Cricket : “নীরব যোদ্ধা’- লোকেশ রাহুলের উত্তরণের গল্প

“সবাই যখন আলোয় মেতে ওঠে, কেউ কেউ থেকে যায় ছায়ায়। তবে ছায়াই একদিন আলো হয়ে ওঠে।”

পিনাকী রঞ্জন পাল : লোকেশ রাহুল—একটি নাম, একটি অধ্যায়, এক নীরব যোদ্ধার গল্প। ভারতীয় ক্রিকেটে তার অবদান হয়তো লাইমলাইট কাড়েনি, কিন্তু যখনই দলকে প্রয়োজন হয়েছে, তিনি থেকেছেন অবিচল, দৃঢ়, দায়িত্বশীল। নিজের স্টাইলের জৌলুসে নয়, বরং ধৈর্য, ত্যাগ ও পরিশ্রমের নিদর্শন রেখে তিনি প্রমাণ করেছেন, তার মতো ক্রিকেটাররাই দলের আসল ভিত।

বেঙ্গালুরুর এক সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা রাহুল দ্রাবিড়ের মতোই আরেক রাহুল, লোকেশ রাহুল, স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতের জার্সিতে খেলার। তবে সেই স্বপ্ন সহজে বাস্তবায়িত হয়নি। যখনই নিজের জায়গা পাকা করতে গিয়েছেন, তখনই বাধা এসেছে চোট-আঘাতের, পারফরম্যান্সের ওঠানামার, এমনকি দলীয় রাজনীতির। কিন্তু রাহুল জানতেন, পরিশ্রমের বিকল্প নেই।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সময় গৌতম গম্ভীর যখন বলেছিলেন, “আমার প্রথম পছন্দ কে এল রাহুল”, তখন অনেকে তা ভালোভাবে নেননি। অনেকেই ভেবেছিলেন, ঋষভ পন্থের মতো সুপারস্টারের ওপর কেন ভরসা রাখলেন না গম্ভীর? কিন্তু দিনের শেষে প্রমাণ হলো, কোচের এই আত্মবিশ্বাস আসলে রাহুলের পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর ধৈর্যের ফসল।

পুরো টুর্নামেন্টে রাহুল ছিলেন ভারতীয় দলের আসল ফিনিশার। পাঁচ ম্যাচের মধ্যে তিনটিতেই অপরাজিত থেকে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছেন। ফাইনালে যখন একের পর এক উইকেট পড়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি ছিলেন সেই শেষ ভরসা, যিনি ক্রিজ আঁকড়ে ধরে ভারতকে বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন।

রাহুলের গল্প শুধু ব্যাটিং বা উইকেটকিপিং দক্ষতার নয়, বরং নিজেকে বদলে নেওয়ার এক কঠিন লড়াইয়েরও। একসময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তিনি স্লো স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেন, বড় মঞ্চে স্নায়ুচাপ ধরে রাখতে পারেন না। লখনউ সুপারজায়ান্টসের হয়ে খেলার সময় এক ম্যাচের পর ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক প্রকাশ্যে তাকে অপমান করেছিলেন। তখন হয়তো অনেকে ভেবেছিলেন, রাহুল শেষ। কিন্তু তিনি মুখে কিছু না বলে ব্যাট দিয়ে জবাব দিতে চেয়েছিলেন।

২০২৭ সালের বিশ্বকাপ যখন ভারতের সামনে, তখন নতুন নেতৃত্বের সন্ধান চলছে। বুমরাকে হয়তো অধিনায়ক ভাবা হবে, কিন্তু তার ডেপুটি কে হবেন? গিল নাকি রাহুল? চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যে ম্যাচ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা রাহুল দেখিয়েছেন, তা তাকে ভবিষ্যতের সহ-অধিনায়ক হিসেবে আরও এগিয়ে রাখবে।

লোকেশ রাহুল হয়তো বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা কিংবা সূর্যকুমার যাদবের মতো লাইমলাইটে থাকেন না। তার ব্যাটিং হয়তো ঝড় তোলে না, কিন্তু দলের জন্য মূল্যবান ইনিংস খেলেন তিনি। বাংলাদেশ ম্যাচে ৪১ রানে অপরাজিত, সেমিফাইনালে ৪২, ফাইনালে ৩৪—সংখ্যাগুলো হয়তো বড় নয়, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় এগুলো ছিল শ্বাসরুদ্ধকর ইনিংস।

একজন প্রকৃত খেলোয়াড় শুধু নিজের স্টাইলেই খেলেন না, তিনি দলের প্রয়োজন বুঝে খেলে যান। লোকেশ রাহুল তেমনই এক নীরব নায়ক, যিনি হয়তো প্রচারের আলোয় আসেন না, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তার নাম লেখা থাকে সোনার হরফে।

ক্রিকেটে অনেক তারকার উত্থান-পতন হয়, কিন্তু কিছু কিছু খেলোয়াড় থাকেন, যারা ধীরে ধীরে নিজেদের জায়গা পাকা করেন, দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলেন। রাহুল সেই ক্যাটাগরির ক্রিকেটার, যিনি আলোর থেকে ছায়ায় বেশি স্বচ্ছন্দ। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এমন নীরব যোদ্ধারাই একদিন দলের সবচেয়ে বড় সম্পদ হয়ে ওঠেন।

আজ যখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বিজয় উদযাপন চলছে, তখন রাহুল আবারও নিশ্চুপ, সবার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, সামান্য হাসছেন। বাহ্যিক উচ্ছ্বাস নেই, কিন্তু তার চোখে লেখা রয়েছে এক অদম্য জেদ—আগামী বিশ্বকাপে তিনিই হবেন ভারতের অন্যতম ভরসা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *