শারদোৎসবে রঙিন জলপাইগুড়ি : ঐতিহ্য ও থিমে জমজমাট মহা অষ্টমী

জলপাইগুড়ি : শরতের আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, চারিদিকে কাশফুলের দোলা। তারই মাঝে মহা অষ্টমীর দিনে শারদোৎসবের আবহে রঙিন হয়ে উঠেছে জলপাইগুড়ি শহর। সকাল থেকেই পূজো মণ্ডপে ভক্তদের ভিড়, ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভরে উঠছে বাতাস, ঢাকের বাদ্যে মুখর চারপাশ। শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহে এক হয়ে উঠেছে এই উৎসব। শহরের নানা প্রান্তে ঐতিহ্য, থিম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মেলবন্ধনে দুর্গাপূজা উদযাপন হচ্ছে এক অনন্য মহিমায়।

পান্ডাপাড়া শেষবাতি সার্বজনীন দুর্গাপূজা : ৬৯ বছরে ভক্তির আবহ

পান্ডাপাড়া শেষবাতি সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটি এ বছর পদার্পণ করল ৬৯তম বর্ষে। মহা অষ্টমীর দিন সকাল থেকেই এখানে ভক্তদের ঢল নামে। নিয়ম মেনে অঞ্জলি, পূজা-পাঠ ও দেবী আরাধনায় মুখর হয়ে ওঠে পরিবেশ। স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি বাইরের বহু দর্শনার্থীও ভিড় জমিয়েছেন প্রতিমা দর্শনে। সাদামাটা আয়োজন হলেও ভক্তিমূলক পরিবেশ আর আন্তরিকতায় এই পূজো পেয়েছে আলাদা মাত্রা। আশেপাশের এলাকার মানুষের কাছে এটি কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং মিলনমেলার আসর।

বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ীর ঐতিহ্য : ৫১৬ বছরের অমলিন ধারাবাহিকতা

জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ীর দুর্গোৎসব এ বছর পদার্পণ করেছে ৫১৬তম বর্ষে। এত দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকা এই পূজো উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক গর্ব। এখানে নেই তেমন বাহুল্য বা জাঁকজমক, তবে আছে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য ও আভিজাত্যের ছাপ। মহা অষ্টমীর দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিপুল ভিড় জমে রাজবাড়ী প্রাঙ্গণে। দূরদূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা রাজবাড়ীর এই পূজা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এই ধারাবাহিকতা আজও প্রমাণ করে, দুর্গোৎসব শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়—এটি সামাজিক মিলনের এক ঐতিহাসিক প্রতীক।

পান্ডাপাড়া সার্বজনীন দুর্গাপূজা : অভিনব থিম ‘মৃত্তিকায় অনন্তা’

শহরের অন্যতম আকর্ষণ পান্ডাপাড়া সার্বজনীন দুর্গাপূজা এ বছর পদার্পণ করেছে ৯৭তম বর্ষে। প্রতি বছর অভিনব থিমের মাধ্যমে দর্শকদের চমক দেয় এই পূজো। এবারের থিম “মৃত্তিকায় অনন্তা”। বাঁশ, কাঠ ও মাটির পুতুল দিয়ে সজ্জিত হয়েছে পূজামণ্ডপ। প্রতিমাতেও আনা হয়েছে অভিনবত্ব, যা থিমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

সন্ধ্যা নামতেই আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ভক্ত-দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় জমে প্রতিদিন। ঢাকের বাদ্যি, ধূপের গন্ধ, আর দেবী আরাধনার মন্ত্রোচ্চারণে পরিবেশ হয়ে ওঠে একেবারে ভক্তিমুখর। পুজো উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, তাদের এই অভিনব উদ্যোগ শহরবাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শুধু শিল্পকলা নয়, আবেগ ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধনই তাদের সাফল্যের মূলমন্ত্র।

দেশবন্ধুপাড়া তেইশ পল্লী : সামাজিক দায়িত্ববোধের অনন্য উদাহরণ

দুর্গাপূজা মানেই শুধু আনন্দ-উল্লাস নয়, সামাজিক দায়িত্ববোধও এর একটি বড়ো অংশ। শহরের দেশবন্ধুপাড়া তেইশ পল্লী সর্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটি প্রতিবছরই বস্ত্রদান ও ভোজের আয়োজন করে থাকে। এ বছরও সপ্তমীর দিনে অসংখ্য মানুষকে নতুন বস্ত্র প্রদান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দুপুরে পরিবেশন করা হয় খিচুড়ি, লাবড়া ও মিষ্টি।

পূজা কমিটির সদস্যদের কথায়, “আমাদের কাছে দুর্গাপূজা মানে শুধু প্রতিমা দর্শন বা সজ্জা নয়, মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সমাজের অবহেলিত মানুষদের মুখে হাসি ফোটানোই আমাদের সত্যিকারের পূজা।” দুপুর থেকেই বহু মানুষ ভিড় জমিয়ে বস্ত্র ও আহার গ্রহণ করেন। উৎসবের দিনে এই উদ্যোগ সমাজে এক ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেয়।

বাবুপাড়া সর্বজনীন দুর্গাপূজা : থিম ‘মিলন মাঝে উৎকল বঙ্গ’

জলপাইগুড়ির বাবুপাড়ার দুর্গাপূজা শহরের এক ঐতিহ্যপূর্ণ পূজা। এ বছর তাদের বিশেষ থিম “মিলন মাঝে উৎকল বঙ্গ”। বাংলা ও ওড়িশার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটানোই এই থিমের উদ্দেশ্য। পূজামণ্ডপটি তৈরি হয়েছে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে। প্রতিমায় ফুটে উঠেছে ওড়িশার ঐতিহ্যবাহী ওড়িসী নৃত্যের প্রতিরূপ।

প্রতিদিন এখানে বিপুল সংখ্যক ভক্ত ও দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। পূজা কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুজোর প্রতিদিনই খিচুড়ি প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছে। থিম, শিল্পকলা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মেলবন্ধনে বাবুপাড়ার পুজো শহরবাসীর কাছে বিশেষভাবে প্রশংসিত।

জলপাইগুড়ির অলি-গলিতে এখন উৎসবের আবহ। সন্ধ্যা নামলেই আলোর ঝলকে সেজে ওঠে শহর। একদিকে রাজবাড়ীর ঐতিহ্যবাহী পূজা, অন্যদিকে থিম-ভিত্তিক আধুনিক পূজা—সব মিলিয়ে শহরে যেন একসঙ্গে মিশে গেছে অতীত ও বর্তমান। ভক্তি, শিল্প, সংস্কৃতি ও সামাজিক দায়বদ্ধতা মিলিয়ে দুর্গোৎসব এখানে হয়ে উঠেছে সর্বজনীন আনন্দোৎসব।

বৃদ্ধ থেকে শিশু, নারী থেকে পুরুষ—সবাই সমানভাবে উপভোগ করছেন এই উৎসব। পূজোমণ্ডপে ঢাকের তালে তালে ধুনুচি নাচ, আলো-সজ্জা, থিমের অভিনবত্ব ও প্রতিমার সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের মনে দাগ কাটছে।

মহা অষ্টমীর দিনে জলপাইগুড়ি যেন নিজেকে নতুন করে চিনিয়ে দিল। একদিকে শতবর্ষের বেশি পুরনো ঐতিহ্যবাহী পূজা, অন্যদিকে অভিনব থিম ও সামাজিক উদ্যোগে ভরপুর নতুন প্রজন্মের ভাবনা। সব মিলিয়ে শারদোৎসব এখানে হয়ে উঠেছে ভক্তি, ঐতিহ্য, শিল্প ও মানবিকতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

জলপাইগুড়িবাসীর কাছে দুর্গাপূজা শুধুই দেবী আরাধনা নয়—এটি এক সামাজিক উৎসব, মিলনের মঞ্চ, আর মানুষের আবেগের এক অনন্য প্রকাশ। তাই পূজার এই আবহ প্রতি বছরই শহরকে করে তোলে রঙিন, উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *