Cricket : রাচিন রবীন্দ্র – এক নতুন ক্রিকেটীয় বিস্ময়ের গল্প

পিনাকী রঞ্জন পাল : ক্রিকেট ইতিহাসে কিছু নাম থাকে, যারা শুধুমাত্র পারফরম্যান্সের জন্য নয়, বরং তাদের লড়াই, অধ্যবসায় আর ধৈর্যের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকে। রাচিন রবীন্দ্র ঠিক তেমনই এক নাম—এক যোদ্ধার গল্প, যিনি শুধু নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট নয়, বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন।

রাচিন রবীন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছেন নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে, কিন্তু তার শিকড় ভারতের বেঙ্গালুরুতে। তার বাবা রবি রবীন্দ্র শচীন টেন্ডুলকার ও রাহুল দ্রাবিড়ের বিশাল ভক্ত ছিলেন। তাই ছেলের নাম রেখেছিলেন “রাচিন”—রাহুলের ‘রা’ ও শচীনের ‘চিন’ থেকে নেওয়া। হয়তো তখনই ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল—এই ছেলেটি একদিন ক্রিকেট বিশ্বে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখবে।

শৈশব থেকেই ক্রিকেট ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। মাত্র ৫ বছর বয়সে হাতে ব্যাট তুলে নেওয়া থেকে শুরু করে ১০ বছর বয়সেই স্থানীয় কোচদের নজরে আসা—তার প্রতিভার বিকাশ অবিশ্বাস্য গতিতে হচ্ছিল। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট কাঠামোর মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অসাধারণ ক্রিকেটীয় দক্ষতা।

ক্রিকেটে সফল হওয়া কখনোই সহজ নয়। নিউজিল্যান্ড দলে অলরাউন্ডারের অভাব ছিল না, ফলে রাচিনের জন্য সিনিয়র দলে জায়গা পাওয়া সহজ ছিল না। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। ভারতের উপমহাদেশীয় কন্ডিশনে মানিয়ে নিতে তিনি বারবার ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়ে কঠোর অনুশীলন করেছেন। স্পিন বল মোকাবেলা করা শিখেছেন, উইকেটের চরিত্র বুঝেছেন, আর ধৈর্য ধরে নিজেকে তৈরি করেছেন।

২০২১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়, এরপর একই বছরে ভারতের বিপক্ষে টেস্টেও সুযোগ পান। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তার উত্থান ঘটে ২০২৩ সালের বিশ্বকাপে।

২০২৩ বিশ্বকাপের দলে রাচিন ছিলেন অনেকের চোখে একজন সাধারণ স্কোয়াড সদস্য। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করে তিনি বুঝিয়ে দিলেন—এটি কেবল শুরু! এরপর আরও দুটি শতকসহ পুরো বিশ্বকাপে ৫৭৮ রান করে ক্রিকেটবিশ্বকে চমকে দিলেন। তার ব্যাট যেন থামতেই চাইছিল না!

বিশ্বকাপে নজরকাড়া পারফরম্যান্সের সুবাদে তিনি আইসিসির বর্ষসেরা উদীয়মান ক্রিকেটার নির্বাচিত হন। কিন্তু রাচিনের যাত্রা এখানেই থেমে থাকেনি।

২০২৫ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও রাচিন নিজের সামর্থ্য দেখিয়েছেন। মাত্র ১৩টি আইসিসি টুর্নামেন্ট ম্যাচ খেলেই ৫টি শতরান! এমন রেকর্ডের মালিক হতে গেলে শুধু প্রতিভা নয়, প্রয়োজন আত্মনিবেদন ও কঠোর পরিশ্রম। ফাইনালের আগেই তিনি দুটি শতরান করেছিলেন, আর ফাইনালেও ব্যাট হাতে ৩৭ রান করে কিউইদের জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন। যদিও কুলদীপ যাদবের গুগলি তাকে বিভ্রান্ত করেছিল, কিন্তু তার লড়াই এখানেই শেষ হয়নি।

বল হাতেও ফাইনালে ১০ ওভারে ৪৭ রান দিয়ে ১ উইকেট তুলে নেন। যদিও তার দল জয় পায়নি, তবু তিনি নিজের অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হন।

রাচিন রবীন্দ্রর গল্প শুধু ক্রিকেটীয় কৌশল আর রেকর্ডের নয়, এটি একজন লড়াকু ক্রিকেটারের গল্প। যিনি ভারতীয় শিকড় থেকে উঠে এসে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন, কঠোর পরিশ্রমে নিজের জায়গা তৈরি করেছেন, এবং বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের আলাদা পরিচয় গড়ে তুলেছেন।

তার এই পথচলা প্রতিটি তরুণ ক্রিকেটারের জন্য এক অনুপ্রেরণা—সফলতা শুধু প্রতিভা নয়, বরং অধ্যবসায় ও আত্মনিবেদনের ফসল। হয়তো সামনে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে, কিন্তু একথা নিশ্চিত বলা যায়—রাচিন রবীন্দ্র নামটি ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *