লেখক পঙ্কজ সেন
জলপাইগুড়ি জেলার বেলাকোবায় ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময়ে এক বিশেষ প্রকৃতির চমচম প্রথম তৈরি হয়েছিল বলেই, এই মিষ্টি বেলাকোবার চমচম নামে প্রসিদ্ধ। বেলাকোবার বিখ্যাত এই চমচমের আদি নিবাস হলো ওপার বাংলার ময়মনসিংহ বিভাগের টাঙ্গাইল জেলার ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে অবস্থিত পোড়াবাড়ি এলাকায়। সেখানকার মানুষেরা কড়া পাকের মিষ্টি অত্যন্ত পছন্দ করতেন, আর সেই কড়া পাক দিয়ে তৈরি হতো সুস্বাদু চমচম। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি অঞ্চলে সর্বপ্রথম এই বিখ্যাত মিষ্টি তৈরি করেছিলেন দশরথ নামক এক কারিগর। পরে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যান্য কারিগররাও এই মিষ্টি তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং বংশ পরম্পরায় ওই ব্যবসা করতে থাকেন। পোড়াবাড়ি সেই সময়ে ‘চমচমের রাজধানী’ নামে লোকমুখে জনপ্রিয় ছিল।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে দেশ বিভক্ত হয়। ওপার বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) টাঙ্গাইলের কিছু ছিন্নমূল কারিগর ধলেশ্বরী নদীর পাড়ের বসতি ছেড়ে এপার বাংলার (ভারতবর্ষ) উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বেলাকোবায় চলে আসেন দুই বন্ধু ধীরেন্দ্রনাথ দে সরকার ও কালিপদ দত্ত। আর তাদের সঙ্গেই চলে আসে পোড়াবাড়ির সেই বিখ্যাত চমচমের রেসিপি। বেলাকোবায় আড়াআড়িভাবে বিভক্ত রেল লাইনের দুই দিকে দুই বন্ধুর দুটি চমচমের দোকান গড়ে ওঠে। টাঙ্গাইলের চমচমের রেসিপিতে তারা এখানে নতুনভাবে চমচম তৈরি করে, যা পরে বেলাকোবার চমচম নামে পরিচিতি পায়। পোড়াবাড়ির চমচমের সকল বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকায় এখানকার খাদ্য রসিকদের কাছে এই চমচমের স্বীকৃতি পেতে বেশি সময় লাগেনি। এই দুই বন্ধুর হাত ধরেই ধীরে ধীরে বেলাকোবার চমচম উত্তরবঙ্গের সর্বত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই চমচম এখন বেলাকোবার এক অন্যতম পরিচিতি হয়ে উঠেছে।
কিন্তু পোড়াবাড়ির চমচমের ঘরানার সাথে বেলাকোবার চমচমের ঘরানার কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন পোড়াবাড়ির চমচমের বৈশিষ্ট্য হলো কড়া পাক। কিন্তু বেলাকোবার চমচমে কড়া পাকের সঙ্গে যুক্ত হয় অধিক পরিমাণে ক্ষীর। পেল্লাই আকারের গোলাপি চমচমে বরফের কুঁচির মত ছড়িয়ে দেওয়া হয় ক্ষীরের দানা এবং ভেতরে রসে টইটম্বুর। একবার চেখে দেখলেই টের পাওয়া যাবে বেলাকোবার চমচমের আসল চমক।
বেলাকোবার বুকে আজ কম করে প্রায় কুড়ি জনের মত চমচম ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বুধন দত্ত, উদয় দে সরকার, গোপাল রাহা, অম্বিকা পাল, রতন দাস প্রমুখ। যে কোনো উৎসবের মরশুমে বেলাকোবার চমচমের চাহিদা তুঙ্গে থাকে। যেমন খেতে তেমনই তার স্বাদ। ১০ টাকা মূল্য থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৮০ টাকা মূল্যের চমচম এখানে পাওয়া যায়। আকার যত বড়, দাম তত বেশি।
আজকের বর্তমান নব প্রজন্মের কাছে ফাস্টফুডের প্রতি একটা তীব্র ঝোঁক থাকলেও তাতে বেলাকোবার চমচমের জনপ্রিয়তায় কিন্তু বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। অর্থাৎ মিষ্টি প্রিয় বাঙ্গালীর পছন্দের তালিকায় বেলাকোবার চমচম একটা নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। যেন বেলাকোবা মানেই চমচম। এই নিজ গুনেই আজ সে রাজ্য তথা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও পাড়ি দেয়। ২০২২ সালের মে মাসে জনপ্রিয় বাংলা অনুষ্ঠান দাদাগিরির মঞ্চে সৌরভ গাঙ্গুলীর মুখে বেলাকোবার চমচমের প্রসঙ্গ উঠে আসে। যা তার পরিচিতি আরোও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।