পিনাকী রঞ্জন পাল : একজন খেলোয়াড় কি শুধু ব্যাট-বলের লড়াই নিয়েই বাঁচেন? নাকি তার মানসিক সুস্থতা, পরিবারের উষ্ণতা, প্রিয়জনের সাহচর্যও সমান জরুরি? তাহলে বিদেশ সফরে ক্রিকেটারদের পরিবার সঙ্গে থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা কেন? এটা কি পারফরম্যান্স বাড়াবে, নাকি মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে দেবে?
BCCI যখন বিদেশ সফরে ক্রিকেটারদের পরিবারের উপস্থিতির ওপর কড়াকড়ি নিয়ম চালু করল, তখন অনেকেই চুপ ছিলেন। কিন্তু বিরাট কোহলি চুপ থাকেননি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার পর তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুললেন বোর্ডের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে। তার বক্তব্য – একজন খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্সের সঙ্গে তার মানসিক সুস্থতা ও পরিবারের উপস্থিতি গভীরভাবে জড়িত।
কিন্তু বোর্ড কি সত্যিই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে? নাকি তারা দলের সাফল্যের কথা ভেবেই এই কঠোর নিয়ম চালু করেছে? আসুন, খতিয়ে দেখা যাক এই বিতর্কের পেছনের গল্প।
বিসিসিআই-এর সিদ্ধান্ত: কেন এই কড়াকড়ি?
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতের সাম্প্রতিক ব্যর্থতার পর বিসিসিআই একটি বড় সিদ্ধান্ত নেয়- এখন থেকে বিদেশ সফরে ক্রিকেটাররা তাদের পরিবারকে সঙ্গে রাখতে পারবেন না। যদি সফরের দৈর্ঘ্য ৪৫ দিনের বেশি হয়, তবে বোর্ডের অনুমতি নিয়ে মাত্র ১৪ দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকতে পারবেন খেলোয়াড়েরা।
বোর্ডের ব্যাখ্যা, খেলোয়াড়দের মূল ফোকাস থাকা উচিত পারফরম্যান্সের ওপর। পরিবারের উপস্থিতি অনেক সময় মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে। তাছাড়া, পারিবারিক ঝামেলা বা আবেগপ্রবণ মুহূর্ত ক্রিকেটারদের খেলায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ক্রিকেটবিশ্ব। একপক্ষ বলছে, খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত জীবন ও মানসিক স্বস্তি বোঝার জায়গায় নেই বোর্ড। আবার অন্যপক্ষ মনে করছে, এই নিয়মই দলের জন্য ভালো হবে।
কোহলির কড়া ভাষায় বিরোধিতা
বিরাট কোহলি বরাবরই তার মতামত স্পষ্টভাবে জানান। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর এক অনুষ্ঠানে তিনি বিসিসিআই-এর সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন।
তার কথায়, “পরিবার মানসিক শক্তির উৎস। কঠিন ম্যাচের পর, মানসিক চাপের মুহূর্তে পরিবারের উষ্ণতা একজন খেলোয়াড়কে স্বাভাবিক থাকতে সাহায্য করে। যারা এই নিয়ম করেছে, তারা কি সত্যিই বোঝে পরিবারের মূল্য?”
তিনি আরও বলেন, “পারফরম্যান্স খারাপ হলে দায় দেওয়া হয় পরিবারের উপস্থিতিকে। তাহলে অবিবাহিত খেলোয়াড়রা কি সবসময় দুর্দান্ত পারফর্ম করে? ক্রিকেট মানসিক ও শারীরিক দুই ধরণের ধকলের খেলা। সেখানে পরিবার যদি মানসিক শক্তি জোগায়, তাহলে তাকে বাদ দেওয়া হবে কেন?”
বিরাটের এই বক্তব্যের পর বিতর্ক আরও তীব্র হয়েছে। অনেক প্রাক্তন ক্রিকেটার তার পাশে দাঁড়িয়েছেন।
কোন যুক্তি বেশি শক্তিশালী?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—বিসিসিআই-এর যুক্তি বেশি বাস্তবসম্মত, নাকি বিরাট কোহলির?
বোর্ডের যুক্তি : ক্রিকেটারদের মূল দায়িত্ব খেলা, ব্যক্তিগত জীবন নয়। পারিবারিক উপস্থিতি মনোযোগ সরিয়ে দিতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, সফরে পরিবারের সঙ্গে থাকলে কিছু খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সে তারতম্য দেখা গেছে।
বিরাট ও তার সমর্থকদের যুক্তি : ক্রিকেট মানসিক ও শারীরিকভাবে কঠিন খেলা। পরিবার একজন খেলোয়াড়কে মানসিকভাবে শক্ত রাখে। শুধু পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে পরিবারের উপস্থিতিকে দোষ দেওয়া ঠিক নয়। অন্য অনেক খেলায়ও খেলোয়াড়রা পরিবার নিয়ে সফর করেন, সেখানে কোনো সমস্যা হয় না।
শেষ পর্যন্ত কে ঠিক?
এই বিতর্কের একক কোনো উত্তর নেই। ক্রিকেটের মূল লক্ষ্য হল পারফরম্যান্স, কিন্তু খেলোয়াড়দের মানসিক সুস্থতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো সবচেয়ে ভালো সমাধান হতে পারে একটি ফ্লেক্সিবল নীতি—যেখানে কড়া নিষেধাজ্ঞার বদলে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিরাটের বক্তব্য বোর্ডের নিয়মে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে কিনা, তা এখনই বলা কঠিন। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—এই বিতর্ক ক্রিকেটবিশ্বে আরও বহুদিন চলবে।
এখন আপনিই বলুন—পরিবার না পারফরম্যান্স, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?