ভারত সফরে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা;
দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল

অরুণ কুমারের বিশেষ প্রতিবেদন : ভারত সফর শুরু হতে চলেছে বঙ্গবন্ধু কন্যার। রাষ্ট্রীয় সফরে ৫ই সেপ্টেম্বর নতুন দিল্লি আসছেন বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ওই সফরটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন সফর বাস্তবায়নে ভারতের তৎপরতা ইতিমধ্যে আরম্ভ হয়েছে। আগামী বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন মোড় নিতে পারে। অপরদিকে, পেশাদার কূটনীতিকদের মতে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বোঝাপড়া, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি, যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে জ্বালানি সহ নিত্যপণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট এবং বাংলাদেশ ও ভারতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সফরটিতে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে।

জানা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার সেটি করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছেন। এই মর্মে সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ওই বক্তব্য দেওয়ার একদিন পর ঢাকাস্থিত ভারতীয় হাই কমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভারত সব সময় বাংলাদেশের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে।

সূত্রের খবর, সরকার প্রধানের সফরের এডভান্স টিম এরইমধ্যে দিল্লি ঘুরে এসেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রায় ৩ বছর বিরতির পর পূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সফরে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী ভারতে আসছেন।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দুই বন্ধু রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যকার মুখোমুখি বৈঠক হবে। সেখানে নিশ্চিতভাবে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কথা হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক সম্পর্কের ‘ভুল বোঝাবুঝি’ নিরসনের চেষ্টা হবে। অর্থনৈতিক এবং সামরিক খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। এছাড়া বাংলাদেশের আগামী দিনের নেতৃত্ব নিয়ে ঢাকায় যে জল্পনা-কল্পনা চলছে তা আলোচনায় থাকলেও থাকতে পারে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা।

অপরদিকে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো হলো এই , বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের প্রস্তুতির মুহূর্তে বাংলাদেশে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র স্বপ্রণোদিত সফর, ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের যোগাযোগে আচমকা তৎপরতা বেড়ে যাওয়া তথা বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে দিল্লির ডেটলাইনে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে ঢাকার সঙ্গে দিল্লির প্রতিরক্ষা চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতির কথাও জানাচ্ছে দিল্লির সংবাদ মাধ্যম। ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস অনলাইন সূত্রের জানা গিয়েছে, বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৩টি বিষয় বোঝাপড়া হবে। দুই দেশের মধ্যকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারে আনুষ্ঠানিক চুক্তি সইয়ের ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। বলা হয়েছে- ওই চুক্তির খসড়া ইতিমধ্যে প্রস্তুত এবং বিনিময় হয়েছে। সরকার প্রধানের আসন্ন সফরে বঙ্গোপসাগরের সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি যৌথ উৎপাদনের বিষয়টি পাকাপোক্ত করবে ঢাকা ও নতুন দিল্লি। 

সূত্রের খবর, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বিস্তারের প্রেক্ষাপটে নতুন দিল্লি ঢাকার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সুদৃঢ় করার আলোচনায় জোর দিয়েছে।

এই বিষয়ে আরো উল্লেখ করতে হয় যে, ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক একটি ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছিল জানিয়ে ওই রিপোর্টে বলা হয়, আগামী ৫ থেকে ৮ই সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা আপগ্রেড করা হবে এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবিত চুক্তিটি সই হতে পারে। রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ভারত সফরে মহাকাশ গবেষণা, সাইবার নিরাপত্তা, সুনীল অর্থনীতি এবং পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে পারস্পরিক সহযোগিতা গভীর করার  আলোচনা হয়েছিল। ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের রিপোর্টে রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ভারত সফরে মহাকাশ গবেষণা, সাইবার নিরাপত্তা, সুনীল অর্থনীতি এবং পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে পারস্পরিক সহযোগিতা গভীর করার  আলোচনা হয়েছিল। ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের রিপোর্টে বলা হয়, ক’বছর ধরে ঢাকার কাছে সামরিক সরঞ্জামাদি বিক্রি নিয়ে আলোচনা করছে নয়াদিল্লি।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, শেখ হাসিনার এবারের সফরে দু’দেশের মধ্যে ‘সেপা’ (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট) নামক বাণিজ্য চুক্তিটি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজে এই চুক্তির খসড়ায় অনুমোদন দিয়ে দিয়েছেন। এখন শুধু এ বিষয়ে ভারতের রাজি হওয়ার অপেক্ষা। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে শত শত পণ্যের অবাধ ও শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের জন্য এটিকে একটি ‘ল্যান্ডমার্ক’ বা যুগান্তকারী সমঝোতা বলে গণ্য করা হচ্ছে। কিন্তু এর সংবেদনশীলতা অনুধাবন করে সেই প্রস্তাবে পরিবর্তন এনেছে ভারত। ওই বিশ্লেষকের মতে, এখন এটি একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে যদি নয়াদিল্লি ঢাকার প্রয়োজন বিবেচনায় সামরিক হার্ডওয়্যার বা সরঞ্জামাদির যৌথ উৎপাদনে সম্মত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রতিরক্ষা সংলাপে ওই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রিপোর্ট বলছে, ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পান্ডের ঢাকা সফরে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব, তাই ভারতীয় সেনাপ্রধান তার সঙ্গে দেখা করেছেন। বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের আসন্ন দিল্লি সফরে দুই বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং বর্ধিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে ঐকমত্য হতে পারে।

এদিকে আরও একটি উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, এটিই হতে চলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শেষ ভারত সফর। সঙ্গত কারণে এই সফরের দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে দিল্লি। এই সফরকে ফলপ্রসূ করে তুলতে ভারত ও বাংলাদেশ; দুইপক্ষেই কূটনৈতিক তৎপরতা রয়েছে তুঙ্গে। সফরের নানা লজিস্টিক্যাল খুঁটিনাটি এই মুহূর্তে চূড়ান্ত করছেন তারা। শেখ হাসিনা এই সফরে নতুন দিল্লিতে পা রাখতে চলেছেন ৫ই সেপ্টেম্বর সোমবার। সেদিন অবশ্য কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক থাকছে না, তবে চাণক্যপুরীর বাংলাদেশ দূতাবাস প্রাঙ্গণে তিনি সেদিন ভারতীয় অতিথিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হবেন বলে কথা রয়েছে। ভারতে বাংলাদেশের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান এই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করছেন বলে জানা গিয়েছে।

এ বিষয়ে একটু উল্লেখ করতে হয় যে, ২০১৭ সালের মার্চে তার দিল্লি সফরে শেখ হাসিনা উঠেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে। তখন ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রণব মুখার্জি। যাকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সৌহার্দ্যরে সুবাদে শেখ হাসিনা ডাকতেন কাকাবাবু’ বলে। সেবার ‘কাকাবাবু’র আতিথ্য গ্রহণ করলেও ২০১৯ সালের অক্টোবরে তিনি কিন্তু দিল্লির তাজ প্যালেস হোটেলেই থেকেছিলেন। আসন্ন সফরে তার ঠিকানা হবে সর্দার প্যাটেল রোডের  সেই অভিজাত হোটেলটিতে। ৬ই সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) হলো শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের মূল ‘বিজনেস ডে’ বা আসল কার্যদিবস। সেদিন সকালে রাজঘাটে গান্ধী সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা অর্পণ ও রাষ্ট্রপতি ভবনে গার্ড অব অনারের মধ্যদিয়ে তার আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনার শেষে শুরু হবে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলো। 

প্রতিনিধিদল পর্যায়ের বৈঠকের পাশাপাশি দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠকও (সামিট বা শীর্ষ সম্মেলন) সেদিনই অনুষ্ঠিত হবে। দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে দিনভর সেসব বৈঠকের শেষে দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করা হবে বলে ঠিক হয়েছে। ভারতে সিআইআই বা ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের মতো প্রধান বণিক সভাগুলোর প্ল্যাটফরমে শেখ হাসিনা পরের দিন সকালে ভাষণ দেবেন। ভারতের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে কীভাবে উভয়পক্ষই উপকৃত হতে পারে, সেই চিত্রই সেখানে তুলে ধরবেন তিনি। বুধবার বিকালেই তিনি পাড়ি দেবেন রাজস্থানের পবিত্র আজমীর শরীফ দরগায়। সফরের একেবারে শেষ পর্বে এই মাজার দর্শনের পরেই রাজস্থানের জয়পুরের বিমানবন্দর থেকেই বৃহস্পতিবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, আসন্ন সফরে বহু প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি দিনের আলো দেখছে না, এটা স্পষ্ট। দুই পক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তারাই একান্ত আলোচনায় স্বীকার করেছেন, তিস্তা চুক্তির জট এই সফরেই খুলে যাবে- এতটা আশা করা উচিত হবে না। তাই বলে সফরের অর্জন কম হবে- এটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। দিল্লির এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টে বলা হয়, ‘মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের আগে এটাই শেষবারের মতো তার ভারতে আসা। ফলে ভারত শেখ হাসিনাকে কিছুতেই খালি হাতে ফেরাতে পারবে না।

এছাড়া এবার শেখ হাসিনার সফরের ঠিক আগে একযুগেরও বেশি সময় পর দিল্লিতে বসেছিল দু’দেশের জয়েন্ট রিভার্স কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক। দুই দেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন নদীর জল ভাগাভাগি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জেআরসি যে বিষয়গুলোতে একমত হবে, প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সময় সেটাই সমঝোতার আকারে পূর্ণতা পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে দুদেশের সরকারের প্রস্তুতি আলোচনা প্রক্রিয়ায় এই বিকল্প সমাধানের সূত্র বেরিয়ে আসতে চলেছে । তিস্তা নিয়ে দিস্তা দিস্তা সরকারি নথির পাহাড় সরিয়ে দুদেশে বহতা  আরও অন্তত সাতটি নদীর জল ভাগ করে নিলে অনায়াসেই  বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।

সূত্রের খবর, হাসিনার ভারত সফরকালে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সাতটি কম আলোচিত নদীর জলবণ্টনের কাঠামো নিয়ে চুক্তিতে কোনও বাধা থাকবে না। ছোট বড় মিলে দুই বাংলার মধ্যে প্রবহমান মোট ৫৪টি নদীর জল নিয়ে সামগ্রিকভাবে আলোচনা চলছে দুদেশের কূটনৈতিক চ্যানেলে। সদ্য অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিকল্প পথের বিষয়ে সবুজ সংকেত স্পষ্ট। তথ্যসূত্র অনুযায়ী এমনটাই  মনে করা হচ্ছে।

অসম ও ত্রিপুরায় কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি সরকার থাকায় সাতটি নদীর জলবণ্টনের প্রশ্নটি সহজেই সমাধান করতে পারবে বলে মনে করছে ভারত সরকারের বিদেশ ও জলসম্পদ মন্ত্রক। তাছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির সম্ভাবনা কম থাকলেও অন্য দু একটি নদীর জল নিয়ে মমতা ব্যানার্জির  সরকারের কোনও আপত্তি নেই বলেই ভারত সরকারের  ধারণা। কারণ, রায়ডাক বা সঙ্কোশের জল আগেই রাজ্য সরকারের তরফে ঘরোয়াভাবে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কারণ  তিস্তার যে জলাভাব তা সঙ্কোশ, রায়ডাক বা অন্যান্য শাখানদীগুলির ক্ষেত্রে নেই। দু দেশের দ্বিপাক্ষিক পরিসরে বাংলাদেশ এখনও বেশ ফিল গুড মনোভাব নিয়ে এগোচ্ছে। বিশেষ করে এক যুগ পর যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের বিষয়ে ভারত অনেকটাই উদারনৈতিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে।বৃহত্তর স্বার্থে কিছু ক্ষুদ্রস্বার্থ ছাড়তেই হচ্ছে উভয় পক্ষকে ।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যিনি প্রধানমন্ত্রী প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের তার এই সফল কালের মধ্যে দিয়ে অনেক আশা আশা ব্যাঞ্জক দিক ফুটে উঠেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল। কেন্দ্রে যে সরকারই থাকুক বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের বিদেশনীতির দিশা একটুও পরিবর্তন হয় নি। এবিষয়ে অনেক বড় দেশ হিসেবে ভারতের কিছু আনুষঙ্গিক ও আঞ্চলিক স্বস্তি ও সুস্থিতির প্রশ্ন জড়িত। আঞ্চলিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে চীনের অবস্থানের দিকে সর্বদা নজর দিতে হয়। যেটা চিরকালই ঘটে এসেছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক – রাজনৈতিক অবস্থান  আরও বাড়তি গুরুত্বের দাবিদার।  ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সেই দায়িত্ব মাথায় নিয়ে চলতে হয়। যেদিকে  তাকিয়ে সবচাইতে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর দাবি দাওয়া আবদার রক্ষা করে চলাটাই ভারতের চিরাচরিত দস্তুর। স্পর্শকাতর চিকেন নেকের ২২ কিমির কথা ভেবে  চীনের চোখ রাঙানির পাশাপাশি বাংলাদেশের মত স্বাভাবিক মিত্রকে ভারত কখনও হারাতে চায় না। তাছাড়া বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সদর্থক বন্ধুর ভূমিকাকে ভারত সদাসর্বদা মনে রাখতে চায়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেই প্রকৃত মিত্রের ভূমিকা পালন করে আসছে প্রতিবেশী মিত্র বাংলাদেশ।

২০০৬ এ ক্ষমতায় ফিরে এসেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান অনমনীয় রেখেছেন।  আলফা জঙ্গিদের গ্রেপ্তার ও ভারতের হাতে তুলে দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের মাটি ভারতবিরোধী কোনও কার্যকলাপে ব্যবহৃত হতে দেব না। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেমন নৈতিক  অবস্থান স্পষ্ট করেছেন, তেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রীও সদর্থক সাড়া দিয়েছেন। এই ধারাবাহিকতার কারণেই ২০১৭ র পর এবার ভারত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদের নেতৃত্বে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও বেশ কিছু জটিলতা কাটিয়ে নিয়ে কিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত ও পুরনো চুক্তির নবীকরণ হতে চলেছে। দুদেশের মাটিতে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক ছাড়াও অন্যান্য দেশে বা আঞ্চলিক শীর্ষ বৈঠকের পরিসরে নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার দেখা ও কথা হয়েছে অন্তত বার দশেক।

বর্তমান কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন সরকারের আমলেই স্থল সীমান্ত চুক্তি ও  সমুদ্র সীমানা চুক্তির মতো জটিল আন্তর্জাতিক চুক্তির জট ছাড়ানো সম্ভব  হয়েছে। অতীতের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ভিত্তিতেই দুদেশের মধ্যে লাগাতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দুদেশের মধ্যে রেল যোগাযোগও বাড়ছে। ট্রানজিট নিয়েও বাংলাদেশের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চায় না ভারত। সবটাই ধীরে ও  সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে এটাও ঠিক যে, বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে হাসিনা আসছেন ভারতে। দীর্ঘদিন শাসনযন্ত্র পরিচালনার ফলে তিনি দিনে দিনে আরও সমাহিত ও পরিণত ভাবে লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন। কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার দক্ষতার পাশাপাশি তাঁকে সাহায্য করে এসেছে ভারত বাংলাদেশের রক্তের সম্পর্কের ঐতিহ্য ও পারস্পরিক নির্ভরতা।  তাঁর প্রথম প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলেই তিনি দিল্লিতে এসে গঙ্গাজল চুক্তির মতো মাইলফলক হাসিল করেছিলেন।  ভারত সেই চুক্তিতে ঔদার্যের স্বাক্ষর রেখেছিল এবং তার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতি বসুর নিজের ও দলের সরকার সাকুল্যে আরও চোদ্দ বছর ক্ষমতায় ছিল। গঙ্গার জলের  টানে ভোট ভেসে যাওয়া তো দূরের কথা আরও উজানে উজিয়ে এসেছিল। এবার সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ ও নবীকরণের সময় এসেছে।  ২০২৬ এ চুক্তির ৩০ বছরের মেয়াদ শেষ হলে পুনর্নবীকরণ নিয়ে  ফের তিস্তার মতো বিভ্রাট বাধতে পারে বলে সরকারের শঙ্কা।  সুতরাং চারবছর হাতে নিয়েই এবিষয়ে কথা শুরু হয়েছে।  দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পরিসরেও কথা হবে বলে আশা। সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন, এটাতো আর নতুন কোনও চুক্তি স্বাক্ষর করার ব্যাপার নয়। শুধুমাত্র নবীকরণের আনুষ্ঠানিকতা। সুতরাং দিল্লিই এটা করতে পারে এককভাবে। দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে যেখানে যেখানে উভয়ের জাতীয় স্বার্থ জড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে দুদেশের নেতাই ঘর গোছানোর কথা মাথায় রেখেছেন।

প্রতিবেশী বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের নিরিখে তারা স্বল্প উন্নত দেশের তকমা খুলতে পেরেছে। সেই জায়গায় তারাও এখন উন্নয়নশীল  দেশের শ্রেণীতে। এই কারণে তারা ডিউটি ফ্লি বা শুল্ক ছাড়ের সুযোগ আর পাবে না সাধারণ ভাবে। কিন্তু ২০২৯ থেকে যাতে বাংলাদেশ এই সুযোগে যাতে পুরোপুরি বঞ্চিত না হয় সেই আবেদন আগেও এসেছে প্রধানমন্ত্রীদের আলোচনার পরিসরে। এবার দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেও বিষয়টি উত্থাপন করবেন হাসিনা। 

সবমিলিয়ে যে সদর্থক বার্তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ঢাকায় ফিরবেন তাতে পদ্মা বেয়ে তরতরিয়ে গিয়ে  তার নৌকা এবারও  পাড়ের নাগাল পাবে অনায়াসে এমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক পর্যপেক্ষ মহল।

এবারে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হয়তো দিল্লিতে নিশ্চিতভাবেই আসতেন, কিন্তু ইতিমধ্যে সিবিআই বা ইডি’র মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো রাজ্যে তার দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যে লাগাতার অভিযান শুরু করেছে, তাতেই বিষয়টা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এহেন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের স্বার্থে মমতা ব্যানার্জি আদৌ সে সময় দিল্লি আসবেন কিনা, সেটাও বিরাট প্রশ্ন।

শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজধানীতে এসে তার সঙ্গে দেখা করবেন কিনা, তা নিয়েও এই মুহূর্তে জল্পনা তুঙ্গে। শেখ হাসিনা নিজে যে চাইছেন দিল্লিতে তার সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির দেখা হোক, তা অবশ্য পরিষ্কার। গত মাসেই তিনি সরাসরি মমতা ব্যানার্জিকে চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছেন, আমি দিল্লিতে আসছি, আপনিও সেখানে আসুন। এই প্রস্তাবে প্রচ্ছন্ন সায় ছিল দিল্লিরও। 

শেখ হাসিনা এই ‘আমন্ত্রণ’ জানানোর পর কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকেও পশ্চিমবঙ্গকে বার্তা পাঠানো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় দিল্লিতে আসেন তা খুবই ইতিবাচক একটা সংকেত দেবে। তিস্তার মতো যেসব অমীমাংসিত বিষয় মমতা ব্যানার্জির বাধায় আটকে আছে বলে ধারণা করা হয়, সেগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে সরাসরি ও খোলামেলা কথাবার্তা হোক, এটা আসলে দিল্লিও চাইছে।

এই অবস্থায় প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের দিকে তাকিয়ে দিল্লি ও ঢাকা সহ দুই দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।

Photo Credit- ANI official FB page.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *