পিনাকী রঞ্জন পাল
“আবার এসেছে নতুন বর্ষ
মনেতে লেগেছে প্রবল হর্ষ
ঝরনার মতো মাচে গানে মেতে
কর উৎসব আজ দিনে রাতে।”
ঋতুচক্রের ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাক খেতে খেতে প্রাকৃতিক নিয়মে মহাকালের গর্ভে মিলিয়ে গেল আরও একটা বছর। বিদায় নিয়েছে ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। সূচনা হয়েছে ১৪৩০ বঙ্গাব্দের। বাংলা নববর্ষ। স্বাগতম, শুভ নববর্ষ।
বাঙালির নিজস্ব নববর্ষ পয়লা বৈশাখ হলেও পয়লা জানুয়ারিকেই এখন বাঙালিরা নববর্ষ হিসাবে মনে প্রাণে বরণ করে থাকে। তাই বর্তমানে পয়লা বৈশাখ দিনটি আমাদের কাছে সাধারণ দিনের মতই মনে হয়। ব্যবসায়ীদের কাছে পয়লা বৈশাখ দিনটি অতি পুণ্যের দিন। নতুন খাতা মহরতের দিন, যাকে আমরা বলি “হালখাতা”।
সারা বছরই আমরা ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী কাজ করে থাকি বলে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় এটা কত বঙ্গাব্দ? অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। আজ তোমাদের এর উত্তর বার করার একটা সহজ পদ্ধতি বলে দেব। এরপর থেকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে তোমাদের হোঁচট খেতে হবে না। ইংরেজি সাল থেকে ৫৯৩ বাদ দিলেই পেয়ে যাবে কত বঙ্গাব্দ তার উত্তর। আবার এই ৫৯৩ সংখ্যাটি যে-কোন সংখ্যা নয়। রাজা শশাঙ্ক ৫৯৩ বঙ্গাব্দেই কর্ণসুবর্ণে রাজধানী বানিয়েছিলেন।
প্রাচীনকালে কিন্তু পয়লা বৈশাখ দিনটি নববর্ষ হিসাবে পালিত হত না। সে সময় বাংলা নববর্ষ হিসাবে পালিত হত পয়লা অগ্রহায়ণ দিনটি। অগ্র মানে প্রথম আর হায়ন অর্থ হল বছর। অর্থাৎ অগ্রহায়ণ ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস।
বৈশাখ থেকে চৈত্র—এই হল বাংলা বার মাস। কিন্তু তোমরা কি জানো কিভাবে এই বার মাসের নামকরণ হয়েছিল। বাংলা বার মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম অনুসারে। এ থেকে আমরা জানতে পারি প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিদ্যা কতটা উন্নত ছিল।
প্রাচীনকালে এক পূর্ণিমা থেকে, আর এক পূর্ণিমা পর্যন্ত ৩০ দিনে মাস গণনা করা হত। দ্বাদশ পূর্ণিমা থেকে জ্যোতিষীরা লক্ষ্য করতেন সূর্য একটি বিশেষ নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে অবস্থান করে। যেমন বৈশাখী পূর্ণিমায় চাঁদ অস্ত যাওয়ার আগে থাকে বিশাখা নক্ষত্রের কাছে। আবার জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের কাছে থাকে। বিশেষ পূর্ণিমায় বিশেষ নক্ষত্রের কাছে চাঁদের অবস্থান লক্ষ্য করেই সেই নক্ষত্রের নামে চিহ্নিত করা হয়েছে মাসকে। সেই থেকে এই নিয়ম চলে আসছে।
এই ভাবেই এসেছে ‘বিশাখা’ নক্ষত্র থেকে বৈশাখ মাস, জ্যৈষ্ঠা’ নক্ষত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস, ‘আষাঢ়া’ নক্ষত্রের নামে আষাঢ় মাস, ‘শ্রবণা নক্ষত্রের নামে শ্রাবণ মাস, ‘পূর্ব ভাদ্রপদা’ নক্ষত্র থেকে ভাদ্র মাস, আশ্বিন মাস এসেছে ‘অশ্বিনী’ নক্ষত্র থেকে, ‘কৃত্তিকা’ নক্ষত্রের নামানুসারে ‘কার্তিক মাস’, ‘মৃগশিরা নক্ষত্র থেকে। মাগশীর্ষ—একে বছরের প্রথম ধরা হত তাই তার নাম অগ্রহায়ণ, পৌষ মাস এসেছে ‘পুষ্যা’ নক্ষত্র থেকে, মাঘ মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘মঘা’ নক্ষত্র থেকে, ‘ফাল্গুনী’ নক্ষত্র থেকে ফাল্গুন মাস এবং ‘চিত্রা’ নক্ষত্রের নামানুসারে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়েছে।
দিন বদল হল। অনেক অনেক কাল কেটে গেল। ইংরেজির দাপটে বাংলা সাল তারিখ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। কেউ কি বলতে পারো আজ বাংলা মাসের কত তারিখ? পয়লা বৈশাখ তাই দিনদিন একলা হয়ে যাচ্ছে। কারণ, দোসরা বৈশাখ থেকেই আবার আমরা বলব ১৬ই এপ্রিল।
সৌরলোকেও ঘটে গেছে নানান পরিবর্তন। যে যে নক্ষত্রে যে মাসের নাম এসেছে, সেই নক্ষত্রে আর চাঁদ থাকছে না। সরে গেছে দূরে। কেবল ভারতীয় জ্যোতির্বিদদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে আজও এই মাসের নাম ব্যবহৃত হচ্ছে। বাস্তবে কিন্তু তা আর নেই।

এখন পয়লা বৈশাখে যে হালখাতা অনুষ্ঠিত হয় তার উৎস খুঁজতে আমাদের যেতে হবে মোঘল আমলে। আকবরের আমল থেকেই হিজরি সন অনুযায়ী বছরের প্রথমদিন প্রজাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হত। প্রজারা তখন রাজস্ব হিসাবে দিতেন তাঁদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলান ফসল। যাকে বর্তমানে হালখাতা বলা হয়, মোঘল যুগে তারই নাম ছিল ফসলী। ফসলী মানে পুণ্য।
পয়লা বৈশাখকে নববর্ষ বলে স্বীকার করেন না পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানের আদিবাসীরা। তাঁদের কাছে বছরের প্রথম মাস হল মাঘ। তাই পয়লা মাঘেই এঁরা পালন করেন মাগসিম উৎসব। ওইদিনই এঁদের নববর্ষ পালিত হয়। উৎসবের অঙ্গ হিসাবে এঁরা ওইদিন ঝুরিনামা বট-অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় মোরগ বলি দেন।
বাঙালিদের নববর্ষ পয়লা বৈশাখ হলেও এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ হয়। গুজরাটে দেওয়ালির দিন, রাজস্থানে রামনবমীর দিন, কর্নাটকে পয়লা চৈত্রে, অন্ধ্রপ্রদেশে আবার চৈত্র মাসের পূর্ণিমার দিন নববর্ষ উৎসব পালিত হয়।