশায় হাতের কাছে কোনো বই না পেলে পাঁজির বিজ্ঞাপন পর্যন্ত পড়ে শেষ করতো। যেসব বইতে প্রচুর বিজ্ঞাপন ছাপা হতো তার কাছে সে সমস্ত বই ছিল মহা মূল্যবান। শুধু বাংলা বই নয়, থার্ড ক্লাস থেকে সুকুমার পড়া শুরু করেছিল গল্পের বই। ডিকেন্স, মিসেস হেনরি উত্ত, কর্তা এলিয়ট প্রমুখ বিখ্যাত লেখকদের বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসত সুকুমার। এ সময় তার আনা দিয়ে ছেলেদের ডিটেকটিভ বই নিয়েই কিনেছিল সে।

বই পড়া, ছড়া শোনার পাশাপাশি দম নেওয়া গাড়ি চালানো, ছোট পাথরের শিব নিয়ে শিবপুজো করা, চোরচোর, আনিমানি, ঝালকাপাতি ও গুলি (মার্কেল) খেলা ইত্যাদি ছিল সুকুমারের খেলাধুলার অঙ্গ। সে অংকে ভীষণ ভালো ছাত্র ছিল। স্কুলে থার্ড মাস্টারমশাই শেষ পিরিওড়ে আর করাতেন। তিনি ছাত্রদের কয়েকটি অংক নিতেন এবং যে আগে সেই অরে করে দিতে পারতো সে আগে ছুটি পেত। এজন্য সুকুমার প্রতিদিনই মিনিট ১৫-২০ আগে ছুটি পেয়ে বাড়ি যেতে পারতো।

সঠিক ব্যাকারণ লেখার অভ্যাস স্কুল জীবনেই গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে। ফিফথ ক্লাসে পড়ার সময় সেকেন্ড মাস্টারমশাই হেমেন্দ্রমোহন বসু সুকুমারকে উঁচু ক্লাসে, ডেকে নিয়ে গিয়ে পড়া না পারা সিনিয়র ছাত্রদের কান মলে দিতে বলতেন। একবার ‘মান’ বিষয়ক ইংরাজি প্রবন্ধ সঠিক ভাষায় নির্ভুল ব্যাকারণসম্মতভাবে লিখে ক্লিাসেই সকলের নজর কেড়েছিলেন। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় স্কুলের মধ্যে প্রথম হওয়ার জন্য তাকে বিশেষ পুরস্কার হিসাবে দেওয়া হয়েছিল। Wealth of Nations.

এই পুরস্কারের ধারা তাঁর সারা জীবন অব্যাহত ছিল। ভাষাচার্য হওয়ার পথে সুকুমার সেনের শৈশবের দিনগুলো ছিল উন্নতির সোপান। এই ভাষাবিদ ৯২ বছর বয়সে গত ১৯৯২ সালের ৩ মার্চ পরলোকগমন করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *