পিনাকী রঞ্জন পাল
(এক)
শীতল হাওয়ায় মোড়া জলপাইগুড়ি শহর, যেখানে সময় যেন ধীর গতিতে চলতে থাকে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা এই শহরের প্রতিটি কোণেই এক ধরনের সহজ সরলতা লুকিয়ে আছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি নামকরা কলেজ, যেখানে প্রতিদিন শত শত ছাত্রছাত্রী নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য ছুটে আসে।
এই কলেজের অগণিত ছাত্রছাত্রীর ভিড়ের মধ্যেই দেখা মেলে সত্যজিতের। সত্যজিৎ এক সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। শহরের একটু বাইরে তার ছোট্ট বাড়ি। বাবা একজন স্কুল শিক্ষক, মা গৃহিণী। মধ্যবিত্ত পরিবারের রুটিন বাঁধা জীবনের সমস্ত চেনা সীমাবদ্ধতা সত্যজিতের কাছে একেবারেই স্বাভাবিক। তবে তার মধ্যে এক অনন্য গুণ রয়েছে—পড়াশোনার প্রতি তার অগাধ একাগ্রতা। সে কলেজে সবসময় সবার থেকে আলাদা। তার মনের জগৎ অন্যরকম।
ক্লাসে শিক্ষকরা যখন কোনো কঠিন প্রশ্ন করেন, তখন সত্যজিৎ এমনভাবে উত্তর দেয় যে তার মেধা আর পরিশ্রমের প্রতি সবার শ্রদ্ধা জাগে। তার পোশাক পরিচ্ছদ সাদামাটা, কথাবার্তা বিনয়ী। বন্ধুবান্ধব তেমন নেই বললেই চলে। তার জীবন আবর্তিত হয় বইয়ের পাতা আর ক্লাসের পড়াশোনার মধ্যেই।
অন্যদিকে, শালিনী পুরোপুরি ভিন্ন জগতের মেয়ে। শহরের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে সে। তার বাবা একজন প্রতিষ্ঠিত নেতা, যিনি ক্ষমতার দম্ভে শহরের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন। শালিনীর জীবন ছিল বিলাসিতা আর আরামে পরিপূর্ণ। তার পোশাক পরিচ্ছদ, ব্যবহার—সবকিছুতেই ধরা পড়ে তার অভিজাত পরিবারের ছাপ।
শালিনী স্কুলজীবন থেকেই সবসময় সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তার চারপাশে বন্ধুর ভিড় লেগেই থাকে। কলেজেও একই চিত্র। তবে তার পড়াশোনার প্রতি তেমন মনোযোগ নেই। গ্ল্যামার আর আধুনিকতার মোড়কে সে অনেক সময় নিজেকে আড়াল করলেও তার চোখে মাঝে মাঝে এক ধরনের বিষণ্নতার ছায়া দেখা যায়।
কলেজের ব্যস্ত ক্লাসঘরে এই দুই ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ একে অপরের মুখোমুখি হয়। সত্যজিতের গম্ভীর আর সাদামাটা স্বভাব প্রথমে শালিনীর মনে এক অজানা কৌতূহলের জন্ম দেয়। শালিনী জীবনে এমন কোনো ছেলেকে আগে দেখেনি যে তার দিকে না তাকিয়ে নিজের জগতে মগ্ন থাকে। আর সত্যজিতের কাছে শালিনী শুধুই এক দূর থেকে দেখা তারার মতো। সে জানে, তাদের মধ্যে পার্থক্য এতটাই গভীর যে সেই তারাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করাও বোকামি।
এভাবেই জলপাইগুড়ির সেই শীতল হাওয়ার মাঝে শুরু হয় এক গল্প, যা শেষ পর্যন্ত সত্যজিৎ আর শালিনীর জীবনকে বদলে দেবে।
(দুই)
শালিনী ক্লাসে পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগী ছিল না। তাকে নিয়ে শিক্ষকদের মাথাব্যথা কম ছিল না, কিন্তু তারা জানত, তার পেছনে বিশাল ক্ষমতাশালী পরিবার রয়েছে। ফলস্বরূপ, তার পরীক্ষার খাতায় নম্বর কিছুতেই কম পড়ত না। শালিনীর দিন কাটত বন্ধু-বান্ধব আর আভিজাত্যের চাকচিক্যের মধ্যে। প্রতিদিন নতুন জামাকাপড়, দামি পারফিউমের গন্ধ, আর বিলাসবহুল জীবনের ছাপ যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপে ফুটে উঠত।
তার চারপাশে সবসময় একটা দল থাকত—কখনো সহপাঠী, কখনো শহরের নামী ছেলেমেয়েরা। তাদের আড্ডায় ছিল শহরের ট্রেন্ডি বিষয়, নতুন কেনাকাটা, কিংবা কোনো হাই-প্রোফাইল পার্টির গল্প। শালিনী নিজেও যেন এই আলো ঝলমলে জীবনের মাঝেই নিজের পরিচয় খুঁজে পেয়েছিল।
তবে এই জীবনের মাঝে মাঝে শালিনীর মনে হঠাৎ এক শূন্যতা এসে ভর করত। সে যখন একা থাকত, তখন মনে হতো—এই চাকচিক্যের বাইরেও কিছু আছে, যা সে ঠিক ধরতে পারে না। ক্লাসে বসে কখনো কখনো সে এদিক-ওদিক তাকাত। একদিন এমনই এক মুহূর্তে তার চোখ পড়ে সত্যজিতের দিকে।
সত্যজিৎ ক্লাসে বসে ছিল সামনের সারিতে। মাথা নিচু করে খাতা-কলম নিয়ে নিজের পড়ায় এতটাই ডুবে ছিল যে আশপাশে কী হচ্ছে সে একদমই খেয়াল করেনি। শালিনী অবাক হয়ে দেখল, সত্যজিৎ একদম অন্যরকম। তার চেহারায় ছিল এক ধরনের শান্ত সৌন্দর্য, যা খুব কম মানুষের মধ্যে দেখা যায়।
তার সাদামাটা জামা, গম্ভীর মুখ আর চোখে-মুখে দৃঢ়তার আভা শালিনীর মনোযোগ কাড়ল। অন্য ছেলেদের মতো নয়, যারা প্রায়ই শালিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যস্ত থাকত। সত্যজিৎ যেন এক সম্পূর্ণ আলাদা জগতের মানুষ। তার এই গম্ভীর অথচ ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্র শালিনীর মনে অজানা কৌতূহল তৈরি করল।
শালিনী ভাবল, কেন এই ছেলেটা এত আলাদা? কেন সে কারো সঙ্গে মিশছে না? কেন সে তার জগতে এতটাই মগ্ন? শালিনীর জীবনে এই প্রথমবার কোনো ছেলেকে নিয়ে এমন কৌতূহল জাগল, যে তাকে একবারও দেখে হাসেনি, বা তার সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করেনি।
এরপর থেকে শালিনী তাকে আরো বেশি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। প্রতিদিন ক্লাসে সত্যজিতের সাদামাটা উপস্থিতি যেন তাকে বারবার ভাবিয়ে তুলল। শালিনী মনে মনে স্থির করল, এই ছেলেটির সঙ্গে তাকে কথা বলতেই হবে। তার জগৎ সম্পর্কে জানতে হবে। এক অদ্ভুত টান অনুভব করতে লাগল সে, যেটা আগে কখনো অনুভব করেনি।
শীতের এক বিকেল। কলেজের ক্লাস তখন সদ্য শেষ হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ ক্যাফেটেরিয়ার দিকে, কেউ লাইব্রেরি, আর কেউ বা রাস্তায় অপেক্ষমাণ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল। কিন্তু শালিনীর চোখ অন্য কোথাও।
সত্যজিৎ তার বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে চুপচাপ হাঁটছিল। অন্যান্য দিনের মতোই নিজের জগতে মগ্ন। সে ক্লাস শেষে লাইব্রেরি যাবে বলে মনস্থির করেছিল। ঠিক সেই সময়, শালিনী তার পথ আটকায়।
“সত্যজিৎ!” শালিনী ডাক দেয়। তার কণ্ঠস্বরে এক ধরনের দৃঢ়তা ছিল, যা সত্যজিৎকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করে।
সত্যজিৎ একটু অবাক হয়ে তাকায়। এতদিন ধরে ক্লাসে একসঙ্গে পড়লেও শালিনী কখনো তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেনি।
“হ্যাঁ?” সত্যজিৎ জিজ্ঞেস করে। তার কণ্ঠস্বরে বিনয়ের ছাপ স্পষ্ট।
“তোমার সাথে একটা কথা বলতে চাই,” শালিনী সরাসরি বলে।
“কী কথা?” সত্যজিৎ সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করে।
শালিনী একটু হাসে। “আমি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই।”
এই কথায় সত্যজিতের চোখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। সে কখনোই ভাবেনি, শহরের এত প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে তার মতো একজন সাধারণ ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইবে।
“আমার সাথে বন্ধুত্ব? কেন?” সত্যজিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
শালিনী একটুও বিচলিত হয় না। সে স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দেয়, “তুমি অন্যদের থেকে আলাদা। তুমি সাদামাটা, গম্ভীর, আর নিজের মতো। তোমার মতো মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ আমার আগে হয়নি। আমি জানতে চাই, তোমার জগৎ কেমন।”
সত্যজিৎ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। সে জানে, শালিনীর জীবনধারা আর তার জীবনধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের বন্ধুত্ব অনেক সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই সে নম্রভাবে বলে, “তুমি হয়তো ভুল করছ। আমাদের দুজনের জীবন খুব আলাদা। আমাদের বন্ধুত্ব হয়তো কারো ভালো লাগবে না।”
শালিনী হেসে বলে, “তুমি খুব সিরিয়াস। বন্ধুত্ব তো দুজনের ভালো বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে হয়, সমাজ কী বলবে সেটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। আমি জানি, তুমি অন্যরকম। আর সেই কারণেই আমি তোমার বন্ধু হতে চাই।”
সত্যজিৎ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে, শালিনী সহজে পিছু হটবে না। তার দৃঢ়তা আর জেদের কাছে সত্যজিৎ অবশেষে হার মানে।
“ঠিক আছে, আমরা বন্ধু হতে পারি। তবে মনে রেখো, আমি খুব সাদামাটা একজন মানুষ।” সত্যজিৎ সাবধান করে।
শালিনী খুশি হয়। তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। “সাদামাটা মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই বেশি ভালো লাগে।”
এরপর ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্বের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে সত্যজিৎ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করত, কারণ শালিনীর বিলাসবহুল জীবনধারা আর অভিজাত পরিচয় তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করত। কিন্তু শালিনী কখনো তার বন্ধু হওয়াকে ছোট করে দেখে না।
শালিনীর জেদের কারণেই তাদের মধ্যে কথা বলা শুরু হয়, আর সেই কথার মাঝেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক গভীর বন্ধুত্ব। কলেজের ক্যাম্পাসে, লাইব্রেরিতে, কিংবা পার্কে—তারা বিভিন্ন জায়গায় সময় কাটাতে শুরু করে। সত্যজিতের সাদামাটা চিন্তাভাবনা শালিনীর জন্য একদম নতুন অভিজ্ঞতা ছিল, আর শালিনীর প্রাণবন্ত স্বভাব সত্যজিতের জীবনে এক নতুন রং এনে দেয়।
তারা একে অপরের ভিন্ন দুনিয়াকে বুঝতে শেখে। সেই বন্ধুত্বের শুরুর দিনগুলোই যেন তাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায় হয়ে ওঠে।
(তিন)
বন্ধুত্বের সেই দিনগুলো সত্যজিৎ আর শালিনীর জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। তাদের সময় কাটত বিভিন্ন জায়গায়—কখনো কলেজের লাইব্রেরি, কখনো পার্কের বেঞ্চে বসে। শালিনী সত্যজিতের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসত, কারণ তার সাদামাটা চিন্তাধারা আর গভীর জ্ঞানের ভাণ্ডার শালিনীর জন্য ছিল একদম নতুন অভিজ্ঞতা।
শালিনী সত্যজিতের প্রতি ক্রমশ আকৃষ্ট হতে থাকে। সে লক্ষ্য করে, সত্যজিতের জীবনধারা তার মতো বিলাসবহুল না হলেও সেখানে এক ধরনের সরলতা আর সত্যতা রয়েছে। এই গুণগুলিই শালিনীর মনে সত্যজিতের প্রতি এক অজানা টান তৈরি করে।
অন্যদিকে, সত্যজিৎ ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, শালিনীর ব্যক্তিত্ব শুধু তার ধনী পরিচয়ের মোড়কেই সীমাবদ্ধ নয়। সে প্রাণবন্ত, দয়ালু, আর একজন ভালো মানুষ। শালিনীর প্রাণবন্ত আচরণ সত্যজিতের একঘেয়ে জীবনে রঙ এনে দেয়। তবে, সে নিজের অনুভূতিকে চেপে রাখে। সে জানত, তাদের সামাজিক অবস্থানের বিশাল ফারাক তাদের সম্পর্ককে কখনোই মেনে নেবে না।
একদিন, শীতের হালকা মেঘলা আকাশের নিচে তারা দুজন পার্কে বসে গল্প করছিল। চারপাশে ছিল নির্জনতা। শালিনী হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে যায়। সত্যজিৎ লক্ষ্য করে তার পরিবর্তিত মেজাজ।
“তোমার কি কিছু হয়েছে?” সত্যজিৎ প্রশ্ন করে।
শালিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “সত্যজিৎ, আমি তোমার সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।”
সত্যজিৎ একটু অবাক হয়। “কী কথা?”
শালিনী সত্যজিতের চোখের দিকে তাকায়। তার চোখে ছিল এক গভীর আবেগ। সে ধীরে ধীরে বলে, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
সত্যজিৎ হতবাক হয়ে যায়। সে কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বলে, “শালিনী, এটা সম্ভব নয়। আমরা দুই ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ। তোমার পরিবার কখনোই আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না।”
শালিনী দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দেয়, “আমার কাছে পরিবার নয়, তোমার ভালোবাসা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানি, আমাদের মধ্যে অনেক ফারাক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ভালোবাসার কাছে এসব বাধা কিছুই না।”
সত্যজিৎ তার কথায় অভিভূত হয়। কিন্তু তার মনে সন্দেহ ছিল। সে বলে, “তুমি কি নিশ্চিত? আমি তো স্রেফ একজন সাধারণ মানুষ। তুমি কি সত্যিই আমার সঙ্গে সারাজীবন থাকতে পারবে?”
শালিনী তার হাত ধরে বলে, “আমি নিশ্চিত। আমি তোমাকে ভালোবাসি, সত্যজিৎ। আমি তোমার সঙ্গেই থাকতে চাই সারাজীবন। আমি তোমার পাশে থাকব, যে কোনো পরিস্থিতিতে।”
সত্যজিতের মন কিছুটা শান্ত হয়। তার হৃদয় ভরে ওঠে শালিনীর প্রতি ভালোবাসায়। কিন্তু তবুও তার মনের গভীরে একটি অজানা ভয় থেকে যায়। সে ভাবে, “সমাজ কি আমাদের ভালোবাসাকে মেনে নেবে? পারিবারিক পার্থক্য কি আমাদের সম্পর্ককে ধ্বংস করবে না?”
তবুও, সেই মুহূর্তে সত্যজিৎ নিজের ভয়কে সরিয়ে রেখে শালিনীর ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। তারা দুজনই জানত, তাদের পথ সহজ হবে না। কিন্তু তারা স্থির করেছিল, ভালোবাসার এই সম্পর্ককে আগলে রাখবে, যতদিন পর্যন্ত তাদের পক্ষে সম্ভব।
এইভাবে, বন্ধুত্বের গাঢ় সম্পর্ক ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক গভীর প্রেমে, যা তাদের জীবনকে এক নতুন মোড় দেয়।
(চার)
রাজীব ধনী পরিবারের এক আদুরে সন্তান, যার জীবনে কোনো কিছুর অভাব নেই। কলেজে তার পরিচয় ছিল ক্ষমতাবান আর প্রভাবশালী ছাত্র হিসেবে। তার পোশাক, গাড়ি, আর বন্ধুদের আড্ডায় সবসময়ই একটি আলাদা গ্ল্যামার ঝলমল করত। কিন্তু এই বাহ্যিক চাকচিক্যের আড়ালে ছিল তার স্বার্থপরতা আর অহংকার।
শালিনী তার সহপাঠী। তার প্রতি রাজীবের দৃষ্টি ছিল প্রথম থেকেই। শালিনীর সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্ব তাকে মুগ্ধ করেছিল। রাজীব মনে মনে ভাবত, তার ধনসম্পদ আর প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে শালিনী একদিন তাকে ভালোবাসবেই। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।
শালিনী রাজীবকে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। সে রাজীবের অহংকারী স্বভাব আর মেকি ব্যবহার দেখেই তাকে এড়িয়ে চলত। এই উপেক্ষা রাজীবের মনে ক্রমশ রাগ আর অপমানের জন্ম দেয়। রাজীব বুঝতে পারে, শালিনী তার প্রতি আকৃষ্ট নয়, এবং এটাই তার ইগোতে বড় আঘাত করে।
একদিন রাজীব জানতে পারে, শালিনী কলেজের সাদামাটা ছেলেটি, সত্যজিতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। এটি শুনে সে প্রথমে অবাক হয়, তারপর বিরক্তি বোধ করে। তার মনে প্রশ্ন জাগে, “শালিনী একজন মেধাবী হলেও সাধারণ পরিবারের ছেলেকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছে?”
কিছুদিন পর, রাজীব লক্ষ্য করে, শালিনী আর সত্যজিৎ প্রায়ই কলেজের বাইরে দেখা করছে। তারা কখনো পার্কে বসে গল্প করছে, কখনো লাইব্রেরির কর্নারে। রাজীব বুঝতে পারে, তাদের বন্ধুত্ব হয়তো আর বন্ধুত্বের সীমায় নেই। এটি তার ক্রোধকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
“শালিনী আমাকে উপেক্ষা করে এই ছেলেটার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে? এটা মেনে নেওয়া যায় না,” রাজীব মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের এই সম্পর্ক ভাঙার জন্য কিছু একটা করতেই হবে।
একদিন রাজীব গোপনে জানতে পারে, শালিনী আর সত্যজিৎ শহরের একটি পার্কে দেখা করার পরিকল্পনা করেছে। এটাই রাজীবের জন্য ছিল সুযোগ। সে দ্রুত শালিনীর তিন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
“আপনারা জানেন, শালিনী কার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে?” রাজীব মিথ্যা উদ্দীপনা সৃষ্টি করে বলে।
“কার সঙ্গে?” ভাইয়েরা বিস্মিত হয়।
“ও একজন সাধারণ ছেলের সঙ্গে পার্কে দেখা করতে যাচ্ছে। ছেলেটা ওর পিছনে লেগে আছে। ওকে বিরক্ত করছে। আপনারা না জানলে, এভাবে শালিনীর সম্মান নষ্ট হবে,” রাজীব কৌশলে মিথ্যে গল্প ফাঁদে।
এই কথা শুনে শালিনীর ভাইয়েরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এই ব্যাপারটির শেষ দেখা হবে। তাদের ক্রোধের আগুনে ঘি ঢেলে দেয় রাজীব। সে মনে মনে খুশি হয়। তার ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে।
“সত্যজিতের সঙ্গে শালিনীর সম্পর্ককে আমি সহ্য করব না। আমি দেখাব, এই সাধারণ ছেলের জায়গা কোথায়,” রাজীব নিজের মনে ভাবতে থাকে। তার এই কৌশল কেবল শালিনীকে ফেরানোর জন্য নয়, বরং সত্যজিতের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও।
রাজীব জানত, শালিনীর ভাইয়েরা যদি সত্যজিতের ওপর চড়াও হয়, তবে শালিনী আর সত্যজিতের সম্পর্ক আর টিকবে না। এই ভেবে সে তৃপ্তি অনুভব করে। রাজীবের ষড়যন্ত্রের জাল ছড়িয়ে পড়ে, এবং তার ফলাফল শিগগিরই স্পষ্ট হবে।
(পাঁচ)
সেদিন সন্ধ্যা ছিল নিস্তব্ধ, ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভরা। জলপাইগুড়ি শহরের ছোট্ট পার্কটির একটি নির্জন কোণে সত্যজিৎ আর শালিনী বসে গল্প করছিল। তারা দুজনেই জানত, এই সম্পর্কের পথ সহজ নয়, তবুও সেই মুহূর্তে তারা একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করছিল। শালিনীর চোখে ছিল বিশ্বাস, আর সত্যজিতের চোখে স্বপ্ন।
“তুমি কি মনে করো, আমাদের ভবিষ্যৎ আছে?” শালিনী প্রশ্ন করে।
“ভালোবাসা থাকলে সবকিছু সম্ভব,” সত্যজিৎ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দেয়।
তাদের কথোপকথন তখনও চলছিল, ঠিক সেই সময় দূর থেকে ভেসে আসে ভারী বুটের আওয়াজ। সেই আওয়াজ যেন বাতাসে এক অদ্ভুত শীতলতা এনে দেয়। সত্যজিৎ পেছন ফিরে তাকায়।
সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল শালিনীর তিন ভাই। তাদের মুখে ছিল রাগের স্পষ্ট ছাপ। তাদের চেহারা আর হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, তারা শিকার ধরতে এসেছে।
“তুমি এখানে কী করছ?” তাদের একজন চিৎকার করে ওঠে। তাদের চোখ সত্যজিতের ওপর স্থির হয়, যেন তাকে ছিঁড়ে ফেলতে চায়।
সত্যজিৎ শান্ত থাকার চেষ্টা করে। সে উঠে দাঁড়ায় এবং সৎভাবে উত্তর দেয়, “আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। বিশ্বাস না হলে শালিনীর কাছেই জিজ্ঞেস করুন।”
তার কথা শুনে ভাইদের রাগ আরও বেড়ে যায়। তারা শালিনীর দিকে ঘুরে তাকায়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাই বলে, “শালিনী, এটা কি সত্যি? তুমি এই ছেলেকে ভালোবাসো?”
তিন জোড়া চোখ শালিনীর দিকে নিবদ্ধ হয়। কিন্তু শালিনী হঠাৎ যেন বদলে যায়। তার অভিজাত পরিচয়ের খোলস যেন আচমকাই তার ভেতরের বিশ্বাসকে ঢেকে ফেলে।
সে একটু থামে, তারপর বিস্ময়ের ভান করে বলে, “না, আমি তাকে ভালোবাসি না। বরং সে-ই আমাকে বিরক্ত করছিল। আমি তাকে বোঝানোর জন্য এখানে এসেছিলাম।”
এই কথা শোনার পর মুহূর্তের জন্য চারপাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। সত্যজিতের বিশ্বাসের পৃথিবী যেন মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে। তার হৃদয় ভেঙে যায় এমনভাবে, যা কোনোদিনও মেরামত সম্ভব নয়।
“শালিনী, তুমি…” সত্যজিৎ অস্পষ্ট কণ্ঠে কিছু বলতে চায়। কিন্তু তার কথা আটকে যায়। তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ে।
শালিনী তার দিকে তাকায় না। সে মুখ ফিরিয়ে সোজা চলে যায়, যেন সত্যজিতের অস্তিত্বই তার জীবনে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তার প্রতিটি পদক্ষেপ সত্যজিতের হৃদয়ে যেন এক একটি ক্ষত তৈরি করে।
সত্যজিতের অসহায় দৃষ্টি শালিনীর চলে যাওয়ার পথে স্থির হয়ে থাকে। তার মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—এত ভালোবাসার পরও কেন শালিনী এমন করল?
শালিনীর ভাইদের রাগ তখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তারা সত্যজিতের দিকে এগিয়ে যায়।
“তোর সাহস কীভাবে হলো আমাদের বোনের সঙ্গে দেখা করার?” তাদের একজন চিৎকার করে বলে।
এরপর তারা সত্যজিতের ওপর চড়াও হয়। লাথি-ঘুষিতে মাটিতে ফেলে দেয়। সত্যজিৎ কোনো প্রতিরোধ করে না। তার মন তখনও শালিনীর কথায় আটকে আছে।
“তুমি আমাকে বিরক্ত করছিলে…” শালিনীর সেই মিথ্যা কথাগুলো তার মনের ভেতর অনবরত প্রতিধ্বনি হতে থাকে।
রক্তাক্ত, আহত সত্যজিতের চোখে তখনও জল। তার আকাশচুম্বী ভালোবাসার গল্প যেন সেদিনের সেই শীতল সন্ধ্যায় চিরদিনের মতো দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়।
(ছয়)
শালিনী চলে যাওয়ার পর পার্কের সেই নির্জন কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল এক অসহায়, বিধ্বস্ত সত্যজিৎ। তার চোখের সামনে ভেঙে পড়েছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। যে শালিনী তাকে সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই শালিনীই আজ তাকে অস্বীকার করে গেল।
শালিনীর কথাগুলো তার মনে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল-“না, আমি তাকে ভালোবাসি না। সে-ই আমাকে বিরক্ত করছিল।”
সত্যজিতের হৃদয় যেন দুঃখ আর অবিশ্বাসে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল, জীবনের সব রঙ যেন ফিকে হয়ে গেছে।
শালিনীর ভাইয়েরা তার সামনে দাঁড়িয়ে রাগে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তাদের একে একে চড়াও হতে দেখে সত্যজিৎ কোনো প্রতিরোধ করার চেষ্টাও করে না। তার মনে তখন একটা গভীর শুন্যতা তৈরি হয়েছে।
“তোর সাহস কীভাবে হলো আমাদের বোনের সঙ্গে দেখা করার?” এক ভাই চিৎকার করে ওঠে।
আরেকজন বলে, “তোকে আজ শিক্ষা দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো আমাদের পরিবারের সম্মান নিয়ে খেলতে সাহস না হয়।”
তারপর শুরু হয় নির্মম অত্যাচার। ভাইয়েরা একে একে ঘুষি, লাথি মেরে সত্যজিতকে মাটিতে ফেলে দেয়। তার ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হয়, তার শরীর ব্যথায় অবশ হয়ে আসে। তবুও, সে কোনো প্রতিবাদ করে না।
সত্যজিতের মনে তখন একটাই চিন্তা -“শালিনী কেন এটা করল? যে ভালোবাসা নিয়ে আমি এত স্বপ্ন দেখেছি, সেই ভালোবাসার মানুষটাই কেন আমার পাশে দাঁড়ালো না?”
তার মনে যত না ছিল শারীরিক ব্যথা, তার চেয়ে বেশি ছিল মানসিক যন্ত্রণা। শালিনীর মিথ্যে কথাগুলো তাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছিল।
একপর্যায়ে ভাইয়েরা ক্লান্ত হয়ে থেমে যায়। তারা বলে, “এই শিক্ষা তোর জীবনে ভুলতে পারবি না। আমাদের পরিবারের সম্মান নষ্ট করার চেষ্টা আর করিস না।”
সত্যজিতের নিথর দেহ মাটিতে পড়ে থাকে। তার চারপাশের পৃথিবী যেন ঝাপসা হয়ে আসে।
(সাত)
অনেকক্ষণ পরে, পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে সত্যজিৎ। তার দেহ রক্তাক্ত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভাঙা তার মন। তার হাঁটায় ছিল এক ধরনের নিষ্প্রাণতা। শহরের রাস্তাগুলো তখন অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে। পথচারীদের কেউ তাকে দেখে মায়া বোধ করে, কেউবা অবজ্ঞা করে। কিন্তু সত্যজিতের চোখে কারও দৃষ্টি পড়ছিল না।
সে জানত না কোথায় যাবে। তার বাড়ি ছিল এক আশ্রয়, কিন্তু সেখানেও আজ সে যেতে ইচ্ছুক নয়।
“তাহলে কি ভালোবাসা মিথ্যে? যাকে আমি নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছি, সেই কি আমাকে এক মুহূর্তে ভুলে গেল?” সত্যজিৎ বারবার নিজের মনকে এই প্রশ্ন করে।
অন্যদিকে, শালিনী নিজের বাড়িতে ফিরে যায়। তার অভিজাত পরিবারের গম্ভীর পরিবেশে ঢুকে সে বাইরে থেকে স্বাভাবিক থাকার ভান করে। কিন্তু তার মনের গভীরে এক অজানা কষ্ট তাড়া করতে থাকে।
সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, “আমি ঠিক করেছি। আমার পরিবারের সম্মান আর সামাজিক অবস্থান বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সত্যজিতের মতো একজন সাধারণ ছেলের সঙ্গে জীবন কাটানোর কথা ভাবাই সম্ভব নয়।”
তবুও, তার হৃদয়ের ভেতরে একটা অন্যরকম অনুভূতি চেপে বসে। সে জানত, তার মিথ্যে কথাগুলো সত্যজিতের বিশ্বাসকে চূর্ণ করে দিয়েছে।
রাতে বিছানায় শুয়ে শালিনীর চোখে ভেসে ওঠে সত্যজিতের ভাঙা মুখ আর তার অশ্রুসিক্ত চোখ। সে বুঝতে পারে, সত্যজিৎ তাকে সত্যিই ভালোবেসেছিল।
কিন্তু ততক্ষণে সবকিছু শেষ। সমাজের নিয়ম আর ক্ষমতার প্রতিচ্ছবিতে শালিনী নিজের হৃদয়ের কষ্টকে ঢেকে ফেলে। আর সত্যজিৎ, রক্তাক্ত শরীর আর ভাঙা মন নিয়ে সেই রাতটিকে সাক্ষী রেখে হারিয়ে যায় নিজের নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে।
© পিনাকী রঞ্জন পাল