গোয়েন্দা গল্প : মূর্তি রহস্যের সমাধান

লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল

জলপাইগুড়ি শহরের একটি ছোট্ট কোণে, এক দোতলা বাড়ির ছাদে বসে পড়ছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ইধিকা সেন। মাথা নিচু করে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে নিজেই নিজের মনে বলছিল, “আরো একটু পড়াশোনা করলে মায়ের রাগ কিছুটা কমবে।” কিন্তু পড়াশোনায় মন বসছিল না তার। বাইরের দিকে তাকালেই কেমন যেন মন ছুটে যেত। রহস্যের গন্ধ তার মনকে বারবার টেনে নিচ্ছিল। ইধিকার স্বপ্ন হলো বড় হয়ে দেশের সেরা মহিলা গোয়েন্দা হওয়া।

আরো পড়ুন : গোয়েন্দা ইধিকার গল্প : করলার স্রোতে রহস্যের স্রোত

ইধিকা পড়াশোনায় যেমন তীক্ষ্ণ, তেমনি তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তার এই ক্ষমতা শহরের পুলিশ ইন্সপেক্টর রঞ্জন দত্তের নজরে পড়ে। রঞ্জন দত্ত ছিলেন ইধিকার বাবার সহকর্মী এবং ভালো বন্ধু। ইধিকার বাবাও একজন দক্ষ পুলিশ অফিসার। ইধিকার ছোটবেলার গল্পগুলো সবই তার বাবার গোয়েন্দাগিরির উপর ভিত্তি করে।

ইধিকার দুই বন্ধু পায়েল ও অনুরাগ তার প্রতিটি কাজে পাশে থাকে। পায়েল বুদ্ধিমতী, শান্ত ও স্থির প্রকৃতির মেয়ে। তার পর্যবেক্ষণশক্তি খুবই প্রখর। অন্যদিকে, অনুরাগ সবসময় কিছু না কিছু উদ্ভাবন করতে ভালোবাসে, এবং তার উদ্ভাবন ক্ষমতা ইধিকার রহস্য সমাধানে অনেকবার সাহায্য করেছে।

আজ সকালে, ইধিকা ছাদে বসে পড়ছিল, এমন সময় রান্নাঘর থেকে তার মায়ের চিৎকারে ধাক্কা খেলো।

“ইধিকা, নিচে আয়, রঞ্জন কাকু এসেছে।”

ইধিকা জানত, রঞ্জন কাকু প্রায়ই আসেন কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতে। সাধারণত পুলিশের কোনো জটিল কেসে সমস্যায় পড়লেই তিনি ইধিকার সাহায্য নেন। ইধিকা দেরি না করে দ্রুত নিচে নেমে এলো। নিচে এসে দেখে, রঞ্জন কাকু খুবই চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন।

“কী হয়েছে কাকু?” ইধিকা সরাসরি প্রশ্ন করলো।

“ইধিকা, একটা বড় সমস্যা হয়েছে। শহরের কাছে যে ছোট্ট গ্রামটা আছে, সেখানে গ্রাম প্রধান জানিয়েছেন, মন্দিরের পুরোহিত হঠাৎ করে হারিয়ে গেছেন এবং মন্দিরের মূল মূর্তিটাও নেই।” রঞ্জন দত্ত উদ্বিগ্ন মুখে বললেন।

“মূর্তি চুরি? আর পুরোহিতও হারিয়ে গেছেন? নিশ্চয়ই দুটোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে।” ইধিকা বলল।

রঞ্জন দত্ত সম্মতি জানিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, আমি তাই ভাবছি। এই কেসটা বেশ জটিল হতে চলেছে। আমি তোমাকে নিয়ে গ্রামের প্রধানের সাথে দেখা করতে চাই।”

ইধিকার মন সজাগ হয়ে উঠলো। এই প্রথমবার তাকে কোনো বড় কেসের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তার হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠলো। সে তৎক্ষণাৎ পায়েল আর অনুরাগকে ফোন করলো এবং ঘটনাটা জানাল।

পায়েল ফোন ধরে বলল, “তাহলে আমাদের আজই বেরোতে হবে। রহস্য যত জটিলই হোক, আমরা মিলে সমাধান করব।”

অনুরাগও উত্তেজিত স্বরে জানাল, “চলো, রঞ্জন কাকুর সাথে আমরা আজই গ্রামের দিকে রওনা দিই।”

তিন বন্ধু তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রঞ্জন দত্তের সাথে গ্রামে রওনা দিলো। গ্রামে পৌঁছানোর পর তাদের প্রথমেই গ্রামের প্রধানের সাথে দেখা হলো। গ্রামের প্রধান একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এই ঘটনার পর পুরো গ্রাম আতঙ্কে রয়েছে। আমাদের মন্দিরের মূল দেবীমূর্তিটি বহু পুরনো, গ্রামের সব মানুষ সেই মূর্তির উপরই নির্ভর করে। আর পুরোহিত মশাই গ্রামের সবার অভিভাবকস্বরূপ।”

ইধিকা প্রশ্ন করল, “পুরোহিত মশাইকে শেষ কোথায় দেখা গিয়েছিল?”

গ্রাম প্রধান বললেন, “সকালে মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিলেন। তারপর থেকেই তার কোনো খোঁজ নেই। মন্দিরের দরজা খোলা ছিল, তবে ভেতরে মূর্তিটা আর নেই। আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো তিনি কোথাও গিয়েছেন, কিন্তু তার মোবাইলও সুইচড অফ। আর তারপর খেয়াল করলাম, মন্দিরের সামনের সিঁড়িতে রক্তের কিছু দাগ পড়ে আছে।”

“রক্তের দাগ?” ইধিকা বিস্মিত হলো। “আমাদের মন্দিরে গিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে।”

রঞ্জন দত্তের অনুমতি নিয়ে ইধিকা, পায়েল ও অনুরাগ মন্দিরে প্রবেশ করলো। মন্দিরের দরজার সামনে কয়েকটি অদ্ভুত চিহ্ন দেখা যাচ্ছিলো, যেনো কেউ পায়ের আঙ্গুল দিয়ে টানাহেঁচড়া করেছে। ইধিকা মন্দিরের চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলো। হঠাৎ সে মন্দিরের পেছনের দিকে কিছু চাপ চাপ রক্তের দাগ দেখতে পেলো।

“পায়েল, তুমি এই রক্তের দাগগুলো পরীক্ষা করো। দেখি, এগুলো থেকে কিছু সূত্র পাওয়া যায় কি না,” ইধিকা বলল।

পায়েল দাগগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলো, “ইধিকা, এগুলো কোনো সাধারণ রক্তের দাগ নয়। মনে হচ্ছে, কেউ রক্তের দাগ মুছতে চেয়েছিল, কিন্তু পুরোপুরি পারেনি।”

“ঠিক বলেছো,” ইধিকা বলল। “যদি রক্ত মুছতে চায়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে এগুলো ঢাকতে চাইছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কীভাবে পুরোহিত মশাইকে মন্দির থেকে বের করল, আর কেন?”

অনুরাগ মন্দিরের পাশের বটগাছের কাছে গিয়ে খুঁজতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ খোঁজার পর সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ইধিকা, এখানে তাজা পায়ের ছাপ আছে। এই ছাপগুলো নদীর দিকে যাচ্ছে।”

“চলো, পাশের নদীর তীরে যাই,” ইধিকা বলল।

তারা নদীর ধার ধরে এগোতে থাকলো। নদীর পাড়ে এসে দেখে, জলেতে কিছু ভেসে যাচ্ছে। ইধিকা ভালো করে তাকিয়ে চিনতে পারলো, সেটি পুরোহিত মশাইয়ের পোশাক।

“এটা নিশ্চিত যে আমরা সঠিক পথে আছি। কিন্তু আমাদের আরো কিছু সূত্র খুঁজে বের করতে হবে,” ইধিকা বলল।

তারা নদীর ধারে আরো কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেলো, একটি জায়গায় মাটি খানিকটা উঁচু হয়ে আছে। খুঁড়ে দেখার পর তারা একটি পুরনো সিন্দুক পেলো, আর সিন্দুকের ভেতরেই ছিলো সেই হারিয়ে যাওয়া দেবীমূর্তি।

“কিন্তু পুরোহিত মশাই কোথায়?” পায়েল উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞাসা করলো।

“আমার মনে হচ্ছে, আমরা পুরোহিতকে এখান থেকে আরো কিছু দূরেই পাবো,” ইধিকা বলল।

তারা কিছুদূর এগিয়ে দেখতে পেলো, পুরোহিত মশাই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তার মাথায় আঘাত লেগেছে, তবে তিনি জীবিত আছেন।

“দ্রুত, আমাদের পুরোহিত মশাইকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে,” রঞ্জন দত্ত বললেন।

পুরোহিত মশাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর, ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। জ্ঞান ফিরতেই তিনি সব খুলে বললেন, “আমার মাথায় আঘাত করে কয়েকজন যুবক আমাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো মূর্তিটা চুরি করা, এবং এরপর তারা আমাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল। তবে তোমাদের ধন্যবাদ, তোমরা আমাকে এবং মূর্তিটাকে বাঁচিয়েছ।”

ইধিকা এবং তার বন্ধুরা খুশি মনে বাড়ি ফিরে এলো। রঞ্জন দত্ত তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, “তোমরা সবসময় আমার জন্যে বড় সহায়তা। ইধিকা, তোমার স্বপ্ন একদিন অবশ্যই পূরণ হবে।”

ইধিকার মন খুশিতে ভরে উঠলো। আজকের এই অভিযানে সে প্রমাণ করল যে বয়স কোনো বাধা নয়, বরং প্রতিভা ও সাহসের মেলবন্ধনই আসল পরিচয়।

ইধিকার তৃতীয় রহস্যের সমাপ্তি।

© পিনাকী রঞ্জন পাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *