পিনাকী রঞ্জন পাল : দূর দেশের এক যাত্রী ভ্রমণ করতে করতে এক রাজ্যে এসে পৌঁছায়। সেই রাজ্য ভ্রমণকালে তার সাক্ষাৎ এই ব্যক্তির সাথে হয়, যার কাছে ভ্রমণকারী সে দেশের রাজার সম্পর্কে জানতে চায় যে তিনি কেমন?
ব্যক্তিটি জবাব দেয়, আমার মতে আমাদের রাজা খুবই বুদ্ধিমান। তবে নিষ্ঠুর।
জবাব শুনে ভ্রমণকারী বলে, ‘যদি তোমাদের রাজা বুদ্ধিমান তবে তো তিনি অবশ্যই জানবেন নিজের রাজ্যের কেন্দ্র কোথায়, আকাশে নক্ষত্রের সংখ্যা কত আর পৃথিবীর সব থেকে বুদ্ধিমান রাজা কি করে।’
সেই ব্যক্তির মনে ভ্রমণকারীর প্রশ্নগুলি নড়াচড়া করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সে রাজ দরবারে উপস্থিত হয়ে রাজার সাথে সাক্ষাৎ করে সেই তিনটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে আর তাদের উত্তর চায়।
প্রশ্নগুলি শুনে রাজা মহাসংকটে পড়ে যায়। কারণ তার কাছে প্রশ্নগুলির কোন উত্তর ছিল না। সংকটাপন্ন রাজা রাজ্যের দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত সামন্তদের ডেকে পাঠায়। সামন্তরা দরবারে উপস্থিত হলে রাজা তাদেরকে সেই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে বলে।
সামন্তদের কেউই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে সক্ষম হয় না। সামন্তদের অক্ষমতায় রাজা ক্ষেপে গিয়ে জল্লাদদের সব সামন্তদের গলা কেটে ফেলার আদেশ দেন। রাজার আদেশের বিরোধ করার কেউ ছিল না ফলে সামন্তদের নির্বিবাদে হত্যা করা হয়।
এবার মন্ত্রীদের পরীক্ষা ছিল। তাদেরকেও তিনটি প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কথা বলা হয়। তারা অনেক ভেবেও প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে অসমর্থ হলে, তাদেরকেও রাজা প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেন। দেখতে দেখতে মন্ত্রীদেরও মেরে ফেলা হয়।
এরপর ডাক পড়ে রাজগুরুর। রাজগুরু রাজার তিনটি প্রশ্নের কথা আগেই শুনেছিলেন তাই তিনি বেশ ভয়ে ভয়েই রাজদরবারে প্রবেশ করলেন। তার কাছেও রাজা সেই প্রশ্নগুলির জবাব জানতে চাইলেন।
রাজগুরু ধীরে বলেন, ‘মহারাজ, । এগুলি খুবই জটিল প্রশ্ন। এদের উত্তর খোঁজার জন্য আমাকে একটি দিন সময় দিন। কালকে আমি অবশ্যই এদের উত্তর আপনাকে দেব।’
রাজা রাজগুরুর কথা মেনে নেন। কিন্তু সেই সাথে সতর্ক করে দিতেও ভোলেন না যে কালকে এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে না পারলে তাঁকে প্রাণদন্ডে । দন্ডিত করা হবে।
রাজগুরু চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরে আসেন। তার মাথায় সামন্ত তথা মন্ত্রীদের মৃত্যুর ঘটনাবলীই ছেয়ে ছিল। তিনি চিন্তা করেন যদি আমি এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে না পারি তবে তো কালকে আমাকেও মেরে ফেলা হবে। এসব ভেবে তিনি উদাস মনে শুয়েছিলেন। এমন সময় তার ছাগলদের দেখাশোনা করা রাখাল সেখানে আসে। নিজের মালিককে চিন্তিত এবং উদাস দেখে সে জানতে চায়, ‘মালিক, আপনি উদাস কেন?
রাজগুরু বলেন, ‘আজ রাজা তার সমস্ত সামন্ত এবং মন্ত্রীদের মেরে ফেলেছে। কালকে আমার পালা।
যুবক রাখাল বলে, “মালিক আমি জানতে পারি কি যে রাজা এমনটা কেন করছেন?
-‘রাজা তিনটি প্রশ্নের উত্তর চাইছেন। প্রথম, এই রাজ্যের কেন্দ্র কোথায়? দ্বিতীয়, আকাশে কত নক্ষত্র আছে? তৃতীয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান রাজা কি করে? যদি আমি কালকে এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে না পারি তবে আমাকেও মেরে ফেলার হুকুম দেওয়া হবে।” –মালিক, আপনি চিন্তা করা ছেড়ে দিন। আপনি কালকে আমাকে রাজদরবারে নিয়ে যাবেন। আমি সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেব।’
পরের দিন রাজগুরুর সাথে তার রাখালও রাজদরবারে উপস্থিত হয়। রাজা রাজগুরুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি আমার প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন?’
রাজগুরু সহজভাবে উত্তর দিলেন, ‘মহারাজ, আপনার প্রশ্নগুলি এতোই সহজ যে এগুলির উত্তর আমার রাখালই দিতে পারবে।
এবার রাখালের পালা। সে মাথা নামিয়ে রাজার প্রতি সম্মান জানায়। রাজা জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি এই রাজ্যের কেন্দ্র বার করতে পারবে?
যুবক নিজের হাতের লাঠিটিকে মেঝেতে দাঁড় করিয়ে বললো, “এটাই হলো এই রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। আপনি মেপে দেখে নিন। এখান থেকে চারদিকের দূরত্বই সমান হবে। যদি এটা মিথ্যে হয় তবে আমার গলা কেটে ফেলবেন।’ রাজা তার উত্তরকে সঠিক মেনে নিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা বলোতো আকাশে কত নক্ষত্র আছে?”
যুবক ছাগলের লোমশ ছাল পরে ছিল। সে সেই ছাল খুলে দরবারে রাজার সামনে পেশ করে বলে, ‘মহারাজ, এই ছালে যতগুলি লোম আছে আকাশে ততগুলিই নক্ষত্র আছে। আপনি এই লোমগুলির গণনা করিয়ে নিন। যদি এমনটা না হয় তবে আপনি আমাকে মেরে ফেলুন।’
রাজার মনে হলো যুবক এবারো সঠিক উত্তর দিয়েছে। তিনি তৃতীয় তথা শেষ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, এবার তাহলে বলো পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান রাজা কি করে?
এবার চতুর রাখাল বলে, ‘মহারাজ এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না। আপনি প্রথমে আমাকে রাজকীয় মুকুটের সাথে রাজ সিংহাসনে বসাবার ব্যবস্থা করুন। আর সাথে এই ঘোষণাও করুন যে যতক্ষণ আমি সিংহাসনে বসে থাকবো; সবাই আমার আদেশ পালন করবে। তবেই আমি এর উত্তর দেব।”
রাজা তৎক্ষণাৎ নিজের ভৃত্যদের আদেশ দিলেন। রাখালকে স্নান করিয়ে তথা রাজকীয় পোষাক পরিয়ে রাজার মুকুটের সাথে সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া হয়।
সিংহাসনে বসেই যুবক জন্মাদদের ডেকে এনে আদেশ দেয়, “এই মূর্খ রাজাকে এখনই মেরে ফেল। এই রাজা শুধু মুখই নয়, অত্যাধিক ক্রুরও।’
যুবক রাজসিংহাসনে বসে ছিল। সে জন্য তার আদেশ তৎক্ষণাৎ পালন করা হয়। রাজাকে মেরে ফেলা হলো।
এরপর যুবক- রাজা রাজগুরুর সহঠাতায় সুষ্ঠুভাবে রাজা পরিচালনা করতে থাকে। প্রজাদের ওপর অত্যাচার সমাপ্ত হয়ে যায়। রাজ্যে শান্তি ফিরে আসে।