লেখক পঙ্কজ সেন
১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত “জলপাইগুড়ি ফ্রেন্ডস ড্রামাটিক ক্লাব” এ শিশিরকুমার ভাদুড়ী, গুরুদাস ব্যানার্জি, মলিনা দেবী, মহেন্দ্র গুপ্তের মতো বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বরা অভিনয় করেছিলেন। ক্লাবের নাট্যশালাতে পরপর সাতদিন সীতা, আলমগীর এবং চন্দ্রগুপ্ত নাটকে অভিনয় করেছিলেন নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী। এক রজনীতে “আলমগীর” নাটক মঞ্চস্থ করে বিক্রয় হওয়া টিকিটের সকল অর্থ তিনি ক্লাব সদস্যদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে ১৯২৩-২৪ সালে শহরের এদিকে- সেদিকে মঞ্চ তৈরি করে নাটক করতেন “ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন”। সেই নাট্যমোদীরাই পরবর্তীতে গড়ে তুলেছিলেন “ফ্রেন্ডস ড্রামাটিক ক্লাব”।

১৯২৪ সালে বান্ধব নাট্য সমাজের নিজস্ব ভবন নির্মিত হয়। বিবি মনজন্নেছা খাতুনের কাছ থেকে বার্ষিক ২০০ টাকা খাজনার বিনিময়ে পাওয়া ২৪ কাঠা জমির ওপর অডিটোরিয়াম ও গ্রীন রুম নির্মিত হয়। তবে এই দুটি রুম নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন খান বাহাদুর মখলেছার রহমান, নগেন্দ্রনাথ মহালানবীশ এবং রায় বাহাদুর তথা বিশিষ্ট চা শিল্পপতি ও উকিল কালীপদ ব্যানার্জি। উল্লেখ্য যে,১৯৪৫ সালে কালীপদবাবু করোনারি থ্রম্বসিস রোগে মারা গেলে তার বড় পুত্র পেশায় প্রখ্যাত উকিল উমাপদ ব্যানার্জি দীর্ঘদিন বান্ধব নাট্য সমাজের সম্পাদকের পদ সামলে ছিলেন। এই তিনজন ছাড়াও সেই সময় এই মঞ্চ নির্মাণে আর্থিক সহায়তা করেছিলেন নবাব মোশাররফ হোসেন, বৈকুন্ঠপুর রাজবংশের রাজা প্রসন্নদেব রায়কত, লোকেন বাগচী, কালীপদ মৈত্র প্রমূখ। এই নাট্যমঞ্চে প্রথম দশ বছর মঞ্চস্থ হয় কারাগার, ষোড়শী, বঙ্গে বর্গী, কিন্নরী, পথের শেষে, রঘুবীর, বিসর্জন, বেহুলা, পরমা, প্রতাপাদিত্য, মহানিশা, দেবলাদেবী এবং চন্দ্রগুপ্ত নামক নাটকগুলি। উক্ত নাটকগুলি বান্ধবনাট্য সমাজের নিজস্ব নির্মাণ। ৩০ এর দশকের শেষদিকে অভিনীত হল সীতা, বাংলার মেয়ে, মানময়ী গার্লস স্কুল। ১৯৪৪ সালে “নবান্ন” মঞ্চস্থ হলে গণনাট্য আন্দোলনের সাড়া ফেলে দিল এই শহরেও। ১৯৫৭ সালে এখানে যোগ দিলেন নাট্যকার রবি ঘোষ। ৭ বছর নাটক মঞ্চস্থ বন্ধ থাকার পর অভিনীত হলো তারই লেখা জলসাঘর ও মহেশ এর নাট্যরূপ। জলসাঘর সেই নাটক যেখানে প্রথম পুরুষের বদলে মঞ্চে এলেন মেয়েরা। রবীন্দ্রজন্ম শতবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে ১৯৬১ সালে মঞ্চস্থ হলো ক্ষুধিত পাষাণ,অচলায়তন ও মুক্তধারা। ক্ষুধিত পাষাণ মঞ্চস্থ হবার সময় দর্শক আসনে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন সুনীতিকুমার চ্যাটার্জী। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে নিজস্ব প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হলো বিরিঞ্চিবাবা, বায়েন, শোভাযাত্রা,পাগলা গারদ, এবং একটি অবাস্তব কাহিনী। এই নাট্য সমাজে নাটক করতেন বরুণ ভট্টাচার্য, গৌতম চক্রবর্তী প্রমূখ। বান্ধবনাট্য সমাজ প্রথম থেকেই তাদের প্রেক্ষাগৃহটি সিনেমা কোম্পানিকে লিজ দিয়ে এসেছে এই শর্তে যে, বছরের ২৪ দিন তারা নিজেরা ব্যবহার করবে। প্রথমে নির্বাক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করত স্পেন্সার টকিজ,তারপর চিত্রালী, তারপর ১৯৫৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে চলেছে দীপ্তি টকিজ। বর্তমানে অবশ্য বহুদিন ধরে এখানে সিনেমা প্রদর্শন এক প্রকার বন্ধ হয়ে আছে। পঞ্চাশের দশকে জলপাইগুড়ি আনন্দ চন্দ্র কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা সোশ্যাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল দীপ্তি টকিজের মঞ্চে। সেই অনুষ্ঠানে গান গিয়েছিলেন শ্যামল মিত্র এবং হাস্যরস পরিবেশন করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা শীতল মুখার্জি। এই মঞ্চেই বিখ্যাত ব্যায়ামবীর কমল ভান্ডারীর দেহ সৌষ্ঠব অনুষ্ঠান প্রদর্শিত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে সংস্থাটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গড়ে তোলা হয় জয়ন্তি ভবন বা ছোট থিয়েটার হল। ক্লাবের নিজস্ব গ্রন্থাগারে রয়েছে অজস্র বই।

দীপ্তি হলের একটি অন্যতম প্রধান বিশেষত্ব ছিল, জলপাইগুড়িতে একমাত্র এই হলেই ইংরেজি ছবি দেখানো হতো। জেমস বন্ডের সিনেমা ছিল এই হলের প্রধান আকর্ষণ ছিল। সিনেমার নাম মাইক সহকারে লিফলেট বিলি করতে করতে খুবই সুরেলী কন্ঠে বলে যেতেন গোকুল ঘোষ নামক হলেরই একজন কর্মী। এই হ্যান্ডবিলে ইংরেজি ছবির নাম ও তার সম্বন্ধে লেখা থাকতো। সেই সময় জলপাইগুড়িবাসী দীপ্তি হলের তৎকালীন মালিক তপন মিত্রের জন্য অনেক ভালো ভালো ইংরেজি ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছে। প্রথমে শচীন মিত্র পরবর্তীতে তার অবর্তমানে পুত্র তপন মিত্র হলের দেখাশুনা করতেন। তপন বাবুর সময় সবচেয়ে নামকরা ইংরেজি ছবি দেখানো হতো। উপরে মেয়েদের বসার ব্যবস্থা ছিল। একতলায় টিকিট ঘর এবং একতলা ও দোতলার মাঝখানে সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নেমে মহিলাদের বাথরুম ছিল। আর ওপরের ছাদটা বেশ নীচু ছিল। তপন বাবুর সময় হলের সৌন্দর্য কিছুটা খাটো হলেও শহরের নামিদামি লোকজন ভিড় জমাতেন এইসব বিখ্যাত ইংরেজি ছবি দেখার জন্য। এই হলে প্রদর্শিত কিছু হিন্দি ও বাংলা ছবি হলো – কভি কভি, ক্রান্তি, শান, রোটি, পরিন্দা, ম্যায়নে প্যার কিয়া, আনন্দ আশ্রম প্রভৃতি।

জলপাইগুড়ির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে বান্ধব নাট্য সমাজের নাম অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত। এই ঐতিহাসিক সম্পত্তিকে হেরিটেজ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে “জলপাইগুড়ির ট্যুর অপারেটরস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন” পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনকে চিঠি পাঠিয়েছিলো। বর্তমানে এই ঐতিহ্যপূর্ণ ভবনটির ভগ্ন দশা এবং পূর্বের সেই স্বর্ণময় দিনগুলি আজও শহরের অনেক প্রবীণ ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের চোখে জল এনে দেয়। দীপ্তি হলের সামনে ঘুগনি- আলুটিক্কা আর পরোটা- মাংসের দোকান খুবই বিখ্যাত ছিল। সংস্কৃতিপ্রেমী জলপাইগুড়ি শহরবাসী মনে প্রানে চায়, প্রায় শতবর্ষে পা দেওয়া প্রাচীন এই ঐতিহ্যপূর্ণ ভবনটি পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠুক। অবশ্য সরকারি অনুদান ও সহযোগিতা ছাড়া এই সংস্থাকে বাঁচিয়ে রাখা এক প্রকার প্রায় অসম্ভব।

একটা সময় সিনেমা, নাটক সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতো এই বান্ধব নাট্য সমাজে। কিন্তু আজ কালের অমোঘ নিয়মে তার অস্তিত্ব শহরে এক প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : উমেশ শর্মা, ছবি লেখক