জানেন কি? ডাইনোসর থেকেও অধিক মজবুত আরশোলা

বিশেষ প্রতিবেদন, পিনাকী রঞ্জন পাল : আরশোলা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন কীট। এদের মতো অদ্ভুত কীট সম্ভবত দ্বিতীয় আর নেই। এরা ডাইনোসরদের থেকেও দৃঢ়। পা দিয়ে মারালেও এরা বেঁচে যায়। এমন কোনো জিনিস নেই যা এদের খাদ্য নয়। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এরা বিরাজমান।

আরশোলার একটি পা-কে শক্ত করে ধরে রাখুন। দেখবেন আরশোলা তার পা-টিকে শরীর থেকে ছিন্ন করে পালিয়ে যাবে। কারণ সেইস্থানে নতুন পা আবার সৃষ্টি হবে। প্রকৃতি এই বিচিত্র গুণ আরশোলাদের প্রদান করেছে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য। এরকম আরও অনেক বিচিত্র গুণের অধিকারী হলো আরশোলা।

একবার একটি স্ত্রী আরশোলার মাথা শরীর থেকে ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আরশোলাটি বিচলিত না হয়ে নিজের পথে এগিয়ে চলে আর সুরক্ষিত স্থানে পৌঁছে ডিম দেবার পরেই সে প্রাণত্যাগ করে। এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলেন, মাথা কাটা আরশোলা মাথা কেটে যাবার জন্য মরে না, খেতে না পেরে সে মারা যায়।

নিজেকে বাঁচাবার এমন সব গুণ আরশোলার আছে যে পৃথিবীতে পরমাণু যুদ্ধ বাঁধলেও তারা বেঁচে থাকবে। আর সম্ভবত তাদের সঙ্গ দেবার জন্য ইঁদুররাও বেঁচে থাকবে। বিজ্ঞানীরা বলেন, আরশোলার ক্ষুদ্র শরীর বিশালাকায় ডাইনোসরদের তুলনায় ৩২ গুণ বেশি। মজবুত। এছাড়াও আরশোলারা নিজেদের শরীরকে আশ্চর্যজনকভাবে সংকুচিত করতে পারে। এইজন্য এরা সরু থেকে সরু ফাটলেও ঢুকে যেতে পারে, যেখানে কোনো শত্রুর পক্ষে ঢোকা অসম্ভব। সংকুচিত আরশোলাকে যদি আপনি জুতো দিয়ে মাড়িয়ে যান, তবুও সে প্রাণে বেঁচে যাবে। বিপদের সময় এক ধরনের আরশোলা সংকুচিত হয়ে এমন গোল হয়ে যায় যে দেখে মনে হয়। কোনো গোলাকার বস্তু পড়ে রয়েছে।

কিন্তু যদি শব্দের সাথে আরশোলা মোকাবিলা করতে বাধ্য হয়, তবে শত্রুর সাথে মোকাবিলা করার জন্য তাদের অনেক কৌশল রয়েছে। কিছু আরশোলা সংঘর্ষের সময় এমন রসায়ন উগড়ে দেয় যে শত্রু জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ফ্লোরিডার আরশোলা শত্রুর ওপর এমন দ্রব্য উৎক্ষেপ করে যাতে জ্বালাবোধ হয়। ম্যাডিরা আরশোলা আক্রমণ হলেই এমন দুর্গন্ধ বার করে যে বড়-বড়রাও পালিয়ে পথ পায় না। ম্যাডাগাস্করের বিশালাকার আরশোলা বিপদের আভাস পেতেই নিজের পেট ফোলাতে থাকে আর শত্রু সামনে এলেই ভয়ঙ্কর শব্দে ফুৎকার করে যে শত্রু পালিয়ে যায়।

পৃথিবীর কোনো স্থানে আরশোলারা নেই ? শুধুমাত্র আন্টার্কটিকা ছাড়া সম্পূর্ণ পৃথিবীতে রাজত্ব করছে আরশোলারা। অবশ্য সমস্ত কিছুকে জমিয়ে দেওয়া আন্টার্কটিকায় আরশোলারা তিনদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। সর্বত্রই বসবাসের পিছনে এদের রহস্য হলো যে এরা সব কিছুই হজম করতে সক্ষম। তাদের ‘মেনু কার্ডে” এমন সব জিনিস রয়েছে যেগুলির কথা আপনারা ভাবতেও পারবেন না। যেমন—সাবান, দেওয়ালে সাঁটানো কাগজ, রঙ, ডাকটিকিট লাগানো আঠা, কাপড়, পুস্তকের বাঁধানো মলাট, টিভির ভেতরের তার; কি নয়। এছাড়াও আমরা যা খাই সেগুলোও তাদের পছন্দের মধ্যে রয়েছে। নদী-নালায় বসবাসকারী আরশোলারা সেখান থেকেই তাদের আহারের ব্যবস্থা করে থাকে।

এতসব সত্ত্বেও যদি কখনো না খেতে পেয়ে মরবার উপক্রম হয় তবে তারা নিজেদের ভাই-বন্ধুদের গিলতে শুরু করে। শেষ সাথীকে খাবার পরেও যদি শীঘ্রই আহারের কোনো ব্যবস্থার সম্ভাবনা না দেখা যায় তবে সে নিজের জীবন এমনভাবে কাটায় যে তিন মাস পর্যন্ত না খেয়েও বেঁচে থাকতে পারে। এই দীর্ঘসময়ে কিছু না কিছু তো খাবার জন্য মিলেই যায়। আর আরশোলার জীবন পুনরায় দৌড়তে থাকে।

এদের বংশবৃদ্ধিও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এক জোড়া জার্মান আরশোলা এক বছরে চল্লিশ হাজার সন্তানের জন্ম দেয়। এরাই দূরে দূরে ছড়িয়ে আরশোলাদের সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করতে থাকে।

আরশোলা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন কীট। প্রায় ৩৫ কোটি সাল ধরে তারা এই পৃথিবীর বুকে রয়েছে। এরা নিজের চোখে বিশালাকায় ডাইনোসরদের জন্ম নিতে, পৃথিবীতে রাজত্ব করতে আর তারপর লুপ্ত হতে দেখেছে। যখন আমাদের পূর্বপুরুষরা ওহাতে আশ্রয় নিয়েছিল, আরশোলারাও সেখানে উপস্থিত ছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, আরশোলা আজকের হাজার হাজার কীটের পূর্বপুরুষ। আশ্চর্যের কথা হলো যে এই কোটি কোটি বছরেও আরশোলাদের মধ্যে নামমাত্র পরিবর্তন হয়েছে। শুধু এদের আকার কমেছে। আগে আরশোলাদের পাখা ১০-১২ সেমি দীর্ঘ ছিল, যা বর্তমানে কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। আকারে ছোট হবার পাশাপাশি এদের রঙ-রূপেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আরশোলা মাটিতে গর্ত করে বাস করে। নাম ‘ম্যাক্রো প্যানোস্থিয়া রাইনোসেরস্’। অস্ট্রেলিয়ার উত্তর ভাগে এদের দেখা যায়। এই প্রজাতির একটি স্ত্রী আরশোলা ৭৯ মিলিমিটার দীর্ঘ আর ৩৫ মিলিমিটার চওড়া পর্যন্ত পাওয়া গেছে। আর এর ওজন ছিল প্রায় ২২ । গ্রাম। তবে সাধারণত ঘরে বসবাসকারী জার্মান আরশোলা মাত্র আধা ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। এদের রঙ হলুদ-খয়েরি হয়। কিন্তু গাছে থাকা কিছু আরশোলা পাতার মতো সবুজ রঙয়েরও হয়।

আজ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০০-এর বেশি প্রজাতির আরশোলার সন্ধান পাওয়া গেছে। আর এদের নামকরণ করা হয়েছে তাদের ‘নাগরিকতা’ অনুসারে। যেমন আমেরিকান আরশোলা, রাশিয়ান আরশোলা, জার্মান আরশোলা প্রভৃতি। কিন্তু বলেটেলা ওরিয়েন্টিলিস নামের ওরিয়েন্টল আরশোলা প্রায় সারা পৃথিবীতে দেখা যায়। আরশোলাদের -মধ্যে মাত্র ১০-১২ ধরনের আরশোলা ঘরে বসবাস করে। বাকিরা নদী-নালা, জঙ্গল, ওহা. গাছের কোটরের মতো অন্ধকার স্থানে থাকতে পছন্দ করে।

আরশোলার শরীরের গঠনেও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন, এদের শরীরের সবচেয়ে বাইরের স্তর অর্থাৎ ক্যুটিকিল মোম আর তেলের পুরু স্তর দিয়ে তৈরি। এটা তাদেরকে মজবুত করার পাশাপাশি শরীরের জল বেরিয়ে যাওয়াকেও বন্ধ করে। উল্লেখ্য, আরশোলাদের শরীরে তিন-চতুর্থাংশ জল থাকে। কিছু রসায়ন এই মোমের কবচকে নষ্ট করে দিতে পারে, যার ফলে অধিক জল বেরিয়ে গিয়ে আরশোলা মারা যায়।

আসন্ন বিপদের হাত থেকে বাঁচার এ জন্য প্রকৃতি আরশোলাদের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। আরশোলাদের মাথা থেকে দু’টি লম্বা ‘অ্যান্টীনা’ বার হয়। এগুলি বাতাসে ঘটা সামান্যতম আন্দোলনকে অনুমান করে নেয়। এক সেকেণ্ডের কুড়ি ভাগেরও কম সময়ে আসন্ন বিপদের সংবাদ আরশোলার মাথায় পৌঁছে যায়। আর ও তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে সরে পড়ে।

স্ত্রী আরশোলা একটি ছোট থলিতে ডিম পেড়ে তাকে সুরক্ষিত স্থানে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু স্ত্রী জার্মান আরশোলা এই থলিকে নিজের শরীরের সাথে। সেঁটে ঘুরে বেড়ায়। বাচ্চা বার হবার এক-দুইদিন পূর্বে এটাকে শরীর থেকে আলাদা করে। আরশোলার বাচ্চারা রঙ রূপে তাদের মা-বাবার মতোই দেখতে হয়, শুধু আকারে ছোট হয়। তাদের বড় হতে প্রচুর সময় লাগে। আমেরিকান আরশোলাদের বাচ্চারা দীর্ঘ এক বছর পরে বয়স্ক হয়ে থাকে।

দীঘদিন থেকেই আরশোলাদের কাবু করতে মানবরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সব বেকার। কীটনাশক ওষুধের সাহায্যে কিছু আরশোলাকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা সম্ভব হলেও এদের প্রাবল্যকে থামানো আজও এক নোংরা করা আর দুর্গন্ধ ছড়ানো ছাড়াও অনেক ধরনের রোগের বিস্তারে আরশোলার হাত রয়েছে। এরা নানাপ্রকার এলার্জি ছড়াতে পারে। এদের নোংরা শরীরে টাইফয়েড আর কুন্ঠ। রোগের জীবাণু আস্তানা নিয়ে থাকে। ‘ফুট পয়জনিং’-এর পেছনেও এদের হাত রয়েছে। এরা অজ্ঞাতেই কিছু পরজীবী কীটের ডিমও বহন করে থাকে।

এ সমস্ত অপকীর্তি সত্ত্বেও বিজ্ঞানীদের উপযুক্ত সাহায্যকারী হিসাবে আরশোলা স্বীকৃত। Nutrition, Heredity আর ক্যান্সারের মতো রোগে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে আরশোলাদের ওপরে পরীক্ষা চালায়। এদের পালন করতে কোনোরকম অসুবিধা নেই। অল্প জায়গাতেই আর খাবারের কোনো বিশেষ ব্যবস্থা না করেই এদের পালন করা যায়। এছাড়াও এরা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। এদের কোনো রোগ আক্রমণ করে না। সার্জারী করার পরেও এরা বেঁচে থাকে। কিন্তু এই মিত্রদের শত্রুতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া বড়ই কঠিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *