পিনাকী রঞ্জন পাল : “উঁচু শিখরে পৌঁছানোর স্বপ্ন পূরণ করতে কখনও প্রতিভা একা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রম এবং নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস।” উমর নাজির মীর এই কথার জীবন্ত উদাহরণ। জম্মু-কাশ্মীরের পুলোয়ামা জেলার ছোট্ট গ্রাম মালিকপুরার এই ছেলেটি আজ দেশজুড়ে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তার উচ্চতা, দক্ষতা এবং আত্মনিবেদন তাকে ঘরোয়া ক্রিকেটে একটি অনন্য স্থান এনে দিয়েছে।
পুলোয়ামার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় হওয়া উমরের জন্য ক্রিকেট খেলা ছিল একটি কঠিন স্বপ্ন। মালিকপুরার ছোট্ট গ্রামে বেড়ে ওঠা এই ছেলেটি প্রাথমিকভাবে নিজের গ্রামে থাকা সামান্য সুযোগ-সুবিধার মধ্যেই নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করে। কোনও আধুনিক কোচিং সেন্টার বা চমৎকার মাঠের সুযোগ ছিল না তার। তবুও, এই সীমাবদ্ধতা কখনও তাকে থামাতে পারেনি।
জীবনের প্রথম ধাপেই উমর বুঝেছিলেন, নিজের উচ্চতা (৬ ফুট ৪ ইঞ্চি) এবং বলের সুইং করানোর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারেন। ধীরে ধীরে তিনি জম্মু-কাশ্মীর দলে জায়গা করে নেন এবং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের প্রতিভার প্রদর্শন শুরু করেন।
২০২৪-২৫ রঞ্জি ট্রফির মুম্বাইয়ের বিপক্ষে জম্মু-কাশ্মীরের ম্যাচে উমর নাজির তার প্রতিভার অনন্য প্রদর্শন করেন। তার বোলিংয়ের সামনে ভারতের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মা, অজিঙ্কে রাহানে এবং শিবম দুবে পুরোপুরি নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন। এই ম্যাচে তার পরিসংখ্যান ছিল ৪/৪১। তবে রোহিত শর্মার উইকেট নেওয়ার পরেও উমর কোনও উল্লাস দেখাননি। যখন সাংবাদিকরা তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন, উমরের উত্তর ছিল আরও অনুপ্রেরণামূলক:
“উচ্ছ্বাস কীভাবে দেখাই? আমি যে রোহিত শর্মার ভক্ত। উনার উইকেট নেওয়া আমার কাছে জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত।”
উমরের এই বিনয় এবং নিজের কাজের প্রতি একাগ্রতা তাকে শুধু একজন ভালো খেলোয়াড় নয়, একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
উমরের পরিসংখ্যানই তার দক্ষতার প্রমাণ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৫৭ ম্যাচে ১৩৮টি উইকেট, যার মধ্যে ছয়বার পাঁচ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব রয়েছে। লিস্ট এ ম্যাচে তার গড় ২৮.৮৩ এবং টি-টোয়েন্টিতে ২৪ ম্যাচে ১৯.৪০ গড়ে ৩২টি উইকেট তাকে প্রতিপক্ষের জন্য বিপজ্জনক করে তুলেছে।
এ বছর রঞ্জি ট্রফিতে মাত্র তিন ম্যাচে ১৫টি উইকেট নিয়ে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে তিনি জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তার বলের সুইং, গতি এবং লাইন-লেন্থ ধরে রাখার দক্ষতা তাকে ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পেসারদের একজন করে তুলেছে।
জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি (NCA) ইতিমধ্যেই উমরকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, খুব শীঘ্রই তিনি আইপিএলে জায়গা করে নিতে পারেন। নেট বোলার হিসেবে পাঞ্জাব কিংস এবং দিল্লি ক্যাপিটালসের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা উমরকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। বড় মঞ্চে তার অভিজ্ঞতা এবং ধারাবাহিকতা তাকে আন্তর্জাতিক স্তরে একজন প্রতিশ্রুতিশীল বোলার হিসেবে তুলে ধরতে পারে।
উমর নাজির মীর কেবল একজন ক্রিকেটার নন; তিনি সংগ্রাম, আত্মবিশ্বাস এবং একাগ্রতার প্রতীক। তার জীবন আমাদের শেখায় যে, সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও নিজের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব, যদি আপনি নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখেন এবং কঠোর পরিশ্রম করেন।
জম্মু-কাশ্মীরের উমরের এই গল্প আজ ভারতের যুবসমাজের জন্য এক আলোকবর্তিকা। তার সাফল্য প্রমাণ করে, যোগ্যতা এবং কঠোর পরিশ্রমের সামনে কোনও প্রতিকূলতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
চলো, উমরের এই যাত্রা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরাও নিজেদের লক্ষ্যে এগিয়ে যাই। কারণ স্বপ্ন পূরণের পথে কোনও সীমা নেই।